রোহিঙ্গা শিবিরে সহিংসতা: ইয়াবা ব্যবসাই কি মূল কারণ?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অপরাধ কর্মকাণ্ড দিন দিন বাড়ছে বলে নানা পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে।
শনিবার রাতে টেকনাফের নয়াপাড়া ক্যাম্পে গতরাতে রোহিঙ্গাদের দুটি গ্রুপের গোলাগুলিতে অন্তত একজন নিহত হওয়ার পর প্রশ্ন উঠছে, একসঙ্গে এতগুলো নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি ও কড়া নজরদারী সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র পৌঁছচ্ছে কীভাবে?
ডাকাত গ্যাং ও ইয়াবার ব্যবসা
পুলিশ বলছে টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে শনিবার রাতের গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে দুটি ‘ডাকাত’ দলের মধ্যে। তারা বলছেন, কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে বেশ কটি ‘গ্যাং’ গড়ে উঠেছে।
পুলিশের ভাষ্যমতে, এই সব সশস্ত্র অপরাধী দলের মধ্যে রয়েছে প্রায় বছর তিরিশ আগে আসা হাকিম ডাকাত গ্যাং-এর নাম। নতুন গড়ে উঠেছে ‘জকির ডাকাত গ্রুপ’। এছাড়া রয়েছে ছলিম গ্রুপ।
বলা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের এসব গ্যাংগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের কক্সবাজারের অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা র্যাব ১৫’র অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, এসবের কেন্দ্রে রয়েছে নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবার ব্যবসা ও তার টাকা ভাগাভাগি। ।
তিনি বলেছেন, “এখানে কিছু কিছু ডাকাত গ্রুপ আছে যারা ইয়াবার ব্যবসার সাথে জড়িত। রোহিঙ্গারা নিজেরা নিজেরা যখন মারামারি করে তখন এই ইয়াবার ব্যবসার টাকা-পয়সা ভাগাভাগি নিয়েই বেশিরভাগ মারামারি করে এবং আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে।”
“এছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কিছু বাজার আছে। সেখানে দোকান থেকে ওরা চাঁদাবাজি করে। তারা বিভিন্ন গ্রুপের নাম দিয়ে টাকা পয়সা সংগ্রহ করে। সেটাও তাদের নিজেদের মধ্যে কলহের একটি কারণ।”
তাদের হাতে অস্ত্র কিভাবে পৌঁছচ্ছে?
বিবিসির এই প্রশ্নের জবাবে র্যাবের ঐ কর্মকর্তা বলেন, “গত তিরিশ বছর ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আছে। যাদের বয়স তিরিশের নিচে এদের মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা আছে যাদের জন্মই বাংলাদেশে। তারা অন্যান্য অনেক বাংলাদেশিদের মতো অপরাধের সাতে জড়িত। বাংলাদেশি যারা ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের সাথেও এদের সম্পর্ক রয়েছে।”
কক্সবাজারে সবমিলিয়ে ৩৩ টি রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে যেখানে এগারো লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাস। বিশ্বের সবচাইতে বড় শরণার্থী শিবির এখন উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প।
র্যাবের কর্মকর্তা উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলছেন, এর মধ্যে নয়াপাড়া ক্যাম্পে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসী কার্যক্রম হচ্ছে।
রোহিঙ্গারা ইয়াবা চোরাচালান ছাড়াও মানব পাচার ও ডাকাতি সহ নানা ধরনের অপরাধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোকে ঘিরে নিরাপত্তার কাজে জড়িত রয়েছে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। একসঙ্গে এতগুলো বাহিনীর উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও কিভাবে রোহিঙ্গারা এত অপরাধী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে?
