গাজীপুর

কালীগঞ্জে নথিপত্র যাচাই-বাছাই ছাড়াই একজনের জমি নামজারি হচ্ছে অন্যজনের নামে!

নিজস্ব সংবাদদাতা : জমিজমা নিয়ে হয়রানি কমাতে সরকার ভূমিসেবা ডিজিটালাইজেশনসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও কালীগঞ্জের ভূমি অফিসগুলোর সর্ষের ভূত কিছুতেই যাচ্ছে না। দালাল ও কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজসে একজনের জমি বিক্রি করে ফেলছেন আরেকজন। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেকর্ডভুক্ত না হলেও সেই দলিলের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই ছাড়াই একজনের জমি নামজারি হয়ে যাচ্ছে অন্যের নামে। এতে করে ভোগান্তিতে পড়েছেন জমির মূল মালিকরা। প্রতিকার চাইতে যেতে হচ্ছে আদালত পর্যন্ত। আর এসব কারণে সরকারের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মামলা জট কমাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে আদালতের বিচারকদের।

অপরদিকে হয়রানির পাশাপাশি অর্থ ও সময়ের অপচয় হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। এসকল কাজে জড়িত রয়েছে ভূমি অফিসের দালাল, কতিপয় দুর্নীতিগ্রস্থ অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাই খুব সহজেই জালিয়াতি চক্রের সদস্যরা জাল দলিল ও নথিপত্রের মাধ্যমে নামজারি থেকে শুরু করে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ করা পর্যন্ত সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারছে নির্বিঘ্নেই।

যদিও নামজারি মঞ্জুর করার পূর্বে বেশ কয়েকটি ধাপে নথিপত্র যাচাই-বাছাই করার বিধান রয়েছে। প্রতি ধাপেই নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে থাকেন সরকারের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরপরও জাল নথিপত্রের মাধ্যমেই সম্প্রতি কালীগঞ্জ এসিল্যান্ড অফিসে নামজারির আবেদন করার পর নামজারি মঞ্জুর করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরপর নতুন হোল্ডিং (জোত) খুলে খাজনাও পরিশোধ করা হয়েছে।

এরমধ্যে জাল দলিল দিয়ে দুইটি এবং জাল নথিপত্রের মাধ্যমে একটি নামজারি অনুমোদন করা হয়েছে।

সম্প্রতি অনুমোদন হওয়া তিনটি নামজারির নথিপত্র পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।

এছাড়াও জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে জমি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গাজীপুর আদালতে মামলা এবং নামজারি বাতিলের আবেদন জানিয়ে মিসকেস করতে এসি ল্যান্ড অফিসে আবেদন করেছেন ভুক্তভোগীরা।

জাল দলিলের মাধ্যমে জমি রেজিস্ট্রি ও নামজারি

ঘটনা-১
সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৮ জুন কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের গলান মৌজার আর এস ৪২, ৪৩ ও ৪৪ দাগে ২৬ শতাংশ জমি মোসাঃ সাবিকুন নাহার নামে এক নারীর নামে নামজারি করার জন্য আবেদন জমা হয় উপজেলা ভূমি অফিসে। পরবর্তীতে ১৮ জুলাই খসড়া খতিয়ান প্রস্তুত করে নামজারি আবেদন মঞ্জুর করার জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে প্রস্তাব (সুপারিশ) পাঠায় নাগরী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (নায়েব) আব্দুল লতিফ মিয়া। এরপর সকল নথিপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ১৯ জুলাই উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো আবুল বাশার নামজারি চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দপ্তরে পাঠায়। পরবর্তীতে ২৪ জুলাই নামজারি আবেদন মঞ্জুর করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীন আক্তার (নথি নম্বর-৭৩৯৭/২১-২২)। এরপর সরকারি নির্ধারিত ডিসিআর ফি ১১০০ টাকা পরিশোধ করা হয় ২৫ জুলাই। পরবর্তীতে আবেদনকারীর নামে নতুন হোল্ডিং/জোত (১০১৬) সৃজন করেন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (নায়েব)।

