কালীগঞ্জে ‘ইকো পার্কের’ নির্ধারিত সরকারি জমি অবৈধ দখলে, পাহারায় আনসার নিযুক্ত!
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কালীগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ‘ইকো পার্ক’ নির্মাণের জন্য নির্ধারিত সরকারি জমি অবৈধভাবে দখলে নিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে পাহারা দেয়ার জন্য আনসার সদস্য নিযুক্ত করেছে ‘আবুল খায়ের গ্রুপ’।
২০১৯ সালের ৮ জুলাই (সোমবার) কালীগঞ্জ পৌরসভার দড়িসোম মৌজার প্রায় সাড়ে ৫ বিঘা সরকারি জমিতে ‘ইকো পার্ক’ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু এর কিছুদিন না যেতেই সেই জমি দখলে নেয় ‘আবুল খায়ের গ্রুপ’।
সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, অবৈধভাবে ‘আবুল খায়ের গ্রুপের’ দখলে থাকা কালীগঞ্জ পৌরসভার দড়িসোম মৌজার ১ নং খতিয়ান ভুক্ত আরএস ৪৭ দাগের ১ একর ৭৩ শতাংশ (প্রায় সাড়ে ৫ বিঘা) সরকারি জমিতে ২০১৯ সালের ২ জুলাই (মঙ্গলবার) দুপুরে উচ্ছেদ অভিযান পরিচলনা করে অবৈধ দখলদার মুক্ত করেন কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. শিবলী সাদিক। পরবর্তীতে ওই জমিতে লাল নিশানা টানিয়ে সরকারি দখল নিশ্চিত করা হয়। এর পাঁচ দিন পর ৮ জুলাই (সোমবার) শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী সরকারি ওই জমি পরিদর্শন করে তাতে ইকো পার্ক নির্মাণের ঘোষণা দেন গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস. এম. তরিকুল ইসলাম। পরে ওই জমি থেকে গাছপালা ও আগাছা কেটে পরিষ্কার করা হয়’।
সরেজমিন ঘুরে ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ‘কালীগঞ্জ খেয়া ঘাট সংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ‘ইকো পার্ক’ নির্মাণের ঘোষণা দেয়ার কিছুদিন না যেতেই সেই জমি আবারও দখলে নেয় ‘আবুল খায়ের গ্রুপ’। বর্তমানে ওই জমিতে গাছপালা ও আগাছা জন্মে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। পার্কের জন্য নির্ধারিত জমির দু’দিকে টিনের শেড দিয়ে প্রাচীর নির্মাণ করে দখলে রেখেছে আবুল খায়ের গ্রুপ। এছাড়াও প্রাচীরের ভেতরে টিন দিয়ে ছোট একটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। অবৈধভাবে দখলে নেয়া ১ একর ৭৩ শতাংশ (প্রায় সাড়ে ৫ বিঘা) সরকারি জমি ওই ঘরে বসেই পালাক্রমে পাহারা দেয় আবুল খায়ের গ্রুপে নিযুক্ত আনসার সদস্যরা।
স্থানীয়রা জানায়, ‘এক সময় এ জমি কৃষি কাজে ব্যবহৃত হতো। ওই জমি অবৈধভাবে দখলে নিয়ে নদীর কিছু অংশসহ বরাট করে ফেলেছে আবুল খায়ের গ্রুপ’।
স্থানীয় ভূমি অফিস ও ভূমি সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, ‘কালীগঞ্জ পৌরসভার বালিগাঁও মৌজায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এলাকায় অনুমানিক প্রায ৮০ একর ‘ফসলি’ জমিতে গড়ে উঠেছে আবুল খায়ের গ্রুপ লিমিটেড এর কয়েকটি ফ্যাক্টরি। এর মধ্যে রয়েছে ১ নং খতিয়ানভুক্ত আর এস ২০৮৭ নং দাগে ৪৫ শতাংশের একটি হালটসহ প্রায় ৩ একর সিকস্তি ভূমি যা ‘সম্পূর্ণ সরকারি সম্পত্তি’ তাদের দখলে রয়েছে। এছাড়াও প্রায় আরো ১ একর নদী দখল করে বরাট করেছে কোম্পানিটি। কিন্তু কোম্পানির নামে মাত্র ৬ একর ১৪.৪ শতাংশ জমি নামজারি করে অফিসিয়াল সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছে আবুল খায়ের গ্রুপ’।
‘সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করার উদ্দেশেই কোম্পানিটি সকল জমি নামজারি করছে না। এছাড়াও সকল জমি কোম্পানিটির নিজস্ব না হওয়ায় এবং ফসলি, সরকারি ও নদীর জমি থাকায় নামজারি করাও আইন অনুযায়ী বৈধ নয় বলে জানান ভূমি সংশ্লিষ্টরা’।
কালীগঞ্জে নিযুক্ত আবুল খায়ের গ্রুপের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য বলেন, ‘কালীগঞ্জ খেয়া ঘাট সংলগ্ন শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী এলাকায় থাকা ওই জমিসহ আবুল খায়ের গ্রুপের নির্মিত অন্যান্য স্থাপনা পাহারা দেয়ার জন্য সার্বক্ষণিক দুইজন আনসার সদস্য ও একজন নিরাপত্তাকর্মী নিযুক্ত থাকেন। তারা পালাক্রমে ৮ ঘন্টা করে পাহারার দায়িত্বে থাকেন’।
