আলোচিত

ডিএমপিতে শুরু হচ্ছে শুদ্ধি অভিযান, আতঙ্কে দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যরা

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম ঢাকা মহানগর পুলিশকে (ডিএমপি) ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন তিনি। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে একই স্থানে থেকে ঘুষ লেনদেনসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন বা ছিলেন সেই আমলনামা তৈরির নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ডিএমপির অনেক ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। এজন্য ‘জনগণের পুলিশ’ তৈরি করতে শিগগিরই শুদ্ধি অভিযান ও ব্যাপক রদবদলের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তারা আরও জানিয়েছেন, এ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। আবার নিজেদের রক্ষা করতে অনেকে তদবিরও শুরু করেছেন।

ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ হবে জনগণের পুলিশ। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে কাজ করতে হবে। কারও বিরুদ্ধে কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অপরাধের অভিযোগ উঠলে তাৎক্ষণিক তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্নীতির সঙ্গে কোনো আপস নেই। এ ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের মধ্যে পুলিশভীতি দূর করতে হবে। নিরপরাধ মানুষ যাতে থানায় গিয়ে হয়রানি ও পুলিশের চাঁদাবাজির শিকার না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বা কোনো সদস্য বাণিজ্য করছেন, জনসাধারণের সঙ্গে হয়রানিমূলক আচরণ করছেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ডিএমপি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নতুন পুলিশ কমিশনার সফিকুল ইসলাম দায়িত্ব নেন। পরে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বিশেষ বৈঠক করেন। পুলিশের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে কঠোর নির্দেশনা জারি করেন তিনি। নির্দেশনা পেয়ে পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেন। দীর্ঘদিন ধরে একই থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের তালিকা করা হচ্ছে। আবার ঘুরে-ফিরে একই থানায় দায়িত্ব পালনকারীদের তালিকাও হচ্ছে। তাছাড়া যেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়াসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে তাদেরও তালিকা করা হচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান চালানোর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। নিজেদের রক্ষা করতে কেউ কেউ তদবির শুরু করেছেন। তথ্য পাওয়া গেছে, গুরুতর অপরাধে কেউ শাস্তি হিসেবে অন্য জেলায় বদলি হলেও তাদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে আবারও ডিএমপিতে ফিরে আসেন।

ডিএমপির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিএমপির কোনো কোনো থানায় ওসি পাঁচ-ছয় বছর ধরে একটানা থাকছেন। মূলত রাজনৈতিক তদবিরেই ওসিরা দিনের পর দিন থাকতে পারছেন। কোনো থানার ওসি পরিবর্তন করার চেষ্টা করলেই নানা মহল থেকে চাপ বা তদবির আসে। তবে নতুন কমিশনার স্যার আমাদের বলে দিয়েছেন, পুলিশ হবে জনগণের পুলিশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও বলে দিয়েছেন রাজনৈতিক ব্যানারে পুলিশ থাকবে না। জনগণের সেবা করার মন-মানসিকতা নিয়েই পুলিশে চাকরি করতে হবে।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা আছেন তারা যে সরকার আসে ওই সরকারের গুণগান করে নেতা সেজে যান। কমিশনার স্যারের নির্দেশনা পেয়ে আমরা কাজ শুরু করে দিয়েছি। উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি), এডিসি, এসি, থানার ওসি, ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর, সহকারী সাব-ইন্সপেক্টরদের আমলনামা তৈরি করা হচ্ছে তা সত্য। শিগগির বড় ধরনের রদবদল করা হবে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশ প্রবিধানে বলা আছে, পুলিশের সদস্য দুই বছর এক স্থানে থাকতে পারবেন না। তবে বিশেষ প্রয়োজনে কর্র্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে সময়ের মেয়াদ কিছুদিন বাড়াতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পর ওসি পরিবর্তন করতে গেলেই আমাদের ওপর চাপ আসে তা সত্য। আইজিপি স্যার পুলিশ কমিশনারকে বলে দিয়েছেন, স্বাধীনমতো ডিএমপি সাজাতে। কোনো অন্যায়ের কাছে মাথানত না করতে। কমিশনার স্যার অনেক যোগ্য লোক। তিনি কঠোর হার্ডলাইনে থাকবেন। বিশেষ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাবেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডিএমপিতে শুদ্ধি অভিযান চালানো হবে।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমার জানামতে, ডিএমপির ৫০ থানার ওসি কতদিন ঢাকাতে দায়িত্ব পালন করছেন, কে কতটি থানায় ইতিমধ্যে দায়িত্ব পালন করেছেন, থানায় আসা মানুষের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করেন, কতটুকু সেবা দিচ্ছেন, সেবাপ্রত্যাশী মানুষদের হয়রানি করেন কি না, আর্থিক লেনদেনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এবং সার্বিক দায়িত্ব পালনে গাফিলতিসহ নানা বিষয় পর্যালোচনা করে দেখছে ডিএমপি সদর দপ্তর। যাদের সার্বিক কাজে নেতিবাচক অবস্থান পাওয়া যাবে, তাদের ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। তবে ভালো কাজের মূল্যায়ন করা হবে।’