জানা গেছে, নামজারি আবেদনের সময় জমির মালিকানা সংক্রান্ত দুটি দলিলের সার্টিফাইড কপি, জমির খসড়া পর্চা ও আবেদনকারী জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দেয়া হয়েছে। এসকল নথিপত্র সম্পূর্ণ জাল দাবি করে গত ৭ নভেম্বর গাজীপুর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে মামলার আবেদন করেন গলান এলাকার শুক্কুর আলী (৪৩)।

আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইখলাস উদ্দীন বাদীর অভিযোগ আমলে নিয়ে ঘটনা তদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দিয়েছেন।

মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে, গলান এলাকার মৃত হাকিম উদ্দিনের স্ত্রী মোসা: ফজিলা আক্তার (৬৫), মেয়ে মোসা: সাবিকুন নাহার (৪০), আব্দুল সালামের ছেলে আব্দুল সাত্তার, বাগদী এলাকার হারুন রশিদ, উলুখোলা এলাকার আজহারুল ইসলাম, রায়েরদিয়া গায়েন বাড়ি এলাকার মোতাহার হোসেন এবং উত্তর সোম এলাকার আব্দুল আউয়ালের ছেলে শামীমকে (৩৫)।

মামলার আবেদন ও ভূমি অফিসে দাখিল করা নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, অভিযুক্ত সাবিকুন নাহারের নামে নামজারি করার সময় জমা দেয়া দুইটি দলিলের মধ্যে প্রথমটি ২০০২ সালের ৫ নভেম্বর কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সম্পাদন হয়েছে। ওই দলিলটি হেবার ঘোষণা দলিল হিসেবে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে (দলিল নম্বর ৭৫৪১)। দলিলে দাতা হিসেবে দেখানো হয়েছে নাগরী ইউনিয়নের গলান এলাকার হাকিম উদ্দিন গলান মৌজার আর এস ৪২, ৪৩ ও ৪৪ দাগে থাকা ২৬ শতাংশ জমির রেকর্ডীয় মালিক। গ্রহীতা তার স্ত্রী মোসা: ফজিলা আকতারকে ২৬ শতাংশ জমি হেবাবেল এওয়াজ দলিল রেজিস্ট্রি করে দেন। ওই দলিলে মালিক হয়ে পরবর্তীতে ২০২২ সালের ২২ জুন ফজিলা আকতার তার মেয়ে সাবিকুন নাহারকে ওই ২৬ শতাংশ জমি হেবার ঘোষণার মাধ্যমে দলিল রেজিস্ট্রি করে দেন (দলিল নম্বর ৭০১৫)। বিষয়টি জানাজানি হলে উল্লেখিত দলিলের অনুলিপি (নকল) সংগ্রহ করেন বাদী শুক্কুর আলী। পরবর্তীতে দেখা যায় প্রথম সম্পাদন করা দলিলের নম্বর ঠিক থাকলেও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেকর্ডভুক্ত অন্য সকল তথ্য ভিন্ন। হেবা দলিলের স্থলে সাফ-কবলা দলিল রয়েছে। দাতা-গ্রহীতা এবং মৌজাও ভিন্ন। এতে করে প্রমাণিত হয় যে প্রথম দলিলটি জালিয়াতির মাধ্যমে সৃজন করে পরবর্তীতে ওই দলিল দেখিয়ে পরের দলিলটি সম্পাদন করা হয়েছে। আর ওই দলিল দিয়েই নামজারি করা হয়েছে।

এরপর শুক্কুর আলী বাদী হয়ে আদালতে জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর ৪৮২/২২)।

বাদী পক্ষের আইনজীবী আল আমিন মিয়া বলেন, আদালতের নির্দেশে মামলাটি বর্তমানে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গাজীপুর তদন্ত করছে। আগামী ২২ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য করেছেন আদালত।

