অন্যান্য

রামমোহনের রাজা উপাধি লাভ ও বিলাতে দিল্লির বাদশাহর দূতিয়ালি

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : রামমোহনের মৃত্যুর পর ১৬০ বছরেরও বেশি অতিক্রান্ত হয়েছে। জীবদ্দশায় তার ভাগ্যে জুটেছিল বহু বিতর্ক এবং তীব্র সমালোচনা। এর মূল কারণ ছিল সংস্কারবিরোধী ‘নো-চেঞ্জার’দের যূথবদ্ধ প্রতিকূলতা। সেই যুগে প্রগতিকামীদের সংখ্যা যে নেহাত অপ্রতুল, তা বলাই বাহুল্য। শুধু রক্ষণশীল স্বদেশবাসীরাই তার বিরোধিতায় অগ্রণী ছিলেন তা নয়; সে সময়ে এ দেশে খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারকরাও তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারে আশোভনভাবে উদ্যোগী ছিলেন। রামমোহনের বিরুদ্ধে যারা মিথ্যা প্রচারে কোমর বেঁধে নেমেছিলেন, তারা যুক্তি আর সাক্ষ্যপ্রমাণের ওপর যতটুকু না নির্ভরশীল ছিলেন, তার চেয়ে বেশি ছিলেন নিজেদের চিরাচরিত বিশ্বাস ও সংস্কার সম্পর্কে। রামমোহন ছিলেন প্রখর যুক্তিবাদী, সুতরাং তার সমর্থকরা যদি সংখ্যালঘু হয়ে থাকেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

যুক্তি ব্যতীত আর যে অস্ত্রটি রামমোহনবিরোধীরা তার বিরুদ্ধে জোরালোভাবে প্রয়োগ করতে পারতেন তা হলো, তথ্যের সমারোহ। পরবর্তীকালে অবশ্য তথ্যের স্বল্পতা দূর করা সম্ভব হয়েছিল, তখন থেকেই রামমোহন নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে মূল্যায়িত হতে শুরু করলেন। ততদিনে উনিশ শতক প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।

বিশ শতকে শুরু হলো নতুনভাবে রামমোহন-চর্চা। এখানেও হাজির হলো পরস্পরবিরোধী দুটি দৃষ্টিভঙ্গি। একদলের চোখে রামমোহন ছিলেন নতুন যুগের অগ্রদূত এবং আধুনিকতার জনক। সাহসী, দৃঢ়চেতা এক বিশ্বপথিক।

কিন্তু কিছুদিন না যেতেই পাশাপাশি দেখা গেল আরেকটি মতবাদ, যার বক্তব্য—‘রামমোহনের মূল্যায়নে তাকে তার যথার্থ প্রাপ্যের অধিক স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।’

গবেষকদের অভিমত, মতবাদের এ ধরনের বিভিন্নতা থেকে রামমোহনের অসাধারণতাই প্রমাণিত হয়!

সাধারণ মানুষের মূল্য সাধারণ মাপকাঠিতেই হয়ে থাকে। কিন্তু অসাধারণের ক্ষেত্রে একটি সর্বমান্য নির্দিষ্ট মাপকাঠি প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, সঙ্গতও নয়। রামমোহনকে নিয়ে মতভেদ তার অসামান্যতারই পরিচয় তুলে ধরেছে। এখানে একটি যুক্তি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে রামমোহন গবেষকদের বিশ্বাস। আর সেটি হলো, মূল্যায়নের আগে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা। রামমোহন সম্পৃক্ত কাগুজে তথ্য প্রধানত ইংরেজি, আরবি-ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় লেখা গ্রন্থ-প্রবন্ধ, অনুবাদ-নিবন্ধ ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে আরেকটি মূল্যবান উৎস, তার কাছে লেখা চিঠিপত্র অথবা তার নিজের পত্রাবলি। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে চিঠিপত্রের সন্ধান চলছে, তার প্রমাণ প্রথম পাওয়া যায় সোফিয়া ডবসন কলেটের বিখ্যাত গ্রন্থ The life and letters of raja ram mohon roy-এ, সোফিয়া ডবসন কলেটের সংগৃহীত পত্রাবলির তালিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও অসম্পূর্ণ—এ-জাতীয় সূত্রে ভিত্তি করে রামমোহনের জীবন ও কার্যকলাপ সম্পর্কিত বহু তথ্যই শুধু উদ্ঘাটিত হয়নি; রামমোহনের চিন্তাধারা, ধ্যান-ধারণা সম্পর্কেও এ ধরনের সূত্র থেকে তথ্য পাওয়া সম্ভব, কিন্তু পরিতাপের বিষয় সূত্র হিসেবে রামমোহনের চিঠিপত্রের উল্লেখ পেলেও পুরো চিঠিপত্রের গোটা বয়ান এখনো আমাদের নাগালের বাইরে।

