রদবদলের গুঞ্জন মন্ত্রিসভায়
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : নতুন বছরে নতুন চমক দিতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মন্ত্রিসভায় রদবদলের সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। বাস্তবায়ন হলে সেটাও হবে চলমান শুদ্ধি অভিযানেরই অংশ। ১১ মাস বয়সী এ সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা এক ধরনের বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন। বিশেষ করে শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা সাধারণ মানুষ তথা ভোক্তাদের ভাষা বুঝতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
কৃষিবান্ধব, ভোক্তাবান্ধব, শিল্পবান্ধব পরিবেশ নেই বললেই চলে। সংশ্লিষ্টদের সীমাহীন ব্যর্থতার কারণে কৃষি ক্ষেত্রে ধস নেমেছে, স্থবির রয়েছে শিল্পাঙ্গন এবং সর্বশেষ পেঁয়াজ ও চালের দাম বৃদ্ধি, লবণের গুজব- সব মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায় এড়াতে পারছেন না।
চলতি মাসের ২০ ও ২১ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে বড় ধরনের রদবদল ঘটতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতোমধ্যেই মিলছে তেমন আভাস। দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর কাউন্সিল শেষে আসছে সর্বশেষ অধ্যায়। বিগত কয়েক মাসের ধারাবাহিকতায় এখানেও চমক ও চটক দেখাতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ কাউন্সিলের পরই আসবে সরকারে ‘শুদ্ধি অভিযান’। চলমান শুদ্ধি অভিযানের প্রতিফলন যেভাবে ঘটেছে কাউন্সিলে, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের পর সরকারেও ঘটতে পারে এমন প্রতিফলন। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিশুদ্ধি ঘটানো হবে মন্ত্রিসভায়।
আগামী মাসে অর্থাৎ নতুন বছরে সরকার এক বছর পূর্ণ করবে। বিগত এক বছরকে যদি হানিমুন পিরিয়ড হিসেবে ধরা হয়, তারপরই আসবে হিসাব নিকাশের পালা। কী হয়েছে বিগত দিনে, কী থেকে গেল বাকি, আগামীর জন্য অবশ্য পালনীয় কী। বাস্তবতার কঠিন মাটিতে পা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা এ দেশের মাটি-মানুষের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ- সেটার বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ বারবারই দিয়েছেন। নতুন বছরের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেওয়া চমকে কেউ উদ্দীপিত হতে পারেন আবার কাউকে হতে হবে আশাহত। মন্ত্রিত্ব ধরে রাখার জন্য কেউ কেউ যেমন সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন, অন্যদিকে পদবঞ্চিতরাও রয়েছে প্রত্যাশায়। যারা কোনো পক্ষেই নেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে নীরব চমক!
সরকারের বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করার সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে পুরোনো ও পরীক্ষিত নেতাদের।
সরকারের অদৃশ্য কোপানলে রয়েছেন কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। বিশেষ করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির মন্ত্রণালয় পরিচালনায় দুর্বলতার বিষয়ে সরকার থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত হতাশ। পেঁয়াজের দামে বিশ্বরেকর্ড, গুজব ছড়িয়ে লবণ কেলেঙ্কারি রোধ করতে না পারা, সর্বশেষ ভরা মৌসুমেও চালের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি জন্ম দিয়েছে অনেক প্রশ্নের। বাণিজ্যমন্ত্রী পরোক্ষভাবে নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে সম্প্রতি জানিয়েছেন, তিনি পদত্যাগ করলে যদি পেঁয়াজের মূল্য কমে, পদত্যাগ করতে এক সেকেন্ডও লাগবে না!