ঘটনা ২

প্রথম ঘটনার মতোই দ্বিতীয় ঘটনাও একই কৌশলে ঘটিয়েছে একই চক্রের সদস্যরা। কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সিল স্বাক্ষর জাল করে প্রথমে ২০০২ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখ উল্লেখ করে একটি বেল হেবা এওয়াজ দলিল সৃজন করা হয় (দলিল নম্বর ৮৩৫৭)। ওই দলিলে গলান মৌজার ৯.২৫ শতাংশ এবং টেক মানিকপুর মৌজার ৫ শতাংশ মিলে মোট ১৪.২৫ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি দেখানো হয়েছে। দাতা হিসেবে হাকিম উদ্দিন ও গ্রহীতা ফজিলা আকতারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা সেই একই ব্যক্তি।

যদিও ওই দলিলের অনুলিপি (নকল) সংগ্রহের পরও দেখা গেছে পূর্বের মতোই দাতা, গ্রহীতা ও মৌজা ভিন্ন। ওই দলিল দিয়েও একই কৌশলে গত ২১ আগস্টে কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ফজিলা আকতার হেবার ঘোষণার মাধ্যমে তার মেয়ে সাবিকুন নাহারকে জমি হস্তান্তর করেছেন (দলিল নম্বর ৯১৮৯)।

পরবর্তীতে ২৭ আগষ্ট এ জাল দলিল ও নথিপত্রের মাধ্যমে গলান মৌজার আর এস ৪০ ও ৩২ দাগে ৯.২৫ শতাংশ জমি নামজারি করার জন্য ভূমি অফিসে আবেদন করা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর খসড়া খতিয়ান প্রস্তুত করে নামজারি আবেদন মঞ্জুর করার জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে প্রস্তাব (সুপারিশ) পাঠায় নাগরী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (নায়েব) আব্দুল লতিফ মিয়া। এরপর সকল নথিপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ১৬ অক্টোবর কানুনগো আবুল বাশার নামজারি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দপ্তরে পাঠায়। পরবর্তীতে ১৯ অক্টোবর নামজারি আবেদন মঞ্জুর করেন‌ সহকারী কমিশনার (ভূমি) উম্মে হাফসা নাদিয়া (নথি নম্বর-৭৬৯/২২,২৩)। এরপর সরকারি নির্ধারিত ডিসিআর ফি ১১০০ টাকা পরিশোধ করা হয় ২৫ অক্টোবর। পরবর্তীতে আবেদনকারীর নামে নতুন হোল্ডিং/জোত (১০২৮) সৃজন করেন ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা।

আরো জানা গেছে, জাল দলিলের মাধ্যমে জমির মালিক সাজানো ফজিলা আকতার তার মেয়ে সাবিকুন নাহারকে হেবার ঘোষণা দেয়া দলিল দু’টোই সম্পাদন করেছেন কালীগঞ্জ দলিল লেখক সমিতির সদস্য উজ্জ্বল ফ্রান্সিস রোজারিও (সনদ নং ৯/২০১২)। সনাক্তকারী হিসেবে রয়েছে উত্তর সোম এলাকার আব্দুল আউয়ালের ছেলে শামীম।

এছাড়াও নামজারির আবেদন দু’টির একটিতেও সাবিকুন নাহারের মোবাইল নম্বর ব্যাবহার করা হয়নি। একটিতে ব্যবহার করা হয়েছে দলিল লেখক উজ্জ্বল ফ্রান্সিস রোজারিওর ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর। অপরটিতে ব্যবহার করা হয়েছে কালীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসের কম্পিউটার অপারেটর মনির হোসেনের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর।

দলিল দু’টোই রেজিস্ট্রি করেছেন কালীগঞ্জ উপজেলা-সাব রেজিস্ট্রার খন্দকার গোলাম কবির।

অভিযুক্ত সাবিকুন নাহারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

দলিল লেখক উজ্জ্বল ফ্রান্সিস রোজারিও বলেন, দাতা-গৃহীতা দলিলের যে কপি এনেছিল তা দেখে জাল দলিল বলে ধারণা করা সম্ভব নয়। এছাড়াও অন্য সকল নথিপত্র যাচাই করেই দলিল সম্পাদন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে দলিল করার সময় আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