প্রবীণ অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাস দীর্ঘ দশক ধরে রামমোহনের কাছে লেখা এবং রামমোহনের লেখা চিঠিপত্রের সন্ধান, সংগ্রহ এবং যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে রামমোহন গবেষণার পথ প্রশস্ত করে চলেছেন। তার সিদ্ধান্ত—আরো চিঠিপত্র এখনো সন্ধানের অপেক্ষায় রয়েছে, এখন পর্যন্ত সংগৃহীত বাংলা ও উর্দু ভাষায় লেখা পত্র সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়।

পারস্যের সঙ্গে চিঠিপত্র বিনিময়ের কথা রামমোহন স্বয়ং উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তার সন্ধান এখনো অনাবিষ্কৃত। উল্লেখ্য, রামমোহন নিজে চিঠিপত্র লেখা সম্পর্কে প্রবল উৎসাহী ছিলেন এবং এখন পর্যন্ত যেসব চিঠিপত্র পাওয়া গেছে, তা সামগ্রিক পত্রাবলির সামান্য অংশমাত্র।

ইতিহাসের উপাদান হিসেবে চিঠিপত্রের গুরুত্ব সহজেই বোধগম্য। সাধারণত পত্রলেখক চিঠিতে স্পষ্ট এবং খোলা ভাষায় মনের ভাবটি প্রকাশ করতে ইতস্তত করেন না। চিঠিতেই পাওয়া যায় তার মনের সন্ধান, চিন্তার গতি-প্রকৃতির; তার প্রত্যয় ও মতবাদের বিশ্লেষণ। রামমোহন যাদের উদ্দেশে চিঠি লিখেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতের বড়লাট, অধস্তন রাজপুরুষ, প্রাচ্যবিদ্যার সুপণ্ডিত ব্যক্তি, সাংবাদিক, শিক্ষা ও সমাজসংস্কারক বিষয়ে আগ্রহী ব্যক্তিরা। এছাড়া সমকালীন সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছিল বহু পত্র। বিলাতের উচ্চতম কর্তৃপক্ষের কাছে লেখা আবেদনপত্রও স্থান লাভ করেছে তার পত্রভাণ্ডারে। বেশির ভাগ চিঠিতেই ধরা পড়েছে তত্কালীন প্রথা, রীতিনীতি সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট মতবাদ, শিক্ষা ও সমাজ রাজনীতি বিষয়ে তার মতাদর্শ। এমনকি প্রচলিত অর্থনীতি ও শাসননীতির সমালোচনা।

আমাদের আজকের প্রবন্ধ অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাসের সংকলিত রামমোহনের পত্রাবলির বিশ্লেষণ বা মূল্যায়ন নয়। এসব চিঠিপত্রের সূত্রেই আমরা জানতে পারি কোন পটভূমিকায় এবং কী কারণে দিল্লির বাদশাহ শাহ আলম রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে তার দূত হিসেবে বিলাতের রাজদরবারে পাঠিয়ে ছিলেন এবং তার মাধ্যমেই বাদশাহ তার প্রতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে অবিচার হয়েছে তার প্রতিকার প্রার্থনা করা ও সুবিচার আদায় করতে চেয়েছিলেন।