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বিবিসিকে বলেন, “সব জায়গায় পাহারা শক্ত নয়। এখানে যেসব সন্ত্রাসী গ্রুপ আছে তারা পাহাড়ে থাকে। পাহাড় থেকে নেমে এসে এই কাজগুলো করে। তারা ক্যাম্পে অবস্থান করে না।”
তিনি আরও বলছেন, ক্যাম্পগুলোর চারদিকে খোলা, ফলে ইচ্ছে করলেই যে কেউ কোনো কোনো দিক দিয়ে বের হতে ও ঢুকতে পারে। “এই সুযোগটা অনেক সময় ওরা নেয়।”
তিনি বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর শরণার্থী শিবিরের অবস্থা তুলনা করে বলছিলেন, “আপনি যদি বিশ্বের অন্যান্য যায়গায় যে ক্যাম্পগুলো আছে সেগুলো একটা সংরক্ষিত যায়গায় থাকে। চারদিকে বেড়া থাকে। বিভিন্নভাবে তাদের আটকানোর একটা ব্যবস্থা আছে। আমাদের সেটা নাই।”
পুলিশের ঐ কর্মকর্তা আরও বলছেন, তাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ক্যাম্পের ভেতরে যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। বেশিরভাগ যায়গায় কোন রাস্তা নেই। যে রাস্তা আছে সেগুলো উঁচুনিচু মাটির রাস্তা।
“আমাদের কিছু লিমিটেশন আছে। ক্যাম্পের ভেতর পর্যাপ্ত রোড না থাকায় কোনো ঘটনা ঘটলে বা কোন খবর পেলে আমরা যানবাহন নিয়ে যে ঢুকে সেখানে যাবো সেটা আমরা পারি না।”
এছাড়া ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাদের অনুপাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জনবল সংকটের কথাও বলছিলেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড ঠেকাতে কী করা হচ্ছে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গত দুই বছরে ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে অন্তত ৪৫টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুক-যুদ্ধে আরও ৩২ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।
র্যাবের উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলছেন, “হেলিকপ্টার দিয়ে আমরা ওদের আস্তানাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আমরা ড্রোনের মাধ্যমেও তাদের পজিশন বা পাহাড়ে তাদের আস্তানা খুঁজে বের করার জন্য। এই জিনিসগুলো দেখার জন্য আমরা একটা রেকি করেছি। যাতে আমাদের একটা আইডিয়া হয়েছে। কিছু জায়গা আমরা চিহ্নিত করেছি।”
একজন অপরাধবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ
রোহিঙ্গাদের সবাইকে সরকার তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা করলেও অনেকেই মূলধারার জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছেন।
রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সরকার শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা এই জনগোষ্ঠী বিশ্বব্যাপী শরণার্থী হিসেবেই চিহ্নিত এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর সহযোগিতা ও সহানুভূতি তাদের প্রতি রয়েছে।
এসব কারণে রোহিঙ্গাদের অপরাধী কর্মকাণ্ডের জন্য আইনের আওতায় আনা কিছুটা জটিল, বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খন্দকার ফারজানা রহমান, যিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করেছেন।
তার মতে, “রোহিঙ্গারা এমন একটা জায়গা থেকে এসেছে, এমন একটা নির্যাতন, নিপীড়নের মধ্যে থেকে এসেছে যে সাইকোলজিক্যালি তারা এক ধরনের কনফ্লিক্ট ক্যারি করে। তাদের মধ্যে অনেক ধরনের ট্রমা ডিপ্রেশন কাজ করে। এই ধরনের নেগেটিভ ইমোশন থাকলে সেখানে আনুপাতিক হারে সেখানে অপরাধ বেশি হবেই। আপনি যদি ১৯৩০ সালের শিকাগোর ইতিহাস পড়ে দেখেন, সেখানেও একই জিনিস ঘটেছিলো। সেখানে ইমিগ্র্যান্টরা আসার পরে তাদের এত নেগেটিভ ইমোশন্স ছিল যে সেখানে ক্রাইম রেট বেড়ে গিয়েছিলো।”
তিনি আরও মনে করেন, “বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। মিয়ানমারেও সেটা হয়েছে, আমরা বাংলাদেশেও রাজনৈতিক গেইন আবার কখনো অর্থনৈতিক কারণে তাদের ব্যবহার করছি”
তিনি বলছেন, “রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ হলে, প্রথমে তাদের নিজস্ব একটা ব্যবস্থা আছে, তারা তাদের নিজেদের এই পদ্ধতিতে সেটার ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু বড় ধরনের সহিংস অপরাধ হলে অবশ্য তাদের বাংলাদেশে আইনের আওতায় বিচার হয়।”
কিন্তু স্থানীয়দের জায়গা-জমি, জীবিকা এক অর্থে দখল করে নেয়া এবং তাদের জীবনযাত্রায় বড় প্রভাব রাখছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। সেই সাথে অপরাধী কর্মকাণ্ডের জন্য স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলছেন।
সূত্র: বিবিসি