গাজীপুর

কালীগঞ্জে কাজ না করেই কাবিখা’র গম আত্মসাত, র‌্যাবের মামলার পর কাজ শুরু!

বিশেষ প্রতিনিধি : কালীগঞ্জে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা)’ কর্মসূচি আওতায় কাজ না করেই সরকারি গম উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে দুই ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে। ঘটনা তদন্তে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে উপজেলা প্রশাসন।

গম উত্তোলনের পর আত্মসাতের উদ্দেশে কালোবাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়ার পথে সম্প্রতি ১৭.২৫ টন মেট্রিক টন গম জব্দ করে মামলা করেছে র‌্যাব-১–এর সদস্যরা। এরপর তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু করে জড়িত দুই ইউপি সদস্য।

স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য এবং অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কাজ না করেই সরকারি গম আত্মসাতের এ চিত্র।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, খাদ্য গুদাম থেকে সরাসরি সিন্ডিকেটের ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়েছিল। কাজ না করেই গম উত্তোলন এবং ঘটনা ধামাচাপা দিতে তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু করা ওই দুই ইউপি সদস্যকে সহযোগিতা করছেন গাজীপুর সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব কালীগঞ্জ) মোঃ ইশতিয়াক হোসাইন উজ্জল। জড়িতদের সহযোগিতার বিষয়টি ওই কর্মকর্তার কথায়ও মিলেছে।

ঘটনা তদন্তে ৩০ জুন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান কালীগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীনা আক্তার। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিসার মোঃ শাহাদৎ হোসেন এবং সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসার শিখা আক্তার (অতিরিক্ত দায়িত্ব কালীগঞ্জ)। ৭ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্যের অনুকুলে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা)’ কর্মসূচি আওতায় কালীগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের দু’টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৫১ মে: টন গম বরাদ্দ হয়।

শালদিয়া রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ চলছে।

প্রকল্প ১ ‘ জাঙ্গালিয়া মৌশুন্দী আমাজাদ দর্জির বাড়ীর পশ্চিম পাশ থেকে শালদিয়া জাঙ্গালিয়া রাস্তা পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাট’ ৩৫ মে: টন এবং প্রকল্প ২ ‘জাঙ্গালিয়া মুনতলী মেইন রাস্তা থেকে জিন্নাত আলীর বাড়ির উত্তর পাশ দিয়ে মোক্তারের বাড়ির পূর্ব পাশ পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাট’ ১৬ মে: টন গম বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এর মধ্যে প্রকল্প-১ এ প্রথম দুই দফায় ৮.৭৫ মে: টন করে মোট ১৭.৫ মে: টন এবং প্রকল্প-২ এ দুই দফায় ৪ মে: টন করে মোট ৮ মে: টন গমসহ সর্বমোট ২৫.৫ মে: টন গম পূর্বেই উত্তোলন করেছে জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) ও প্রকল্পের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দর্জি।

প্রকল্প-১ এর বিষয়ে জানতে চাইলে শুক্রবার (৩ জুলাই) স্থানীয় আমাজাদ দর্জি ও আকলিমা বলেন, রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে অনুমানিক ২০ থেকে ২২ দিন আগে। ভেকু এবং শ্রমিক দিয়ে রাস্তার কাজ করা হয়েছে।

প্রকল্প-২ এর বিষয়ে স্থানীয় সানি শুক্রবার (৩ জুলাই) বলেন, ‘দুই দিন যাবত রাস্তায় মাটি ভরাট চলছে। এর আগে এই রাস্তার কোন কাজ করা হয়নি’।

জাঙ্গালিয়া মোক্তারের বাড়ির পূর্ব পাশ পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ মামলা হওয়ার পর শুরু হয়েছে (২ জুলাই)।

জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য (মেম্বার) শিরিন আক্তার শুক্রবার (৩ জুলাই) বলেন, ‘ঘটনা তদন্তে কালীগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীনা আক্তার শুক্রবার প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেছেন। মৌশুন্দী আমাজাদ দর্জির বাড়ীর পশ্চিম পাশ থেকে শালদিয়া জাঙ্গালিয়া রাস্তা পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ চলছে’।

অপরদিকে স্থানীয়দের বরাত দিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘মুনতলী মেইন রাস্তা থেকে জিন্নাত আলীর বাড়ির উত্তর পাশ দিয়ে মোক্তারের বাড়ির পূর্ব পাশ পর্যন্ত রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ মামলা হওয়ার পর শুরু করেছে’।

এ বিষয়ে জানতে জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গাজী সারওয়ার হোসেন এবং জাঙ্গালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২ নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) ও প্রকল্পের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দর্জির মোবাইল ফোনে একাধিক বার কল করেও তাদের পাওয়া যায়নি।

 

মোক্তারপুর শিংলাব মামলা হওয়ার পর রাতের আঁধারে রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে (২৯ জুন রাতে)।

অপরদিকে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে নির্বাচনী উপজেলা ভিত্তিক গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা)’ কর্মসূচির আওতায় মোক্তারপুর ইউনিয়নের ‘শিংলাব ছফর উদ্দিনের বাড়ি থেকে সোলায়মানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার’ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৭.৫ মে: টন গম বরাদ্দ হয়।

এর মধ্যে প্রথম দফায় ৩ মে: টন গম পূর্বেই উত্তোলন করেছে মোক্তারপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) ও প্রকল্পের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন।

