আলোচিতজাতীয়

উপজেলা নির্বাচন: মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপাররা (এসপি)। মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এসব কর্মকর্তারা। নির্বাচনে প্রভাবশালীদের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হলে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) পাশে পাবে কিনা সে ব্যাপারে জানতে চান তারা। জবাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে নেওয়া যেকোনও পদক্ষেপের সঙ্গে অবশ্যই পাশে থাকবে বলে কমিশন আশ্বাস দিয়েছে। ইস বলেছে, উপজেলা পরিষদে মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন দেখতে চায় কমিশন। বদলির ভয়ে কারও কাছে অবস্থান না বিকিয়ে প্রশাসন ও পুলিশকে নীতিতে অটল থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

বৃহস্পতিবার (২৫ এপ্রিল) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ষষ্ঠ উপজেলা ভোট নিয়ে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সভায় এসব কথা উঠে আসে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।

সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে সভায় চার নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি), সকল বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশ কমিশনার (সংশ্লিষ্ট), রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি), জেলা প্রশাসক (ডিসি), পুলিশ সুপার (এসপি) ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা অংশ নেন।

সভা থেকে উপজেলা নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন করতে মাঠ প্রশাসনকে নানা দিক নির্দেশনা দেয় ইসি। একইসাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ও প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া মোবাইল সেবা সার্ভিস যেমন বিকাশ, রকেট ও নগদ ও মোবাইলের মাধ্যমে নির্বাচনে কালো টাকা ছড়ানো হয়। এসব টাকা বন্ধে কীভাবে প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারে— সে বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতেই বিষয়বস্তু তুলে ধরে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। এসময় সারাদেশে চারধাপে শুরু হতে যাওয়া আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ব্যর্থ হলে ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র ব্যর্থ হবে বলে মন্তব্য করেন সিইসি। তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাচনে ব্যর্থ হলে ৭ জানুয়ারি যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা ব্যর্থ হবে। উপজেলা ভোট ব্যর্থ হলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হতে পারে। তিনি বলেন, দেশের নির্বাচনে আবেগ-অনুভূতির জন্য কিছুটা বিশৃঙ্খলা হয়। এরমধ্যেও ভোটাররা যেন নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। যেকোনও মূল্যে নির্বাচন সুষ্ঠু করতে হবে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে, তা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে।

সিইসির বক্তব্যের পর ফ্লোর উন্মুক্ত করে উপস্থিত উপজেলা নির্বাচনের মাঠ পরিস্থিতি জানতে ডিসি-এসপিদের কাছ থেকে বক্তব্য আহ্বান করা হয়। এরপরই অনুমতি নিয়ে একে একে বক্তব্য দেন আগ্রহী কর্মকর্তারা। এসময় দুইজন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, ছয়-সাতটি জেলার ডিসি ও এসপি, দুইজন ডিআইজি ও দুইজন বিভাগীয় কমিশনার তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশন সচিব এবং চারজন নির্বাচন কমিশনার মাঠ প্রশাসনের উদ্দেশে বক্তব্য দেন।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, কমিশনের সামনে বক্তব্য দিতে গিয়ে কয়েকজন ডিসি ও এসপি মন্ত্রী–এমপিদের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ তোলেন। এক্ষেত্রে সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের ভূমিকা ও বাড়াবাড়ি নিয়েও কথা বলেন কেউ কেউ। ফলে উপজেলা নির্বাচনে তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচনি আচরণবিধি মানাতে মাঠ প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেবে কিনা সে সম্পর্কে কমিশনের কাছে জানতে চান। কারণ দলীয় প্রধানদের নির্দেশ উপেক্ষা করে অনেকেই নিজ সন্তান-ভাই কিংবা পরিবারের আত্মীয়-স্বজনকে প্রার্থী করেছেন। প্রত্যাহার না করে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে মাঠে নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। সঙ্গে প্রশাসনকে তাদের পরিবারের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করার জন্য চাপ প্রয়োগ করছেন। এ নিয়ে সভায় পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কমিশনের কাছে আর্জি জানান তারা। বলেন, মন্ত্রী-এমপিদের পক্ষে কাজ না করলে অনেক সময় বদলির হুমকি আসে।

কোনও কোনও ডিসি ও এসপি প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ওনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে কমিশন আমাদের পাশে থাকবে কিনা, আশ্রয় দেবে কিনা, নাকি আবার মন্ত্রী-এমপিরাই উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে তদবির করে বদলি করে দেবেন। জবাবে সিইসি শঙ্কিত ডিসি-এসপিদের আশ্বস্ত করে বলেন, কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বদ্ধ পরিকর। আপনাদের সবার আন্তরিক সহযোগিতা ও জোরালো ভূমিকার কারণে সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচন অত্যন্ত সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সরকারও ওই নির্বাচনে কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ না করে কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে। এবারের উপজেলা নির্বাচনেও সরকার আমাদের পাশে রয়েছে। সেজন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে আপনারা যে ভূমিকা রাখবেন কমিশন সব সময় তার পাশেই থাকবে। নির্বাচন কমিশনের কথা শোনার কারণে উচ্চ মহল থেকে নির্বাচনে দায়িত্বরত কোনও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বদলির জন্য সুপারিশ এলে তা কমিশন যথাযথ যাচাইয়ের পর প্রমাণ সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেবে; এজন্য দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই।

একজন পুলিশ কমিশনার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আমাদের উপরে চাপ রয়েছে। জবাবে পুলিশের মহা-পরিদর্শক (আইজিপি) বলেন, ভয়ের কিছু নেই। সর্বোচ্চ শাস্তি বদলি করবে। আরেক জায়গায় অর্থাৎ নতুন কর্মস্থলে চাকরি করবেন সমস্যা নেই তবু মাথা নত করা যাবে না। এসময় সিইসিসহ সব কমিশনার এ বিষয়ে তাদের অশ্বস্ত করেন। বলেন, বদলি কোনও শাস্তি নয়। এটা চাকরির অংশ। আপনাদের বিরুদ্ধে কোনও মহল থেকে বদলি করার জন্য কমিশনে অনুরোধ এলে আমরা সেটি খতিয়ে দেখবো। কারও কথায় আপনাদের বদলি করা হবে না। কমিশন নিজস্ব উৎস থেকে তদন্ত করবে। যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা না পায় তাহলে বদলি করা হবে না। আপনারা কারও কাছে মাথা নত করবেন না। দায়িত্বে অটুট থাকেন। আমরা আপনাদের সব ধরণের সহায়তা দেবো।

সূত্র জানায়, বৈঠকে কোনও কোনও বক্তা উপজেলা নির্বাচন নিয়ে মাঠের চিত্র তুলে ধরে জানান— নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রার্থী যেসব উপজেলায় রয়েছেন সেখানে আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে যে কয়টি উপজেলায় আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বিএনপি বা জামায়াতের প্রার্থী মাঠে রয়েছেন সেসব উপজেলায় এ শঙ্কা আরও প্রকট। সেজন্য শুরু থেকেই এসব এলাকায় বিশেষ নজর দিতে হবে যাতে বড় ধরনের কোনও কিছু না ঘটতে পারে। বৈঠকে পার্বত্য এলাকার সর্বশেষ পরিস্থিতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ওই এলাকার চারটি উপজেলা ভোট স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান তারা। এছাড়া পুরো পাহাড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদারের পরামর্শ আসে বৈঠক থেকে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. মাহমুদুল হোসাইন খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত সেভাবে নেই। সেজন্য তারা এ নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে নানা ষড়যন্ত্র করতে পারে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় বিশেষ নজর রাখতে হবে।

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button