গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : করোনা মহামারীর মধ্যে বাল্যবিয়ে বেড়ে গেছে। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা সেই তথ্যই বলছে। তবে সম্প্রতি ধর্মীয় বিধান আর আইন দু’টিকে আলাদা করে দেখছেন অনেকে।
আইনে ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধিনিষেধ রয়েছে। তবে ধর্মের বিধানে মেয়েদের বয়সের বিষয়ে কিছু বলা নেই। শুধুমাত্র ছেলে বা মেয়ে সাবালক বা সাবালিকা হলেই বিয়ে দেওয়া যাবে। তবে ধর্মে ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে এমন কিছু বলা নেই। তাই আইন মেনেই বিয়ের কথা বলছেন ধর্মীয় বিশ্লেষকরা।
গত রোববার কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থেকে বাল্য বিয়েতে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মিঠামইন থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম বলেন, “মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাড়ির পাশের রাস্তা থেকে এই ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন তাদের আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়েছে। তারা লিফলেটে বলছে, বিয়ে সংক্রান্ত বর্তমান আইন ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধ। কারণ ধর্মে কোথাও মেয়েদের বয়সের কথা উল্লেখ করা নেই। এটা নিয়েই তারা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছিল। ফলে তাদের গ্রেপ্তারের পর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে। দুই একদিনের মধ্যেই তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”
আসলেই কী আইন ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধ? জানতে চাইলে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ বলেন, “ধর্মে বলা আছে, ছেলে-মেয়েদের সাবালোক বা সাবালিকা হতে হবে। কিন্তু সেটা ১৮ বছরের আগে হলেই যে তখনই বিয়ে দিতে হবে, সেটা কিন্তু ধর্মে বলা নেই। ধর্ম বলছে, সাবালিকা হলে বিয়ে দেওয়া যাবে।
কিন্তু কখন দিতে হবে, সেটা সরকার আইন করে বলেছে। এক্ষেত্রে আইন মান্য করাই শ্রেয়৷ কেউ যদি এটার ভুল ব্যাখা করেন তাহলে তো হবে না। আমি মনে করি, ধর্মীয় বিধান বাল্যবিবাহ বন্ধে কোন বাধা হতে পারে না। দেশের জনগণকে সরকারের আইন মানতে হবে।”
কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থেকে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন, নিকলীর মো. আনিছুর রহমান (৪৩), মো. মুজিবুর রহমান (৫০), আজহারুল ইসলাম (২৩), মো. ইসলাম উদ্দিন (৪১), মো. রইছ উদ্দিন (৬০), মো. হারুন অর রশিদ (৩৫), মো. আব্দুর রশিদ (৪০), মো. সাইদুর রহমান (৫২), আব্দুস সাত্তার (৫২), মো. আব্দুল হাসিম (৫২), মো. আশরাফ আলী (৬১), মো. মজিবুর রহমান (৫২); কটিয়াদীর মিজানুর রহমান খান (৫৫); অষ্টগ্রামের মহিউদ্দিন (৩২); কিশোরগঞ্জ সদরের ওমর ফারুক (২৬) ও জামাল উদ্দিন (৪০) এবং নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার ইমরান হোসাইন খান (২৯)।
করোনায় কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে
বাল্যবিয়ে বেড়েছে উল্লেখ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমরাই পারি এর নির্বাহী পরিচালক জিনাত আরা হক বলেন, “করোনার মধ্যে কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে। কারণ আগেও বাল্যবিয়ে ছিল, এখনও হচ্ছে। এখন হয়ত বেড়েছে। আগে বাল্যবিয়ে হলেও রেজিষ্ট্রেশন হতো। নতুন আইন হওয়ার পর এখন মেয়ের বয়স ১৮ বছরের কম হলে সেটার রেজিষ্ট্রেশন হচ্ছে না। বিয়ে তো দুই ধরনের, একটা আইন অনুযায়ী, আরেকটা শরীয়া অনুসারে। আমাদের দেশে শরীয়া অনুসারে অল্প বয়সে বিয়ে হতে কোন বাধা নেই। আইনেও সেটা বলা হয়নি। ফলে অনেকের অগোচরেই শরীয়া অনুসারে বিয়ে হচ্ছে। সেখানে রেজিষ্ট্রেশন না হওয়ায় কিশোরীরা ঝুঁকিতে পড়ছে। এই বিয়েটা যদি কোন কারণে না টেকে তাহলে তো মেয়ের কোন অধিকারই থাকছে না। কোন কিছু দাবি করতে গেলেও তো রেজিষ্ট্রেশনের কাগজটা দরকার। তাদের তো সেটা থাকছে না। এটা আমাদের জন্য একটা ভয়ের কারণ। রেজিষ্ট্রেশনটা অবশ্যই থাকতে হবে।”
যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, “আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব সময় বাল্যবিয়ে বন্ধে চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন যে সমস্যাটা হচ্ছে, আগে স্কুল-কলেজ খোলা থাকার সময়ে সহপাঠী বা অন্য কোন মাধ্যমে বাল্যবিয়ের খবরটা আমরা জানতে পারতাম। এখন অনেক খবরই আমরা জানতে পারি না। গোপনে হয়ত সেটা হচ্ছে৷ ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার বা গ্রাম পর্যায়ে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের মাধ্যমে খবরটা পেলেই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিয়ে বন্ধের উদ্যোগ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়।”
করোনায় বাল্য বিয়ে কতটা বেড়েছে?
করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অন্যান্য সময়ের তুলনায় দেশে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বেড়েছে, যা ২৫ বছরে সর্বোচ্চ। দেশের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাকের গবেষণায় এই তথ্য উঠে আসে। এই গবেষণায় ব্র্যাকের সঙ্গে কাজ করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প সমন্বয়ক অর্পিতা দাস বলেন, “গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ মাস আমরা ২১ জেলায় ২১ হাজার মানুষকে নিয়ে গবেষণা করেছি। সেখানে ১৩ হাজার ৮৮৬ টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। যার অর্ধেক ক্ষেত্রেই কন্যার বয়স ছিল ১০-১৫ বছর। যদিও আগে কোন গবেষণা না থাকায় আসলেই কতটা বাল্যবিয়ে বেড়েছে সেটা আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি।
ব্র্যকের ওই গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। বাল্যবিবাহে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ওই গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে, করোনাকালে অভিভাবকের কাজকর্ম না থাকায় ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারণে ৮৫ শতাংশ, সন্তানের স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায় ৭১ শতাংশ এবং করোনা মহামারী দীর্ঘ স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তা বোধ এবং বিদেশ থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় ৬২ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিবাহ।
গত বছরের অক্টোবরে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে প্রথম তিন মাস অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ২৩১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে এবং ২৬৬টি বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাল্যবিয়ে হয়েছে কুড়িগ্রাম, নাটোর, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায়। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, গেল মাসে ৪৬২টি কন্যা শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয় এর মধ্যে প্রশাসন ও সচেতন মানুষের উদ্যেগে ২০৭টি বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়।
বেশী সংখ্যক বাল্যবিয়ে হওয়া জেলাগুলোর একটি যশোর। সেখানকার জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান অবশ্য এই তথ্য জানেন না। তিনি বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু যশোর যে এর মধ্যে একটা সেটা কেউ আমাকে বলেনি। অবশ্যই আমরা আরো কঠোরভাবে বাল্যবিয়ে বন্ধে আন্তরিকভাবে সামনের দিনে কাজ করে যাব।”
সূত্র: ডয়চে ভেলে