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রমনা মডেল থানার ওসি মাইনুল ইসলাম আগে খিলগাঁও থানার ওসি ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে তাকে ডিএমপি সদর দপ্তরে বদলি করা হলেও কিছুদিন পরেই প্রভাব খাটিয়ে আবারও রমনা থানায় ফিরে আসেন। শাহবাগের ওসি আবুল হাসান আগে কোতোয়ালিতে, ধানমণ্ডির ওসি আবদুল লতিফ ডিবিতে, হাজারীবাগের ওসি ইকরাম আলী মিয়া চকবাজার ও ভাটারায় পরিদর্শক (অপারেশনস), নিউ মার্কেটের আতিকুর রহমান ক্যান্টনমেন্টে, কলাবাগানের ওসি ইয়াসির আরাফাত নিউ মার্কেটে, লালবাগের কেএম আশরাফউদ্দিন সূত্রাপুরের ওসি ও খিলক্ষেতে ইন্সপেক্টর (তদন্ত), কোতোয়ালির ওসি মো. শাহিদুর রহমান বংশালে, কামরাঙ্গীরচরের ওসি এ বি এম মশিউর রহমান কোতোয়ালিতে ও তেজগাঁওয়ের ইন্সপেক্টর (তদন্ত), চকবাজার থানার ওসি সোহরাব হোসেন সবুজবাগে, বংশালের ওসি মো. শাহিন ফকির আগে কামরাঙ্গীরচর, রূপনগর ও শাহবাগে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চাকরি জীবনে ডিএমপি থেকে কখনো বদলি হতে হয়নি শাহিন ফকিরকে।

তারা আরও জানান, ডেমরার ওসি মো. সিদ্দিকুর রহমান ডিএমপিতে, শ্যামপুরের মিজানুর রহমান মিরপুরে ইন্সপেক্টর (তদন্ত), কদমতলীর ওসি জামাল উদ্দিন মীর মোহাম্মদপুরে, যাত্রাবাড়ীর ওসি মাজহারুল ইসলাম তেজগাঁও ও কদমতলীতে, গেণ্ডারিয়ার ওসি মো. সাজু মিয়া কদমতলীতে ইন্সপেক্টর (তদন্ত), ওয়ারীর ওসি আজিজুর রহমান যাত্রাবাড়ীতে, মতিঝিলের ওমর ফারুক আগে মুগদায় থাকলেও দীর্ঘদিন মতিঝিলে রয়েছেন। এছাড়া পল্টনের ওসি মাহমুদুল হক ডিবিতে, সবুজবাগের মাহবুব আলম গুলশান থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত), খিলগাঁওয়ের মশিউর রহমান রমনায়, রামপুরার আবদুল কুদ্দুস ফকির সবুজবাগ ও বংশালে, শাহজাহানপুরের শহিদুল হক খিলক্ষেত ও পল্টনে, মুগদার প্রলয় কুমার সাহা রামপুরার ওসি ও পল্টনের ইন্সপেক্টর (তদন্ত), তেজগাঁওয়ের শামীম অর রশিদ তালুকদার চকবাজার ও দক্ষিণখানে, মোহাম্মদপুরের গোপাল গণেশ বিশ্বাস শেরেবাংলা নগর ও ডিবিতে, হাতিরঝিলের আবদুর রশিদ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেছেন।

পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আদাবরের ওসি এস এম কাউসার আহমেদ দীর্ঘদিন ডেমরা থানায় দায়িত্ব পালন করেছেন, শেরেবাংলা নগরের জানে আলম মুন্সি রমনা থানার ওসি ও কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত), মিরপুরের দাদন ফকির পল্লবীতে, পল্লবীর নজরুল ইসলাম মিরপুর ও ভাসানটেকে, শাহআলীর সালাউদ্দিন মিয়া গুলশানে ইন্সপেক্টর (তদন্ত), কাফরুলের সেলিম উজ্জামান শাহআলী ও দারুস সালামে, দারুস সালামের আসলাম উদ্দিন কাফরুল ও মিরপুর থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত), রূপনগরের আবুল কালাম আজাদ ডিএমপিতে, ভাসানটেকের মুন্সি ছব্বির আহমেদ শেরেবাংলা নগরের ইন্সপেক্টর (তদন্ত) ছিলেন।

তারা আরও জানিয়েছেন, গুলশানের ওসি এসএম কামরুজ্জামান ভাটারায়, বাড্ডার রফিকুল ইসলাম ওয়ারী ও পল্টনে ওসি এবং রামপুরায় ইন্সপেক্টর (তদন্ত) ছিলেন, ক্যান্টনমেন্টের কাজী শাহান হক রামপুরার ইন্সপেক্টর (তদন্ত), খিলক্ষেত থানার মো. মোক্তাজিরুর রহমান ডিএমপিতে, ভাটারার আবু বকর সিদ্দিক শাহবাগ ও গুলশানে, বনানীর বি এম ফরমান আলী বিমানবন্দর ও মতিঝিলে, উত্তরা পূর্ব থানার নূরে আলম সিদ্দিকী ডেমরা ও বংশালে, তুরাগের নুরুল মুক্তাকিম ভাটারা, লালবাগ ও ডেমরায় ছিলেন, দক্ষিণখানের ওসি শিকদার মোহাম্মদ শামীম হোসেন কাফরুলে, দীর্ঘদিন উত্তরখানের ওসি হেলালউদ্দিন ধানমণ্ডিতে, বিমানবন্দরের নূরে আযম মিয়া ধানমণ্ডি ও গুলশানে, উত্তরা-পশ্চিম থানার তপন চন্দ্র সাহা ওয়ারী ও দক্ষিণখানে ছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রায় পুরো কর্মজীবনই ডিএমপিতে কাটিয়েছেন।

 

সূত্র: দেশ রূপান্তর

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button