এখানে এটা স্পষ্ট রামমোহনকে কোনো দেশী বা বিদেশী প্রতিষ্ঠান, দেশীয় রাজা বা ইংরেজ সরকার তার মেধা ও প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে ‘রাজা’ উপাধি দেননি। তিনি রাজা উপাধি পান বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে। ভারতের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও বাদশাহর দেয়া ‘রাজা’ উপাধির স্বীকৃতি দেয়নি, যদিও কলকাতার কোম্পানির লাট-বেলাট সবারই রামমোহনের সঙ্গে সখ্য ছিল; সামাজিকভাবে যাতায়াত ছিল এবং তাদের মধ্যে নিয়মিত পত্রালাপের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষিত হতো। রামমোহন রায় বাদশাহর দূত হিসেবে সসম্মানে বিলাত পাড়ি দেন এবং কোম্পানির বিরোধিতা সত্ত্বেও বিলাতের প্রভাবশালী সরকারের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। এবং হাউজ অব কমন্সে সাদরে গৃহীত হন। আমাদের আজকের এ লেখায় ইতিহাসের এই স্বপ্নালোকিত অধ্যায়টি নিয়ে আলোচনা করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। রামমোহনের যেমন সব চিঠিপত্র পাওয়া যায়নি, তেমনি এই ‘দূত কাণ্ডটির’ও সব তথ্য হয়তো আমাদের এখন অধরা। সে কারণে আলোচনাটি স্বভাবত খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য।

রাজা রামমোহন রায়ের জীবনের প্রথম অংশের বিশেষ করে রংপুর, দিনাজপুরে বাসকালীন অংশের একটি অংশ এখনো অনালোকিত। তিনি বেশ কিছুদিন নাকি দেশ ভ্রমণে ব্রিটিশ ভারতের বাইরে গিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বাদশাহ শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে তথ্যের অভাবে কিছুু অংশ অস্পষ্ট রয়ে যেতে পারে। সেজন্য দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। তবে দৌত্যকর্মে রামমোহন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন এবং আংশিক সফলতা লাভ করেন। তার অকালমৃত্যুর কারণে তিনি এ ব্যাপারে আর অধিক এগোতে পারেননি।

দিল্লির তত্কালীন মোগল বাদশা হীনবল হলেও তিনি স্বয়ং বাদশা—বাদশা দ্বিতীয় আকবর। রামমোহনের ঔদার্যপূর্ণ জীবনযাত্রা ও আরবি-ফারসি জ্ঞানের সুনাম শুনেছিলেন। বাদশা তৈমুর বংশের উত্তরাধিকারী—এ আত্মমর্যাদাপূর্ণ পরিচয় কখনো ভুলতে পারেননি।

রামমোহন ১০ বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান হিসেবে রংপুরে ডিগবি সাহেবের কাজ করেছেন, তিনি ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত এবং ইংরেজি রীতিনীতি ও আদব-কায়দায় অভ্যস্ত। তার স্বভাবে বাঙালি হিন্দুর গোঁড়ামি অনুপস্থিত। অনেক গোঁড়া হিন্দু রামমোহন মুসলমানের সঙ্গে কলকাতায় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও মুসলিম পরিবেষ্টিত হয়ে থাকেন বলে রুষ্ট ছিলেন। বাদশাহ সেই সময় একজন শিক্ষিত, দক্ষ ও উদার মনোবৃত্তির মানুষকে তার দূত হিসেবে ইংল্যান্ডে রাজার কাছে পাঠানোর পরিকল্পনা করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ পরিবেশ অনুকূল হয়ে বাদশাহর মনোবাসনা পূরণ হওয়ার পথ সুগম হয়ে উঠল।

সতীদাহ প্রথা লোপ ও অন্যান্য সংস্কারের ব্যাপারে তখন দেশ-বিদেশে নানা রকম বাদানুবাদ চলছিল। বাংলার রক্ষণশীল সমাজ এ প্রথা রদ ঠেকানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। রামমোহন উপলব্ধি করেন যে সতীদাহ প্রথার সমর্থকরা (ইংল্যান্ডে) রাজা ও পার্লামেন্টে আবেদন জানাবে, তখন তিনি উপস্থিত থাকলে ব্রিটেনের কর্তৃপক্ষকে সোজাসুজি ব্যাখ্যা করার সুযোগ পাবেন। তিনি বুঝিয়ে বলতে পারবেন যে এই অমানবিক সতীদাহ প্রথার পেছনে কোনো ধর্মীয় অনুমোদন নেই। এছাড়া ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ‘চার্টার’-এর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তাই সে সময়ে পার্লামেন্টের সামনে ভারতবাসীর অধিকার ও সুবিধা রক্ষার প্রয়োজনের কথা তুলে ধরার জন্য তার চেয়ে যোগ্য ব্যক্তি আর কে হতে পারেন?

