দেশে ডিজিটাল যোগাযোগের মেরুদণ্ড বিএসসিসিএল
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়েছে বাংলাদেশ। ডিসেম্বরে উদযাপিত হবে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। সরকারি উদ্যোগে যেসব কোম্পানি দেশ ও জাতিগঠনে মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করেছে বিএসসিসিএল।
সাবমেরিন কেবল সংযোগের মাধ্যমে দেশে ব্যান্ডউইডথ সরবরাহের মূল সেবা দিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)। এক যুগ আগে গঠন করা কোম্পানিটি এখন দুটি সাবমেরিন কেবল পরিচালনা করছে। তৃতীয় আরেকটি সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সব মিলিয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত রেখে বাংলাদেশের ডিজিটাল যোগাযোগের মেরুদণ্ড হিসেবে ভূমিকা রাখছে বিএসসিসিএল।
সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার জন্য তত্কালীন বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ অ্যান্ড টেলিফোন বোর্ডের (বিটিটিবি) সঙ্গে এসএমডব্লিউ-৪ কনসোর্টিয়ামের সমঝোতা স্মারক সই হয় ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে। এ কেবলের সঙ্গে যুক্ত হতে ১৪টি দেশের ১৬টি টেলিযোগাযোগ অপারেটর চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সিঙ্গাপুর থেকে শুরু হয়ে ফ্রান্সের মার্শেই পর্যন্ত এ কেবলের বিস্তৃতি। কক্সবাজারের ল্যান্ডিং স্টেশনের মাধ্যমে এসএমডব্লিউ-৪-এর সঙ্গে সংযুক্ত হয় বাংলাদেশ। কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে ২০০৪ সালের মার্চে বিটিটিবির নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা চুক্তি হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালে এ প্রকল্পের সরঞ্জাম কেনায় অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) চুক্তি হয়।
বাংলাদেশ প্রথম সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে যুক্ত হয় বিটিটিবির অধীনে ২০০৬ সালের ২১ মে। এর ল্যান্ডিং স্টেশন কক্সবাজারের ঝিলংঝায়। এটির অর্থনৈতিক মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। তবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত এটি ব্যবহার করা যাবে। ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম থ্রু সাবমেরিন কেবল’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হয়। পরবর্তী সময়ে সাবমেরিন কেবল সেবার দায়িত্ব একটি স্বতন্ত্র কোম্পানির ওপর ন্যস্ত করা হয়, যেটি আজকের বিএসসিসিএল। পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে ২০০৮ সালে বিএসসিসিএল গঠন করা হয়। এর অনুমোদিত মূলধন ১ হাজার কোটি টাকা। বিটিটিবির কাছে থাকা কক্সবাজারের ল্যান্ডিং স্টেশনটি বিএসসিসিএলের অনুকূলে হস্তান্তর করা হয়। এ স্টেশন স্থাপনে ব্যয় ও এর সঙ্গে যুক্ত সম্পদ বিএসসিসিএলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রথম সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হতে বাংলাদেশের খরচ হয়েছিল প্রায় সাড়ে সাতশ কোটি টাকা।
পরবর্তী সময়ে বিকল্প হিসেবে আরো একটি সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে যুক্ত হয় বিএসসিসিএল। ২০১৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যুক্ত হওয়া দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলের মেয়াদ ২৫ বছর। এর ল্যান্ডিং স্টেশন কুয়াকাটায়। বিএসসিসিএল দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল এসএমডব্লিউ-৫ কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি করে ২০১৪ সালে। ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন। এ কেবলে যুক্ত হতে বাংলাদেশের খরচ হয়েছে ৬১০ কোটি টাকা।
দেশের ব্যান্ডউইডথের সিংহভাগ সরবরাহ করছে বিএসসিসিএল। আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ও উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার বিস্তৃতিতে আইএলডিটিএস ও আইসিটি নীতি বাস্তবায়নে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে কাজ করছে কোম্পানিটি। দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুটি সাবমেরিন কেবল ব্যান্ডউইডথ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা বিএসসিসিএল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তেও রয়েছে কেন্দ্রীয় ভূমিকায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির অধিকাংশই বছরের পর বছর লোকসান গুনছে। টিকিয়ে রাখতে এসব