কালীগঞ্জে আবুল খায়ের গ্রুপের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের প্রধান প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) আব্দুল মান্নান বলেন, ‘কালীগঞ্জে আবুল খায়ের গ্রুপের নিরাপত্তায় আমাদের এক প্লাটুন (৩৫ জন) সদস্য নিয়োজিত রয়েছে। এর মধ্য শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী রাণীর চয়েজ এলাকায় পোস্ট নং ১০-এ সার্বক্ষণিক দুইজন আনসার সদস্য নিযুক্ত থাকেন। তারা পালাক্রমে ৮ ঘন্টা করে পাহারার দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি জমি দখলের বিষয়টি আমার জানা নেই’।
কালীগঞ্জে নিযুক্ত আবুল খায়ের গ্রুপের সার্ভেয়ার মো: মশিউর বলেন, ‘শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী দড়িসোম মৌজার ওই জমি কোম্পানির দখলে রয়েছে। কিন্তু মালিকানা সংক্রান্ত কোন তথ্য আমার জানা নেই’।
কালীগঞ্জ পৌর ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা দ্বীপক কুমার সাহা বলেন, বর্তমানে ওই জমি সরকারি দখলেই রয়েছে। তবে জমির দু’দিকে টিনের শেড দিয়ে প্রাচীর নির্মাণ ও প্রাচীরের ভেতরে থাকা ঘরের বিষয়ে তিনি বলেন, তা যে কোন সময় ভেঙ্গে ফেলা হবে।
কালীগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহিনা আক্তার বলেন, ‘সরকারি জমি দখলমুক্ত করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। খোঁজ নিয়ে দড়িসোম মৌজায় থাকা সরকারি ওই জমির বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।
উল্লেখ্য : ‘কালীগঞ্জ পৌরসভার বালিগাঁও মৌজায় থাকা শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী (ফোরশোর) জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করার অভিযোগে চলতি বছরের ২১ আগস্ট (শনিবার) মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন’ অনুযায়ী আবুল খায়ের গ্রুপকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করেছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৌধুরী মুস্তাফিজুর রহমান। এছাড়াও অবৈধভাবে নির্মিত ওই স্থাপনা অভিযানের দিন থেকে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে অপসারণ করে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কাছ থেকে ‘কোনো খাস জমি দখলে নেই’ এই মর্মে প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়’।
এর আগে ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি ‘নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে শীতলক্ষ্যা নদীর কালীগঞ্জ অংশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে নদীর জমিতে স্থাপিত আবুল খায়ের গ্রুপের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করছিল বিআইডব্লিউটিএ’।
এছাড়াও ‘২০১৮ সালের ৩ মার্চে দিনে দুপুরে অবৈধ গজারী গাছের পাইলিং দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী দখলের অভিযোগ উঠেছিল আবুল খায়ের গ্রুপের বিরুদ্ধে। এরপর ওইদিনই সরকারি সম্পদ দখল ও অপব্যবহারের অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রাথমিকভাবে তাদের কাজ বন্ধ করেছিলেন কালীগঞ্জ উপজেলার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) সোহাগ হোসেন’।
প্রসঙ্গত : বিনোদন প্রিয় কালীগঞ্জবাসীর জন্য উপজেলা সদর ও পৌর এলাকায় নেই কোনো বিনোদন কেন্দ্র। বন্ধ হয়ে গেছে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা কয়েকটি সিনেমা হল। এ কারণে এলাকাবাসী রেলস্টেশন, নদীর পাড় এবং ঘোড়াশাল রেল ও সড়ক সেতুকেই বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছে।
শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা কালীগঞ্জ পৌর এলাকা জুড়ে সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কোনো বিনোদন কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি।
আরো জানতে…..
বিনোদন প্রিয় কালীগঞ্জবাসীর জন্য নেই কোনো বিনোদন কেন্দ্র!
শীতলক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী জমি দখল: ‘আবুল খায়ের গ্রুপ’কে ২ লাখ টাকা জরিমানা
দিনে দুপুরে নদী দখলের অভিযোগ ‘আবুল খায়ের গ্রুপ’র বিরুদ্ধে
কালীগঞ্জে চার কোম্পানির দখলে ‘শীতলক্ষ্যার ১৫ একর জমি’, উদ্ধারের দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ!
সেভেন রিংস সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ফসলি জমিতে, নদীর পাড় দখল করে সম্প্রসারণ
কালীগঞ্জে শীতলক্ষ্যার ৩ একর জমি ভরসা গ্রুপের দখলে