তার বিলাত যাওয়ার বাসনার সঙ্গে বাদশাহ দ্বিতীয় আকবরের পক্ষে দৌত্যকর্ম করার আবশ্যকতাও প্রায় একই সময়ে হাজির হয়। বাদশাহ তখন অর্থকষ্টে কাতর, সুচতুর ইংরেজ সন্ধিপত্রের চুক্তিকে নিজেদের অনুকূলে দুমড়ে-মুচড়ে নিয়ে এসে বাদশাহর বার্ষিক প্রাপ্যে হাত বসিয়েছে।

বাদশাহর প্রতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অবিচারের অভিযোগটি আদৌ মনগড়া ছিল না। চুক্তি সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করলেই কোম্পানির প্রতারণার বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আমাদের সূত্র ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় সংকলিত সম্পাদিত ‘সংবাদপত্রের সেকালের কথা’—দ্বিতীয় খণ্ড। গ্রন্থটিতে রামমোহন রায়ের দিল্লীশ্বরের দৌত্যকার্য থেকে শুরু করে তার ইংল্যান্ড ভ্রমণ এবং বাদশাহের দূত হিসেবে বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত এবং হাউজ অব কমন্সে বক্তৃতা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দক্ষ আলোচনায় বাদশাহর বৃত্তি বৃদ্ধিতে সফলতাসংক্রান্ত নানা সংবাদ বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

দিল্লির বাদশাহের অনুযোগের বিষয়ে ১১ জানুয়ারি ১৮৩২ সংবাদটি শুরু হচ্ছে এমনি ভাষায়, ‘লর্ড বেন্টিংক ও দিল্লীর বাদশাহ, বেন্টিংক সাহেব শ্রীযুত বড় সাহেব শ্রীযুত দ্বিতীয় আকবর শাহের সহিত সাক্ষাৎ না করিয়াই দিল্লী অতিক্রম করেন। ইংরেজি সংবাদপত্রে ইহার নানা কারণ ছাপান গিয়াছে কিন্তু তাহার কোন কারণ বিশ্বাস্য হয় না। ‘সংবাদ কণিকা মনে করেছে রামমোহন রায় ইংল্যান্ড দেশে বাদশাহের পক্ষে গভর্নমেন্টের এক ডিক্রীর আপীলের উদ্যোগ করিতেছেন।’

ওই একই বিষয়ে সেদিনের পত্রিকাটি যা লিখেছিল, তা নিচে উদ্ধৃত করা বাঞ্ছনীয় বিবেচনা করা হলো:

‘দিল্লীশ্বরের দৌত্যকার্য্যে রামমোহন

(১১ জানুয়ারি ১৮৩২। ২৮ পৌষ ১২৩৮)

কারণের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা যাহা অতিঅবিশ্বসনীয় তাহা এই যে শ্রীযুত বাবু রামমোহন রায় এইক্ষণে ইঙ্গলণ্ড দেশে শ্রীযুত বাদশাহের পক্ষে গবর্ণমেণ্টের এক ডিক্রীর আপীলের উদ্যোগ করিতেছেন। এই বিষয়ে আমারদিগের যেপর্য্যন্ত বোধ তাহাতে দৃষ্ট হয় যে দিল্লীর চতুর্দিগে বার্ষিক বার লক্ষ টাকা উৎপাদক জায়গীর দিল্লীর রাজপরিজনরদের ভরণপোষণার্থ নিযুক্ত হইয়াছিল। পরে গবর্ণমেণ্ট ঐ জায়গীরের সরবরাহ কর্ম্ম আপন হস্তে গ্রহণ করিয়া রাজবংশ্যেরদিগকে বার্ষিক নগদ বার লক্ষ টাকা করিয়া দিলেন। এইক্ষণে ঐ ভূমিতে অধিক টাকা উত্পন্ন হয় এবং তাহা ব্রিটিশ গর্বণমেণ্ট স্বহস্তে রাখিয়াছেন। বোধ হয় যে এই নিয়মের বিষয়ে শ্রীযুত বাদশাহ ইঙ্গলণ্ড দেশের রাজমন্ত্রিরদের প্রতি অভিযোগ করিয়াছেন।