চিনি ও লবণের গায়ে ‘রাজনীতির গন্ধ’ লেগেছে অনেক আগেই। সম্প্রতি পেঁয়াজও সেই তালিকায় যুক্ত হলো। সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারা, মজুদদারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে না পারায়ও দেশে-বিদেশে সমালোচিত হয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। জলে স্থলে অন্তরীক্ষে নানা কায়দায় পেঁয়াজ আমদানি করা হলেও শেষ পর্যন্ত রোখা যায়নি পাগলা ঘোড়াকে। এখনও অবিশ্বাস্যভাবে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা কেজিতে। টিপু মুনশির স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ- এমন গুঞ্জন রয়েছে।
বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, রদবদলের অংশ হিসেবে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাককে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদারকে দেওয়া হতে পারে অন্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। ড. আবদুর রাজ্জাকের স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী (এলজিআরডি) তাজুল ইসলামকে সরিয়ে সেখানে সাবেক এলজিআরডিমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। তাজুল ইসলাম পেতে পারেন অন্য কোনো দফতরের দায়িত্ব।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলীকে পূর্ণ মন্ত্রী করা হতে পারে। পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে প্রতিমন্ত্রী করার সম্ভাবনা রয়েছে। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুককে পরিবর্তন না-ও করা হতে পারে এমন আভাস মিলছে। অন্যদিকে নওফেল পদোন্নতি পেলেও থেকে যেতে পারেন একই মন্ত্রণালয়ে।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ব্যর্থ মন্ত্রীদের তালিকায় প্রথম সারিতেই রয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন রোহিঙ্গা ইস্যুর সুরাহা করতে পারা, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে সমালোচিত। সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজনে রয়েছেন। প্রবাসী কল্যাণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেননি ইমরান আহমেদ। প্রতিমন্ত্রী থেকে পূর্ণমন্ত্রীর মর্যাদা পেলেও তার দায়িত্ব পালনে হেরফের হয়নি খুব একটা।
সম্প্রতি সৌদি আরবে একের পর এক নারী শ্রমিকদের ওপর যৌন নিপীড়নের অভিযোগ বেকায়দায় ফেলেছে সরকারকে। গৃহায়ন ও গণপূর্ণমন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ ও অগ্নিঝুঁকির সুরাহায় বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেননি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনতে না পারা ও ব্যাংকসহ বিভিন্ন অর্থখাতে লেজেগোবরে অবস্থার জন্য সমালোচিত। বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী মাহবুব আলী সাম্প্রতিক নানা কীর্তিকলাপ, বিমানে লোকসানের পরিমাণ কমাতে না পারায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
সারা দেশে ডেঙ্গুজ্বর মহামারী আকারে ছড়ালেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সমালোচিত। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে মন্ত্রী হিসেবে উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে না পারার। এ ছাড়াও সমালোচিতদের তালিকায় রয়েছেন- পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, ধর্মমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ।
সরকারের গুড বুকে থাকা মন্ত্রীর সংখ্যাও কম নয়। সফল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. দীপুমনি, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান প্রমুখ।
আওয়ামী লীগের নির্ভরশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, যে নেতাকর্মীরা সরকারে আছেন আবার দলেও আছেন, এদের নিয়ে আসা হবে যে কোনো একটি পদে। সেক্ষেত্রে বর্তমান ওবায়দুল কাদের যদি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে। পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজে দুর্নীতির যে অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে অপসারণ করা হয়েছে, পরবর্তীকালে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ধারণা করা হচ্ছে, সৈয়দ আবুল হোসেনকে আবার পদায়ন করা হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকারের প্রথম বছরকে মেঘলা সকাল হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতির চরম অবনতি, ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শেয়ারবাজারে ধস, গণপিটুনিতে মানুষ হত্যা, বরগুনায় রিফাত শরীফ, ফেনীর নুসরাত জাহান রাফি, বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যা সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছে। সব মিলিয়ে সংশ্লিষ্টদের ‘পুরস্কার ও তিরস্কার’ দেওয়ার আয়োজন করছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
নেতাকর্মীদের পারফরমেন্স ও আমলনামার ভিত্তিতেই আসছে নতুন সিদ্ধান্ত। ঢেলে সাজানো হতে পারে মন্ত্রিসভাকে। এতে প্রতিমন্ত্রী যেমন পূর্ণ মন্ত্রী হতে পারেন, অন্যদিকে মন্ত্রীরাও বদবদল হয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে যেতে পারেন, এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে নতুন পুরাতন কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী। সরকারের ভাবমূর্তি ফেরাতে প্রধানমন্ত্রী কঠোর অবস্থানে রয়েছেন।
প্রয়োজনীয় যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হবেন না তিনি। অল্প কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হবে। তার আগেই প্রধানমন্ত্রী বড়সড় একটা ঝাঁকুনি দিতে চান। এ ঝাঁকুনিতে ‘চিটা’ ঝরে গিয়ে থেকে যাবে সত্যিকারের ‘ফল’। এক বছরের পরীক্ষা শেষ হলো, এবার ফলাফল প্রকাশ তথা পাস-ফেল নির্ধারণের পালা!
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৫ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী, ৩ জন উপমন্ত্রী নিয়ে বর্তমান সরকারের যাত্রা শুরু হয় চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি থেকে।
সূত্র: খোলা কাগজ