নামজারির বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক সময় জমির মালিকদের অনুরোধে নামজারির বিষয়ে সহায়তায় করে থাকি। তাই আমার মোবাইল নম্বর দিয়েই সাবিকুন নাহারের নামজারি আবেদন করা হয়েছিল।

কালীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসের কম্পিউটার অপারেটর মনির হোসেন বলেন, অনলাইনে নামজারির জন্য আবেদন করার সময় মোবাইলে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) নম্বর যায়। তাৎক্ষণিক ওই ওটিপি নম্বর অনলাইনে ইনপুট করতে হয়। তাই অনেক সময় আমাদের নম্বর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তাই হয়তো ওই আবেদনে আমার নম্বর রয়েছে। যদিও বিষয়টি আমার এখন স্মরণে নেই।

নাগরী ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তৎকালীন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা (নায়েব) আব্দুল লতিফ মিয়া বলেন, জাল দলিল বা নথিপত্রের মাধ্যমে নামজারি করার কোন সুযোগ নেই। তবু যদি এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে ভুক্তভোগীদের মিসকেস করার সুযোগ রয়েছে। তখন বিষয়টি পূণরায় যাচাই-বাছাই করা হবে।

জাল দলিলের মাধ্যমে জমি রেজিস্ট্রির বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার খন্দকার গোলাম কবিরের‌ দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জালিয়াতি ও অন্যের ছবি ব্যবহার করে নামজারি

ঘটনা তিন

কালীগঞ্জের‌ তুমুলিয়া ইউনিয়নের টিউরী এলাকার বাসিন্দা আমজাদ হোসেন কাঞ্চন দেশ ছেড়ে চলে গেছেন‌ প্রায় ৪০ বছর আগে। বর্তমানে তিনি পাকিস্তানের করাচি শহরে সপরিবারে বসবাস করেন‌ বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। সম্প্রতি তার নামে টিউরী মৌজার আর এস ৪৫৫ দাগে ৭.৬৬ শতাংশ জমির নামজারি মঞ্জুর হয়।

যদিও জাল নথিপত্রের মাধ্যমে নামজারি করতে আবেদন করা হয়েছে এমন তথ্য জানিয়ে নামজারি মঞ্জুর করার পূর্বেই আমাজত হোসেন কাঞ্চনের পক্ষে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। তবুও নামজারি মঞ্জুর হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২০ সালের ১৬ মে তুমুলিয়ার টিউরী মৌজার আর এস ৪৫৫ দাগে ৭.৬৬ শতাংশ জমি নামজারি করার জন্য আবেদন জমা হয় উপজেলা ভূমি অফিসে। পরবর্তীতে খসড়া খতিয়ান প্রস্তুত করে উপজেলা ভূমি অফিসে প্রস্তাব পাঠায় তুমুলিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম। এরপর ১৮ জুলাই কানুনগো আবুল বাশার নথিপত্র পর্যালোচনা করে নামজারি মঞ্জুর করার জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) দপ্তরে পাঠান। ওই দিনই নামজারি আবেদন মঞ্জুর করেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহিনা আক্তার (নথি নম্বর-৬৪৭৪/২১,২২)। এরপর যথারীতি সরকারি নির্ধারিত ফি ১১’শ টাকা পরিশোধ করা হয়। পরে আমজাদ হোসেন কাঞ্চনের নামে নতুন হোল্ডিং/জোত (৫৪৭) সৃজন করেন উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম।

নামজারি আবেদনের সঙ্গে জমা দেয়া নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আমজাদ হোসেন ভূঁইয়া কাঞ্চনের নামে ২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি তুমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামের স্বাক্ষরিত ইস্যু করা ১৬ সংখ্যার একটি জন্ম নিবন্ধন জমা দেয়া হয়েছে। যার নিবন্ধন বই নাম্বার ০৬, নিবন্ধন নম্বর ০৩০৫৬।জন্ম নিবন্ধন নম্বর (১৬ সংখ্যার) ১৯৬৩৩৩১৩৪৯৭০৩০৫৬, জন্ম তারিখ ১-১২-১৯৬৩।