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন গভর্নর জেনারেলকে একটি পত্র লিখে জানান যে দিল্লির মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাকে দূত নিযুক্ত করে গ্রেট ব্রিটেনের রাজদরবারে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাকে ‘রাজা’ উপাধি দান করেছেন।

রামমোহন এই আশা ব্যক্ত করেন, গভর্নর জেনারেলই তাকে এ উপাধি ব্যবহার করার অনুমতি দেবেন কিন্তু গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক তাকে দিল্লির সম্রাটের দূত হিসেবে স্বীকৃতি দেননি এবং ‘রাজা’ উপাধি ব্যবহার করতেও সম্মতি দান করেননি। কিন্তু ব্যক্তিগত স্তরে তাদের দুজনের সম্পর্ক এতটাই আন্তরিক ছিল যে বেন্টিংক খুশি মনেই রামমোহনকে বিলাতের বিশিষ্ট ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত করার উদ্দেশ্যে পত্র লিখেছেন। এর ফলে রামমোহনের যথেষ্ট সুবিধা হয়। ইংল্যান্ডে পৌঁছার পর তিনি নিজেকে দিল্লির দরবারে স্বীকৃত প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করেন এবং বিশ্বাস উৎপাদক পরিচয়পত্র দেখে তার দৌত্যকার্যে ব্রিটিশ সরকারও স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করেনি, যদিও লন্ডনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় কর্তারা এমন স্বীকৃতি লাভের পথে বহু কুযুক্তি খাড়া করেও সফলকাম হননি।

তবে রামমোহনের উপাধিবিভ্রাট যেন শেষ হয়েও শেষ হয় না! সমাচার দর্পণ যথেষ্ট মনোযোগ ও সতর্কতার সঙ্গে এ ব্যাপারে ইংরেজি পত্রপত্রিকার মনোভাবের ওপর নজর রেখে চলেছে তখন। সময়মতো পাঠকদের সর্বশেষ পরিস্থিতি অবগত করতেও সমাচার দর্পণ ছিল ক্লান্তিহীন। ২৫ মে, ১৮৩৩, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১২৪০ সমাচার দর্পণ বলেছে:

শ্রীযুত দিল্লীর বাদশাহকর্তৃক উপাধি প্রদান।—কএক সপ্তাহ হইল সংবাদপত্র পাঠ করিয়া অবগত হইলাম যে ব্রিটিস গবর্ণমেণ্টের অনুমতিব্যতিরেকে শ্রীযুত দিল্লীর বাদশাহ উপাধি প্রদান করাতে গবর্ণমেণ্ট কিঞ্চিদ্বিরক্ত হইয়াছেন। এইক্ষণে মফঃসল আকবর পত্রে তাহার সবিশেষ কিঞ্চিৎ জ্ঞাত হওয়া গেল।…

অপর ঐ পত্রে যে কথোপকথন প্রস্তাব লিখিত আছে তদ্বারা বোধ হয় যে শ্রীযুত রামমোহন রায়ের ইঙ্গলণ্ড দেশে গমনের উপরে শ্রীযুত দিল্লীর বাদশাহের অনেক নির্ভর আছে। তদ্বিষয় ঐ পত্রে লেখে যে ঐ রাজার প্রতিনিধিস্বরূপ এইক্ষণে লন্ডন নগরে বর্ত্তমান বাবু রামমোহন রায়ের বিষয়ে রাজদরবারে অনেক কথোপকথন উত্থাপিত হইল তাহাতে শ্রীযুত বাদশাহ কহিলেন যে রাজকর বৃদ্ধিবিষয়ক আজ্ঞা প্রকাশ হইলেই তাহাতে আমার দৃঢ় প্রত্যয় হইতে পারে পূর্ব্বে হইবে না। অতএব ইহাতে বোধ হইতেছে যে ব্রিটিস গবর্ণমেণ্ট কর্তৃক বাদশাহ যে বৃত্তি ভোগ করিতেছেন এইক্ষণে বাবু রামমোহন রায়ের দ্বারা তাহার বৃদ্ধির প্রতীক্ষায় আছেন।

অবশেষে রামমোহন রায়ের দক্ষতা ও তীক্ষ যুক্তি অবতারণায় বাদশার বৃত্তি বৃদ্ধির প্রতীক্ষার অবসান হলো।

(১০ আগস্ট ১৮৩৩। ২৭ শ্রাবণ ১২৪০)

