গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : তীব্র গরমের মাঝেও চলছে লোডশেডিং। গ্রামে লোডশেডিং করে ঢাকাসহ বড় শহর সামাল দেয়ার কৌশলও কাজে আসছে না। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এখন প্রতিদিন গড়ে দুই-দিন ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। আর ঢাকার বাইরে দিনে এক ঘণ্টা পর এক ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,” এখন সর্বোচ্চ গরম পড়ছে। গরম কমার আগে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদনের সব সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আমরা এখন শহর ও গ্রামে লোডশেডিং ভাগ করে দিচ্ছি। আগে শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় লোডশেডিং করা হতো না।”
পরিস্থিতি কী?
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কথা বলে জানা গেছে, গত তিন-চার দিনে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে গেছে। মুন্সিগঞ্জের সাইফুর রাহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,” এখন আমাদের এখানে এক ঘণ্টা পর এক ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। দিনের অর্ধেক সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। এই তীব্র গরমে আমরা খুব কষ্টে আছি।”
তার কথা, “এখানে বিদ্যুতের অভাবে কৃষি জমিতে পানি দেয়া যাচ্ছে না। এখানকার শিল্প-কারখানা যা আছে, তা বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ থাকছে। বিদ্যুৎ অফিসে যোগাযোগ করা হলে তারা বলে উৎপাদন না থাকলে আমরা কীভাবে দেবো।”
একই অবস্থা উত্তরাঞ্চলের কুঁড়িগ্রামের। সেখানকার বাসিন্দা আরিফুর রহমান বলেন,” আগেও এখানে লোডশেডিং ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে নাই। আমাদের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ এখন মাঝে মাঝে আসে।”
তিনি বলেন, “এই গরমে বিদ্যুতের অভাবে শিশু এবং বয়স্করা কষ্ট পাচ্ছেন বেশি। তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।”
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা জেসমিন লিপি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,” কয়েকদিন ধরে বিদ্যুৎ এখানে সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ চলে যায়। আমাদের এলাকায় মনে হচ্ছে বিদ্যুতের অবস্থা বেশি খারাপ। রাজধানীর কিছু এলাকার অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো। সেখানে দিনে দুই তিনবার বিদ্যুৎ যায়।” তার অভিযোগ, “ঢাকা শহরে লোডশেডিংয়ে পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে। মিরপুরের মতো আরো কিছু এলাকায় লোডশেডিং বেশি করা হচ্ছে। অভিজাত এলাকায় তেমন করা হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “এর মধ্যেই সরকার এই স্কুল খোলা রাখে এই বন্ধ রাখে। বিদ্যুৎ না থাকলে এই গরমে, বাচ্চারা স্কুলে বসে ক্লাস করবে কীভাবে।”
ঢাকার পাশে সাভারে থাকেন শাকিল আহমেদ। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমি আমার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে তিনদিন ধরে হাসাপতালে আছি। হাসপাতালেও বিদ্যুৎ থাকে না। রোগীরা কষ্টে আছেন। জেনারেটরের তেলও ফুরিয়ে যায়। কারণ, টানা এক দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না।”
দেশে এখন প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ১৭ থেকে সাড়ে ১৭ হাজার মেগাওয়াট। এখন গড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হচ্ছে। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে ২২ এপ্রিল ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট। ওই দিনও লোডশেডিং ছিল ৪৪৬ মেগাওয়াট। বাংলাদেশের পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোর এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট।