এছাড়াও আবেদনে যে ছবি জমা দেয়া হয়েছে তা আমজাদ হোসেন ভূঁইয়া কাঞ্চনের নয় বলে শনাক্ত করেছেন তিনি নিজেই।

জানা গেছে, বর্তমানে সকল জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও নামজারির করতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে। বিশেষ কারণে জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দিতে ব্যর্থ হলে জন্ম নিবন্ধন দেয়া হয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই হালনাগাদ এবং অনলাইনে ইস্যু করা নিবন্ধন জমা দিতে হয়। বর্তমানে সকল বৈধ জন্ম নিবন্ধনের নম্বর ১৭ সংখ্যার হয়ে থাকে এবং সকল তথ্য অনলাইন সার্ভারে সংরক্ষিত থাকে। যা যাচাই করা সম্ভব যে কারো পক্ষেই।

নামজারি আবেদনের সঙ্গে জমা দেয়া জন্ম নিবন্ধন অনলাইনে যাচাই করতে চাইলে সার্ভারে থেকে জানানো হয় কোন তথ্য সংরক্ষিত নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মৃত বা বিদেশী নাগরিকের নামে বাংলাদেশে জন্ম নিবন্ধন ইস্যু করা বেআইনি। এছাড়াও মৃত বা বিদেশী নাগরিকের নামে জমির নামজারি করাও কোন সুযোগ নেই আইনে।

জাল নথিপত্রের মাধ্যমে নামজারি করা আবেদনে দেয়া মোবাইল নম্বরের সূত্রে জানা গেছে ওই মোবাইল নম্বরটি স্থানীয় নাঈম ভূঁইয়া নামে এক ব্যক্তির।

আরো জানা গেছে, পাকিস্তানি নাগরিকের নামে তার অনুপস্থিতে হওয়া নামজারি আবেদনের সঙ্গে জমা দেয়া জন্ম নিবন্ধনে ১৬ সংখ্যা নম্বর উল্লেখ থাকলেও একটি “০” বাড়িয়ে তা ১৭ সংখ্যা দেখিয়ে অনলাইনে নামজারির আবেদনে দাখিল করা হয়েছে। কারণ অনলাইনে নামজারি আবেদন করতে হলে সার্ভারে জন্ম নিবন্ধনের ১৭ সংখ্যা ইনপুট না করলে আবদেন‌ দাখিল করা সম্ভব হয় না।

অপরদিকে, ওই নামজারি আবেদন বাতিলের জন্য গত ১১ নভেম্বর এসিল্যান্ড অফিসে মিসকেস করতে আবেদন করেছেন জমির মালিক দাবিদার দেলোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তি। পরবর্তীতে ওই আবেদন আমলে নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে তুমুলিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা তাজুল ইসলামকে নির্দেশ দিয়েছেন এসিল্যান্ড।

এরপর ঘটনা তদন্তের জন্য গত ২৮ ডিসেম্বর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে জমির নথিপত্র সহ হাজির হতে আমজাদ হোসেন কাঞ্চনের নামে একটি চিঠি ইস্যু করেন‌ উপ-সহকারী ভূমি কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম।

আমজাদ হোসেন কাঞ্চনের স্বজনরা বলছেন, নথিপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে আমজাদ হোসেন কাঞ্চনের নামে জমির নামজারি করার জন্য ২০২০ সালের ১৬ মে উপজেলা ভূমি অফিসে আবেদন জমা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে গত ২৩ জুন নামজারির নথি নম্বর উল্লেখ করে এসিল্যান্ড অফিসে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। এরপরও নামজারি আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে। জানা গেছে, লাখ টাকার বেশি অর্থ ঘুষের বিনিময়ে তুমুলিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম ওই নামজারি মঞ্জুর করতে সহায়তা করেছেন।

বর্তমানে পাকিস্তানের বসবাসরত আমজাদ হোসেন কাঞ্চনের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি প্রায় ৪০ বছর যাবত পাকিস্তানে বসবাস করছি। সম্প্রতি নথিপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে আমার নামে জমি নামজারি করার জন্য কালীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসে আবেদন জমা হলে আমার স্বজনরা বিষয়টি আমাকে জানায়। পরে ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে নামজারির নথি নম্বর সংগ্রহ করে আমার বোনের ছেলে পিয়ার গত ২৩ জুন নামজারির নথি নম্বর-৬৪৭৪/২১,২২ উল্লেখ করে এসিল্যান্ড ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে। এরপরও কি করে নামজারি মঞ্জুর করা হয়েছে তা জানা নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি, এক লাখ টাকার বেশি টাকা ঘুষের বিনিময়ে তুমুলিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম ওই নামজারি মঞ্জুর করতে সহায়তা করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কালীগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিসের একাধিক সেবা গ্রহীতা বলেন, কালীগঞ্জের প্রতিটি ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা ব্যতীতও একাধিক দালাল রয়েছে। তারা সার্বক্ষণিক ভূমি অফিসে অবস্থান করেন এবং জমি সংক্রান্ত সরকারি বিভিন্ন নথিপত্র উন্মুক্ত অবস্থাতেই ব্যবহার করে থাকে। দালাল আর ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলেমিশেই অর্থের বিনিময়ে জাল নথিপত্রে নামজারি দেয়াসহ বিভিন্ন অনৈতিক সেবা দিয়ে থাকেন।

অর্থ লেনদেনের বিষয়টি অস্বীকার করে তুমুলিয়া ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম বলেছেন, উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে এবং সম্মতির ভিত্তিতেই নামজারি আবেদন মঞ্জুর করা হয়েছে।

জাল নিবন্ধন ও‌ অন্যের ছবি ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, আবেদনকারী যা জমা দিয়েছেন‌ তা দিয়েই নামজারি মঞ্জুর করা হয়েছে। সকল নথিপত্র সব সময় চেক করা সম্ভব হয় না।

কালীগঞ্জ উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো আবুল বাশার বলেন, আদালতের রায় ব্যতিত দলিল জাল এমনটা বলার কোন বিধান নেই। এছাড়াও জাল নথিপত্রের মাধ্যমে নামজারি করার কোন সুযোগ নেই। তবু এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটে থাকলে তা যাচাই-বাছাই করে স্বপ্রণোদিত হয়ে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

কালীগঞ্জ উপজেলার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহিনা আক্তার বলেন, নায়েব, সার্ভেয়ার ও কানুনগো সকল নথিপত্র যাচাই করে প্রস্তাব দেয়ার পর নামজারি মঞ্জুর করা হয়ে থাকে। এরপরও যদি কেউ জাল দলিল বা নথিপত্রের মাধ্যমে আবেদন করে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অবহিত করা হবে।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলেন (ইউএনও) আসসাদিকজামান ও বর্তমানে ছুটিতে থাকা কালীগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) উম্মে হাফসা নাদিয়ার বক্তব্য জানতে তাদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।

 

আরো জানতে…………

গাজীপুরের কৃষিজমি রক্ষায় ডিসির উদ্যোগ, সাব-রেজিস্ট্রারদের চিঠি

কালীগঞ্জে ‘সরকারি জমি বন্ধক’ রেখে ৬৭ লাখ টাকা ঋণ, বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিক্রির চেষ্টায় ব্যাংক!

কালীগঞ্জে চার কোম্পানির দখলে ‘শীতলক্ষ্যার ১৫ একর জমি’, উদ্ধারের দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ!

কালীগঞ্জে শীতলক্ষ্যার ৩ একর জমি ভরসা গ্রুপের দখলে

সেভেন রিংস সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ফসলি জমিতে, নদীর পাড় দখল করে সম্প্রসারণ

কালীগঞ্জে ‘ইকো পার্কের’ নির্ধারিত সরকারি জমি অবৈধ দখলে, পাহারায় আনসার নিযুক্ত!

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button