শ্রীযুত দিল্লীর বাদশাহ।—মফঃসল আকবরের দ্বারা অবগত হওয়া গেল যে দিল্লীর শ্রীযুত রেসিডেণ্টসাহেব শ্রীযুত রাজা সোহনলালের সমভিব্যবহারে সংপ্রতি দিল্লীর শ্রীযুত বাদশাহের নিকটে উপস্থাপনপূর্ব্বক কহিলেন যে ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্ট আপনকার বৃত্তি বার্ষিক ৩ লক্ষ টাকা পর্য্যন্ত বর্দ্ধিত করিতে নিশ্চয় করিয়াছেন পরে ঐ সম্বাদসূচক যে পত্র প্রাপ্ত হইয়াছিলেন তাহা অনুবাদ করিয়া বাদশাহকে জ্ঞাপন করিলেন।

অতএব শ্রীযুত বাদশাহের উকীলস্বরূপ শ্রীযুত রাজা রামমোহন রায় যে বিলায়তে গমন করিয়াছেন তাঁহার যাত্রা নিষ্ফল কহা যাইতে পারে না বরং তাহাতে বাদশাহবংশ্যের উপকার দর্শিয়াছে।

এবার একটু পুরনো কথায় ফেরা যাক। ১৮৩১ সালের ১৫ নভেম্বর কলকাতা থেকে দ্য আলবিয়ান নামে জাহাজে চড়ে ৮ ডিসেম্বর লিভারপুল পৌঁছলেন রাজা রামমোহন। এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তার বিদেশ যাত্রাটাই রক্ষণশীল ভারতের প্রথাবিরোধী উদ্যোগ। কারণ তখন সমুদ্রযাত্রা ছিল নিষিদ্ধ। তার দুই বছরের ইংল্যান্ডবাসে রামমোহন ব্রিটেনের মননশীল ও অভিজাত শ্রেণীর ওপর গভীর ছাপ রাখতে পেরেছিলেন।

রামমোহন এই দুই বছর শুধু মোগল সম্রাটের রাজদূতের ভূমিকার চেয়ে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি হাউজ অব কমন্সের সম্মুখে সতীদাহ প্রথার পুনঃপ্রচলনের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রস্তাব/আবেদন পেশ করলেন।

নবাবি আমলের বিলোপ এবং ইংরেজ শাসনের প্রতিষ্ঠা বাংলার মানুষ ঠিক কী চোখে দেখেছিল, তা জানার উপায় নেই। এ যুগে ‘মহারাষ্ট্র পুরাণে’র মতো কাব্য লেখা হয়নি। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় সামান্য একটু ইঙ্গিত রয়েছে কিছুটা কাব্যিক ভাষায়—‘শীতের শেষ বিকেলের রোদের মত নবাবী আমল দেখিতে দেখিতে মিলাইয়া গেল।’ তবে এই পটপরিবর্তনের ফলে যে কলকাতার সাধারণ সমাজের স্থিতিস্থাপকতা ব্যাহত হয়েছিল, তা এই তাপ-উত্তাপহীন বাক্যে বোঝার উপায় নেই। ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় এর পরেই উল্লেখ আছে, এই নবাবি আমলের অবক্ষয়ে অনেক সাধারণ নিম্নশ্রেণীর ও নিম্ন আয়ের মানুষ হঠাৎ বিত্তবান হয়ে ওঠে এবং অনেক বুনিবাদি পরিবার হীনপ্রভ হয়ে পড়েছিল। এর সমর্থনে খানিক ইঙ্গিত মেলে রামমোহন রায়ের একটি চিঠিতে। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে রামমোহন রায় তার জনৈক ইংরেজ বন্ধুকে একখানি পত্রে নিতান্ত সংক্ষেপে আত্মচরিত লিখে পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠির বয়ান একটু বড় হলেও প্রাসঙ্গিকতা ও ঐতিহাসিক মূল্যের কারণে পুরো উদ্ধৃতিটি এখানে তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

তাতে তিনি লিখেছেন:

‘ষোড়শ বৎসর বয়সে’ (অর্থাৎ ১৭৮৮ বা ১৭৯০ সালে) ‘একান্ত আত্মীয়দিগের সহিত’ তাঁর ধর্মসম্বন্ধে ‘মনান্তর উপস্থিত হইলে’ তিনি ‘গৃহ-পরিত্যাগ পূর্বক দেশ ভ্রমণে প্রবৃত্ত’ হয়েছিলেন। ‘ভারতবর্ষের অন্তর্গত অনেকগুলি প্রদেশ ভ্রমণ’ করে ‘ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণাবশতঃ…’ ভারতবর্ষের বহির্ভূত অন্ততঃ একটি দেশে (সম্ভবতঃ তিব্বতে) তিনি ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি ‘ভারতবর্ষের অন্তর্গত’ কোন কোন প্রদেশে ‘ভ্রমণ’ করেন তা জানা যায় না। ‘ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণা’র কোন কারণ তিনি উল্লেখ করেননি। পরবর্তীকালে তাঁর মত পরিবর্তিত হয়েছিল। ‘তিনি ক্রমে বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, ইংরেজ শাসন হইতে ভারতের প্রভূত কল্যাণ উত্পন্ন হইবে।’

এসব কারণে এবং ইংরেজ ও ইউরোপীয় মূলধন ভারতে এনে ভারতকে সমৃদ্ধশালী করার ইচ্ছা ব্যক্ত করায় পরবর্তীতে অনেকেই তার তীব্র সমালোচনা করেছেন। কোনো কোনো সমালোচক এমনও বলেছেন যে রামমোহন বরাবরই ‘ইংরেজমুখো’ ছিলেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চার্টারে নবায়নের বিবেচনা করার জন্য হাউজ অব কমন্সে নির্বাচিত কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিতে আমন্ত্রিত হলেন তিনি। বোর্ড অব কন্ট্রোলের সঙ্গে পত্রালাপের মাধ্যমে ভারতের জনগণের অবস্থা, দেশের বিচার রীতি ও প্রণালি নিয়ে তিনি তার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করলেন। ১৮৩৩-এর চার্টার যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাণিজ্যিক সংস্থা থেকে প্রশাসনিক সংস্থায় পরিণত করেছিল, এর অনেকাংশই তার প্রয়াসের ফল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাকে নৈশভোজে আনুষ্ঠানিকভাবে নিমন্ত্রণ জানিয়েছে, এমনকি রাজা চতুর্থ জর্জের অভিষেকের সময় বৈদেশিক দূতের মধ্যে তার স্থান ছিল। রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের সঙ্গে এবং ১৮৩২ সালে প্যারিসে ফরাসি রাজা লুই ফিলিপের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাৎ হয়। দ্য রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটি ও ব্রিটিশ ইউটেরিয়ান সোসাইটি তাদের বিভিন্ন বার্ষিক অনুষ্ঠানে তাকে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।

রাজা রামমোহন রায় এত কিছুর মধ্যে দিল্লির বাদশাহর দৌত্যকর্মের কথা মোটেই বিস্মিত হননি। তিনি ভারত থেকে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে এসেছিলেন এবং ইংল্যান্ড ঘুরে বাদশাহর লেখা চিঠির একাধিক মুসাবিদা করছেন।

রামমোহন বাদশাহর হয়ে চতুর্থ জর্জকে যে আবেদনপত্র লিখেছিলেন, সেটি ছিল অনবদ্য। যেমন ভাষা সেই রকম যুক্তি সমাবেশ, ভাবগাম্ভীর্য। ‘তুলনাহীন এক নিবেদনে’ ইংল্যান্ডে পৌঁছেই রামমোহন রাজা চতুর্থ উইলিয়ামকে একটি চিঠি লিখলেন। মোগল বাদশাহের যাবতীয় দাবি ছেপে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালক ও ইংল্যান্ডের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে বিলি করে দিলেন। পাশাপাশি কাজের ফাঁকে ফাঁকে উপযুক্ত স্থানে তদবির চালিয়ে গেলেন। কৌতূহলী পাঠকরা রামমোহনের ইংরেজি ভাষায় লেখা বাদশাহর তরফের চিঠি পড়ে দেখতে পারেন। পত্রটি ইংরেজিতে ছাপা হয়েছে শনিবারের চিঠি, রামমোহন সংখ্যায়। রঞ্জন কুমার সম্পাদিত।