প্রতিষ্ঠানকে সরকারের পক্ষ থেকে বছর বছর ভর্তুকি দিতে হয়। যদিও যাত্রা শুরুর পর থেকেই লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসা করছে বিএসসিসিএল। ২০০৯ হিসাব বছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ৪৩ কোটি টাকা। এর পরের বছর এটি বেড়ে ৬০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০১৯-২০ হিসাব বছরে কোম্পানিটির আয় দাঁড়িয়েছে ১৯২ কোটি টাকায়। একইভাবে ২০০৯ হিসাব বছরে কোম্পানিটির ১১ কোটি টাকা কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছিল। যেটি ২০১৯-২০ হিসাব বছরে এসে ৯৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ২০১২ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিএসসিসিএল ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিচ্ছে। সর্বশেষ ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২০ হিসাব বছরে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।
বিএসসিসিএলের কোম্পানি সচিব মো. আবদুস সালাম খান বলেন, দেশে ইন্টারনেটের প্রসারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে বিএসসিসিএল। মোট ব্যান্ডউইডথের ৬৫-৭০ শতাংশ এককভাবে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। শুরু থেকেই এটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখন দুটি সাবমেরিন কেবল সংযোগের মাধ্যমে ব্যান্ডউইডথ সরবরাহ করছে বিএসসিসিএল। তৃতীয় সাবমেরিন কেবলের কাজও এগিয়ে চলছে। আশা করছি, ২০২৪ সালে এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারব।
২০০৬ সালে সাড়ে ৭ গিগাবিটস পার সেকেন্ড (জিবিপিএস) ব্যান্ডউইডথ নিয়ে দেশে সাবমেরিন কেবলের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ব্যান্ডউইডথ ক্যাপাসিটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭০০ জিবিপিএস। এর মধ্যে বিএসসিসিএল সরবরাহ করছে ১ হাজার ৬৫০ জিবিপিএস।
ডাটার ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিবেচনায় দেশে ব্যান্ডউইডথ সক্ষমতা আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য তৃতীয় সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। আর আগের দুটির মতো এ সাবমেরিন কেবল সংযোগটিও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বিএসসিসিএলকে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ এসএমডব্লিউ-৬ কনসোর্টিয়ামের ১১ এএসসি কর্তৃক চূড়ান্ত নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তির (সি অ্যান্ড এমএ) খসড়া অনুমোদন করেছে। তৃতীয় সাবমেরিন কেবল স্থাপন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৯৩ কোটি ১৬ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড নিজস্ব তহবিল থেকে ৩০০ কোটি ৮৩ লাখ ৪ হাজার ও সরকার বাকি ৩৯২ কোটি ৩৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকা বিনিয়োগ করবে। তৃতীয় সাবমেরিন কেবল থেকে বাংলাদেশ ১২ টেরাবাইট ব্যান্ডউইডথ পাবে। এ কনসোর্টিয়ামে যুক্ত রয়েছে ১৯টি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়া কনসোর্টিয়ামের অন্য দেশগুলো হলো সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, ইউএই, ইয়েমেন, জিবুতি, মিসর, তুরস্ক, ইতালি ও ফ্রান্স। সিঙ্গাপুর থেকে এ সাবমেরিন কেবল যাবে ফ্রান্স পর্যন্ত।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বিনা মাশুলে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে সাবমেরিন কেবল সংযোগের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তত্কালীন সরকার বাংলাদেশকে ১৪ বছর তথ্যপ্রযুক্তি দুনিয়া থেকে পিছিয়ে রাখে। ২০০৮ সালে সরকার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির হাত ধরে সেই পশ্চাত্পদতা বাংলাদেশ শুধু অতিক্রমই করেনি; বরং হাওর, দ্বীপ, চরাঞ্চল ও দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলসহ দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সংযোগ পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী দিনে ডিজিটাল সংযুক্তির বর্ধিত চাহিদা পূরণের মাধ্যমে ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে সিমিউই-৬ নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ স্থাপনে অভাবনীয় অবদান রাখবে। তৃতীয় সাবমেরিন কেবল সংযুক্তি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ অগ্রযাত্রায় একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।
সূত্র: বণিক বার্তা