নাম প্রকাশ না করার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, ‘মামলা হওয়ার পর রাতের আঁধারে প্রকল্পের রাস্তার কাজ শুরু করেছে। এই রাস্তায় গত ছয় মাসেও কোন ধরণের কাজ হয়নি’।

মোক্তারপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) ও প্রকল্পের চেয়ারম্যান মোফাজ্জল হোসেন খানের মোবাইল ফোনে একাধিক বার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

মোক্তারপুর শিংলাব মামলা হওয়ার পর রাতের আঁধারে রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে (২৯ জুন রাতে)।

মোক্তারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম সরকার (তুরন) বলেন, ‘প্রকল্পে বরাদ্দকৃত ৬০ ভাগ গম বিক্রি করে রাস্তার কাজ করা হয়েছে। গম জব্দের বিষয়ে মামলা চলমান’।

কালীগঞ্জ খাদ্য গুদাম থেকে উত্তোলন করা সরকারি পণ্য বিক্রির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট এর সদস্য মঞ্জুর হোসেন বলেন, ‘র‌্যাবের হাতে জব্দ হওয়া গম সরাসরি বিক্রি করেছে। আমাদের মাধ্যমে নয়’।

মোক্তারপুর শিংলাব মামলা হওয়ার পর রাস্তার কাজ শুরু হয়েছে (২ জুলাই)।

গমের ছাড়পত্রে উল্লেখ রয়েছে, ‘বরাদ্দকৃত খাদ্যশষ্য স্থানীয় খাদ্য গুদাম থেকে উত্তোলন করে নির্ধারিত স্থানে গুদামে মজুদ করে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে অবহিত করতে হবে এবং প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করে প্রাক্কলন অনুযায়ী সম্পাদনা করে প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে কাজের বিপরীতে মাস্টাররোলের মাধ্যমে খাদ্যশষ্য বিতরণ করে সাত দিনের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিরীক্ষার জন্য খাদ্যশষ্যের মাস্টাররোল/বাউচারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরে দাখিল করতে হবে’।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই গম উত্তোলনের ছাড়পত্র পেয়েছে। কাজ না করেই সরকারি গম উত্তোলন করা হয়েছে এবং উত্তোলন করা গম আত্মসাতের উদ্দেশে কালোবাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়ার পথে র‌্যাবের হাতে জব্দ হয়েছে। এরপর কাজ শুরু করে বলে অভিযোগ উঠেছে জড়িত দুই ইউপি সদস্যর বিরুদ্ধে। এখন কাজের বিপরীতে মাস্টাররোলের মাধ্যমে খাদ্যশষ্য বিতরণ করে সাত দিনের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিরীক্ষার জন্য খাদ্যশষ্যের মাস্টাররোল/বাউচারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার দপ্তরে দাখিল করার কোন সুযোগ নেই। এরপরও কাজ চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার সহযোগিতা ব্যাতীত এসব কিছুই সম্ভব নয়।

গাজীপুর সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব কালীগঞ্জ) মোঃ ইশতিয়াক হোসাইন উজ্জল বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করে নিয়ম অনুযায়ী গম উত্তোলনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে’।

কাজ না করেই সরকারি গম উত্তোলন করে আত্মসাতের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী বরাদ্দের ৬০ ভাগ গম বিক্রি করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও মামলার পর কাজ শুরুর বিষয়ে তিনি বলেন, কাজ চলমান রয়েছে সমস্যার কিছু নেই’।

তদন্ত কমিটির প্রধান কালীগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীনা আক্তার বলেন, ‘শুক্রবার (৩ জুলাই) প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেছি। সাত কর্মদিবসের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে’।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শিবলী সাদিক বলেন, ‘ঘটনা তদন্তে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

উল্লেখ্য: গত ২৭ জুন (শনিবার) কালীগঞ্জ খাদ্য গুদাম থেকে জাঙ্গালিয়ার দুই প্রকল্পে মোট ১২.৭৫ মে: টন এবং মোক্তারপুরের প্রকল্পের ৪ মে: টনসহ মোট ১৭.২৫ মে: টন উত্তোলন করে আত্মসাতের উদ্দেশে কালোবাজারে বিক্রির জন্য ট্রাকে করে টাঙ্গাইলে নিয়ে যাওয়ার পথে ২৭ জুন শনিবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে নাওজোড় বাইপাস মোড় থেকে ট্রাকে ভর্তি ৩৪০ বস্তা সরকারি গম (ওজন ১৭.২৫ মে: টন) জব্দ করে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় র‌্যাব-১-এর সদস্যরা। পরে ওই ঘটনায় ২৭ জুন (শনিবার) রাতে বাসন থানায় গ্রেপ্তার দু’জন এবং জড়িত কালীগঞ্জের জাঙ্গালিয়া ইউপির ২ নম্বর সদস্য (মেম্বার) দেলোয়ার হোসেন দর্জি এবং মোক্তারপুর ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোফজ্জল হোসেন খান মেম্বারের বিরুদ্ধে র‌্যাব-১-এর এক সদস্য বাদী হয়ে ‘১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫/২৫-ডি ধারা’ অনুযায়ী একটি মামলা দায়ের করেন (মামলা নাম্বার ১৮(৬)২০)।

 

আরো জানতে………..

কাবিখা’র ১৭ টন গম জব্দ: কালীগঞ্জের দুই ইউপি মেম্বারসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে র‌্যাবের মামলা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button