পেট্রোবাংলার তথ্যে দেখা যায়, প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে দেশে গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে দৈনিক তিন হাজার ১০৫ মিলিয়ন ঘনফুট। বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র, বিশেষ করে যেগুলো প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাস ব্যবহার করে, গ্যাস সংকটের কারণে সেগুলোতে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দুই হাজার ৩১৬ মিলিয়ন ঘনফুটের চাহিদার বিপরীতে এক হাজার ৪২৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাচ্ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক শামীম হাসান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,” আসলে আমরা আমাদের চাহিদা মতো গ্যাস পাচ্ছি না। ফলে বিদ্যুতের যে চাহিদা সেই অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছি না। আমাদের কিছু প্ল্যান্ট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কিছু প্ল্যান্ট তার ক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদনে চালাতে হচ্ছে। আর এখন বিদ্যুতের তো পিক আর অফ পিক নাই। তীব্র দাবদাহের কারণে দিনে রাতে সব সময় বলতে গেলে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় সমান।” তিনি দাবি করেন,” আমরা চাহিদার চেয়ে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনে পিছিয়ে আছি। এর মধ্যে ২২ এপ্রিল আমরা রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছি।”
পিডিবির একজন কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে জানান,” গ্রামে সমব সময়ই লোডশেডিং ছিল। নীতি ছিল ঢাকাসহ বড় বড় শহরে লোডশেডিং করা যাবে না। কারণ এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ঢাকাসহ বড় শহরে লোড শেডিং করতে হচ্ছে। আর গ্রামে চাহিদার ৩০ ভাগের বেশি বিদ্যুৎ দেয়া যাচ্ছে না।”
এদিকে বেসরকারি পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো সরকারের কাছে ৪৬ হাজার টাকা পাওনা রয়েছে। আর ভারতের আদানির পাওনা হয়েছে চার হাজার কোটি টাকা। এটা নিয়েও সংকট হয়েছে। বেরসরকারি পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো জ্বালানি না কিনতে পারার অজুহাত তুলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঢিলেমি করছে বলে অভিযোগ আছে।
এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মকবুল ই ইলাহী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,” তারা তো ব্যবসা করছে। আর সরকার তাদের নানাভাবে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে। উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ খাচ্ছে। ফলে তারা আরো ব্যবসা করতে চায়।”
গরম চলে গেলে পরিস্থিতি ভালো হবে!
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,” এই সময়ে বিদ্যুতর চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। তার ওপরে এবার ৭০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে তাপদাহ চলছে। তাই আমরা সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট উৎপাদন করার পরও লোডশেডিং করতে হচ্ছে। আমরা ৩০ হাজার মেগাওয়াটও উৎপাদন করতে পারি। কিন্তু এরজন্য তেল, গ্যাস, কয়লা যাই বলেন না কেন আমাদের ঘটতি আছে।”
তিনি স্বীকার করেন যে, গ্রামে বিদ্যুৎ কম দিয়ে ঢাকাসহ বড় বড় শহর লোডশেডিংমুক্ত রাখার পরিকল্পনা করে তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ করছিলেন। তবে এখন শহরেও লোডশেডিং করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কয়েকদিন ধরে তারা শহর ও গ্রামে লোডশেডিং ভাগ করে দিচ্ছেন বলে তিনি জানান।
তার কথা,” এই হিটওয়েভ কমে গেলে ৫০০ মেগাওয়াট চাহিদা কমবে। তারপরও গরম থাকবে। তখনো লোডশেডিং করতে হবে তবে এত খারাপ হবেনা। আর গরম চলে গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এরমধ্যে আমাদের আর্থিক অবস্থাও ভালো হবে। আশা করি তখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে।”
মকবুল ই ইলাহী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “৩০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করার ক্ষমতার এই গল্প আর শুনতে চাই না। আসলে আমরা যা উৎপাদন করি তাই আমাদের ক্ষমতা। সে সব পাওয়ার প্ল্যান্টের কথা বলা হচ্ছে তাদের জ্বালানি দিলেই সবাই উৎপাদন করতে পারবেনা। আসলে এটা সরকারের সহায়তায় ক্যাপাসিটি চার্জের একটা ব্যবসা। এমন প্ল্যান্টও আছে যারা কেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করেই ক্যাপাসিটি চার্জ নেয়া শুরু করেছে।” তিনি এই পরিস্থিতির জন্য আমদানি নির্ভর জ্বালানি ব্যবস্থাকেও দায়ী করে বলেন,” আমরা গ্যাস থাকার পরও তা তুলছি না। আবার গ্যাসকুপ মেরামত করে বলি গ্যাসকুপ খনন করা হয়েছে। এখানে একটা হরিলুট চলছে।”
তার কথা,” পিডিবি যে লোডশেডিংয়ের কথা বলছে বাস্তবে সেটা আরো বেশি। গ্রামে তো বিদ্যুৎই থাকে না। আসলে বিদ্যুতের বাস্তব পরিস্থিতি যে কী তা-ও প্রকাশ করা হচ্ছে না।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে