অর্থনীতিআলোচিত

‘ডুয়েল কারেন্সি’ কার্ড ব্যবহারে নতুন বিড়ম্বনা

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ধরা যাক, যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে কোনো বাংলাদেশীর জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ কেনার প্রয়োজন পড়ল। এজন্য তিনি গেলেন ফার্মেসিতে। পকেটে নগদ অর্থ নেই; ভরসা দ্বৈত মুদ্রার কার্ডে। বিপদের মুহূর্তে এ ক্রেডিট কার্ডও কোনো কাজে আসবে না। এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে দ্বৈত মুদ্রার কার্ড ব্যবহারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নীতিমালা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশ থেকে পণ্য বা সেবা গ্রহণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল কার্ড গ্রাহককে অনলাইন ট্রানজেকশন অথরাইজেশন ফরম বা ওটিএএফ পূরণ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা দিতে হবে। যাচাই শেষে ব্যাংক অনুমোদন দিলেই কেবল গ্রাহক অনলাইনে মূল্য পরিশোধ করতে পারবেন। অনলাইনে জুয়া খেলাসহ অননুমোদিত লেনদেন বন্ধ করতে এ নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেই নতুন বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে দ্বৈত মুদ্রার কার্ড ব্যবহারকারীদের।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্বৈত মুদ্রার কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন এ শর্ত গ্রাহকদের হয়রানি বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। সংকট বাড়বে ব্যাংকের ইন্টারন্যাশনাল কার্ড বিপণনেও, দেশের ই-মানি সম্প্রসারণের পথকে যা রুদ্ধ করবে।

বাংলাদেশী নাগরিকদের বিদেশ ভ্রমণ বা অনলাইনে কেনাকাটায় অর্থ ব্যয়ের সীমা উল্লেখ করা আছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ট্রানজেকশনস নীতিমালায়। এ নীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশী পণ্য কেনাকাটায় আন্তর্জাতিক কার্ড ব্যবহারকারী গ্রাহকরা এককভাবে কোনো পণ্য বা সেবামূল্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০০ ডলার পর্যন্ত পরিশোধ করতে পারেন। তবে বছরে তা কোনো অবস্থাতেই ১ হাজার ডলারের বেশি হবে না। কার্ড ব্যবহার করে পণ্য কেনা বা সেবার মাশুল পরিশোধের ক্ষেত্রে এতদিন গ্রাহকদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে অনুমতি নিতে হতো না। কিন্তু গত ১৪ নভেম্বর জারি করা প্রজ্ঞাপনে এ শর্ত জুড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এখন থেকে আন্তর্জাতিক কার্ড ব্যবহারকারীদের প্রতিটি লেনদেনের জন্য গ্রাহকদের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে অনুমতি নিতে হবে। ওটিএএফ পূরণ করে জমা দিতে হবে ব্যাংকে। ব্যাংক সেটি যাচাই করে কোনো অসংগতি না পেলে তবেই গ্রাহক ক্রেডিট কার্ডে ডলার ব্যবহারের অনুমতি পাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন এ শর্ত নিয়ে বিপদে পড়েছে আন্তর্জাতিক কার্ড বিপণনকারী ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলো। কার্ড ব্যবহারে এ ধরনের শর্ত পুরো বিশ্বেই বিরল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

আন্তর্জাতিক কার্ডের ওপর নতুন শর্ত সামগ্রিক ডিজিটাল লেনদেনকেই বাধাগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট কোনো খাতে লেনদেন বন্ধের সুযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দিলে কারিগরিভাবেই সেটা সম্ভব। কিন্তু তা না করে সব লেনদেনের বিষয়ে ওটিএএফ পূরণ করতে হলে গ্রাহকরা বিড়ম্বনার শিকার হবেন।

যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ক্রেডিট কার্ডসহ আন্তর্জাতিক কার্ড ব্যবহার করে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। কেউ কেউ অনলাইন ক্যাসিনো বা গেম খেলে দেশের অর্থের অপচয় করছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার এমন পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতেই ওটিএএফ পূরণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে অর্থের গন্তব্য জানা যাবে। একই সঙ্গে দেশ থেকে অর্থ পাচারের একটি পথও বন্ধ হবে।

তবে ব্যাংকাররা বলছেন, আন্তর্জাতিক কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন শর্ত ‘মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার’ শামিল। এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, নতুন শর্তের বিরূপ প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। ১০ ডলার লেনদেনের জন্যও গ্রাহকরা ব্যাংকের কাছে আবেদন করছেন। এসব আবেদন যাচাইয়ের জন্য ব্যাংকারদের ২৪ ঘণ্টা সেবা চালু রাখতে হবে। এতে গ্রাহক ও ব্যাংকার উভয়কেই বিড়ম্বনা পোহাতে হবে। ওটিএএফ চালু করার ফলে গ্রাহকরা আন্তর্জাতিক কার্ড ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবেন। গ্রাহকরা আবারো নগদ ডলার বহনের ঝুঁকি নেবেন। নতুন শর্তের প্রতিক্রিয়া জানাতে শিগগিরই আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যাব।

অর্থ পাচার রোধের যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক কার্ডের ওপর নতুন শর্ত আরোপ করলেও পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ৬ হাজার ৩১৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ৫ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকারও (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে) বেশি। শুধু ২০১৫ সালেই দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫৯২ কোটি ডলার বা ৫০ হাজার কোটি টাকা। তথ্য-উপাত্ত বলছে, দেশ থেকে পাচার হওয়া এ অর্থের ৮০ শতাংশই হয়েছে আমদানি-রফতানির আড়ালে। সম্প্রতি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এক সেমিনারে একই তথ্য জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদও।

দেশের ব্যাংকগুলো বর্তমানে দ্বৈত মুদ্রার ক্রেডিট কার্ডের পাশাপাশি ডেবিট কার্ড, প্রিপেইড কার্ড ও ইন্টারন্যাশনাল কার্ড ইস্যু করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মোট কার্ড ইস্যু করা হয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ ৩৯ হাজার ৯০২টি। এর মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা মাত্র ১২ লাখ ৩ হাজার ৪২৭। ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৯৮টি প্রিপেইড কার্ড ইস্যু করেছে ব্যাংকগুলো। বাকি ১ কোটি ৫৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৭৭টিই ডেবিট কার্ড। এ কার্ডের বেশির ভাগেরই দ্বৈত মুদ্রায় ব্যবহারের অনুমোদন নেই।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেশে দ্বৈত মুদ্রার কার্ড ব্যবহারকারী গ্রাহকদের বিদেশে সেবা মাশুল বা পণ্যমূল্য পরিশোধের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক বছরে আন্তর্জাতিক কার্ডের মাধ্যমে গ্রাহকরা মোট ব্যয় করেছেন ৫ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্রাহকরা প্রতি মাসে গড়ে মাত্র ৪৯৩ কোটি টাকার বিদেশী পণ্য ক্রয় বা সেবার মাশুল পরিশোধ করেছেন।

এর মধ্যে দ্বৈত মুদ্রার ক্রেডিট কার্ড বিদেশের এটিএম বুথে ব্যবহার করে ৯২ কোটি ৯০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। পস মেশিনের মাধ্যমে কেনাকাটায় ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৭০৩ কোটি এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে ৭৭১ কোটি টাকা ব্যয় করেছেন গ্রাহকরা। সে হিসাবে এক বছরে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বিদেশী মুদ্রায় ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা।

দ্বৈত মুদ্রার ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে এটিএম বুথ থেকে ৫৪ কোটি, পস মেশিনে ১৩৩ কোটি ও ই-কমার্সের মাধ্যমে ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সব মিলিয়ে দ্বৈত মুদ্রার ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে গ্রাহকরা ব্যয় করেছেন ২৩৫ কোটি টাকা।

দেশের ব্যাংকগুলোর ইস্যুকৃত প্রিপেইড কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ হয়েছে ২৭৯ কোটি টাকা। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল কার্ডের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে ১ হাজার ২৭২ কোটি, পিওএস মেশিনের মাধ্যমে ১ হাজার ৪১৫ কোটি ও ই-কমার্সের মাধ্যমে ১৪৯ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

দেশে কার্যরত প্রায় সব ব্যাংকই ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ডসহ বিভিন্ন ধরনের কার্ড ইস্যু করার ব্যাপকভিত্তিক উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য এ খাতে বিপুল বিনিয়োগও করেছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু আন্তর্জাতিক কার্ডের ওপর নতুন শর্ত আরোপ ব্যাংকগুলোর উদ্যোগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে মনে করেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সব লেনদেনের ক্ষেত্রেই ওটিএএফ পূরণ করতে হলে ব্যাংকের কাজ অনেক বেড়ে যাবে। এজন্য অতিরিক্ত জনবলেরও প্রয়োজন হবে। প্রয়োজনের মুহূর্তে অর্থের সংস্থানের জন্যই দ্বৈত মুদ্রার কার্ড চালু করা হয়েছে। নতুন নীতির ফলে এ উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হবে।

প্রায় একই অভিমত জানিয়েছেন ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। তিনি বলেন, যেসব পণ্য বা সেবা গ্রহণ বন্ধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নীতিমালা জারি করেছে, তা সফটওয়্যার ব্যবহার করেই বন্ধ করা সম্ভব। সব লেনদেনের অনুমতি যথাসময়ে দেয়া সম্ভবও নয়। বরং দেশের বাইরে থেকে ইস্যু করা ক্রেডিট কার্ডের অবৈধ লেনদেন বন্ধ করতে পারলে অর্থ পাচার বন্ধ হবে।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ উদ্যোগের ফলে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ শিল্পে আনুমানিক ৫০ থেকে ৮০ হাজারের মতো মানুষ কাজ করছে, যারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রতিনিয়ত তৈরি করে যাচ্ছে অসংখ্য ডিজিটাল কনটেন্ট এবং প্রদান করছে ডিজিটাল মিডিয়ার বিভিন্ন সার্ভিস (বিজ্ঞাপন বিতরণ, ক্রয়, বিজ্ঞাপনের প্রযুক্তি প্লাটফর্ম, দেশীয় কনটেন্ট প্লাটফর্ম ইত্যাদি)।

এ অবস্থায় গত রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালের সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) প্রতিনিধি দল। বৈঠকে বেসিসের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি প্রস্তাবও দেয়া হয়। বিকল্প ব্যবস্থার প্রচলন না করা পর্যন্ত ক্রেডিট ও প্রিপেইড কার্ড দ্বারা ট্রাভেল কোটায় ডিজিটাল মার্কেটিং খাতে মূল্য পরিশোধের সুবিধাটি সক্রিয় রাখা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

 

সূত্র: বণিক বার্তা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button