এরই সূত্র ধরে তিনি বোর্ড অব কন্ট্রোলের প্রেসিডেন্ট স্যার চার্লস গ্রান্টকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। বোর্ড অব ডাইরেক্টরদের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি দিল্লির সম্রাটের বার্ষিক ভাতা আরো ৩ লাখ বাড়িয়ে দিতে সম্মত হয়েছিলেন। ১ জানুয়ারি, ১৮৩৪ সমাচার দর্পণ এ সুসমাচার প্রকাশ করে।

(১ জানুয়ারি ১৮৩৪। ১৯ পৌষ ১২৪০)

রাজা রামমোহন রায়।—২০ আগস্ত তারিখে রাজা রামমোহন রায়ের এক পত্রে লেখে যে দিল্লীর শ্রীযুত বাদশাহের দরবারের খরচের নিমিত্ত এইক্ষণে বৎসরের যে ১২ লক্ষ টাকা দিতেছেন তদতিরিক্ত আর ৩ লক্ষ টাকা শ্রীযুত আনরবল কোর্ট অফ ডৈরেক্তর্স সাহেবেরা দিতে স্বীকৃত হইয়াছেন এইক্ষণেও রাজা রামমোহন রায়ের এই দাওয়া আছে যে তাঁহার বিলাতে গমনের খরচা কোম্পানি দেন।

রামমোহন রায় কিন্তু এই খণ্ডিত সাফল্যে অর্থাৎ আরো ৩ লাখ টাকা বাদশাহ অনুকূলে বৃদ্ধি পাওয়ায় খুব আত্মপ্রসাদ লাভ করেননি। ইংল্যান্ড থেকে বাদশাহকে পত্র লিখে রামমোহন এই অল্প ভাতা গ্রহণ করতে নিষেধ করেন, যাতে বাদশাহর পুরো দাবি গৃহীত হয় তার জন্য। তিনি আরো তদবির করবেন, সে কথা তিনি বাদশাহকে জানিয়ে দেন। কিন্তু মাত্র দুই মাস পরেই রামমোহনের মৃত্যু হওয়ায় বাদশাহকে এই সামান্য ভাতা বৃদ্ধিই মেনে নিতে হলো।

রাজা রামমোহন রায়ের আকস্মিক বিলাতে মৃত্যুর সংবাদ দিল্লির দরবারে পৌঁছলে শোক এবং অনিশ্চয়তার কালো ছায়া নেমে আসে। বর্ধিত ভাতা আদৌ পাওয়া যাবে কিনা, এ নিয়েও এক পর্যায়ে প্রবল সংশয় এবং ঘোরতর আশঙ্কায় দরবারের প্রায় সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। ৬ মার্চ, ১৮৩৪ দিল্লিতে এক খবর মারফত এ আশঙ্কা দূরীভূত হয়। সমাচার দর্পণে সংকলিত সংবাদটি নিচে উদ্ধৃত করা হলো:

(৫ মার্চ ১৮৩৪। ২৩ ফাল্গুন ১২৪০)

দিল্লী।—অবগত হওয়া গেল যে রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু সম্বাদ যখন দিল্লীর বাদশাহের দরবারে পঁহুছিল তখন দরবারস্থ তাবল্লোক একেবারে হতাশ হইলেন বিশেষতঃ শ্রীযুত যুবরাজ মির্জ্জা সিলিং ও তাঁহার পক্ষীয় লোকেরা কহিলেন যে ইঁহার উদ্যোগক্রমে আমারদের বার্ষিক যে তিন লক্ষ টাকা বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিল এইক্ষণে সে ভরসা গেল। কিন্তু তদ্বিষয়ে কিঞ্চিন্মাত্রও ভয় নাই যদ্যপি ব্রিটিস গবর্ণমেণ্ট উক্ত-সংখ্যক টাকা দিতে অঙ্গীকার করিয়া থাকেন তবে যে ব্যক্তির উদ্যোগে অঙ্গীকৃত হইয়াছিলেন এইক্ষণে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে বলিয়া কখন অপহ্নব করিবেন না।

সন্দেহ নেই রাজা রামমোহন রায় বিলাতে তার দেশের হিতের জন্য নানা যুগান্তকারী কার্যকলাপের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ভারতের জনগণের অঙ্গীকার এবং মর্যাদা রক্ষায় তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। এতসব কার্যাবলির মধ্যে তিনি কখনো মোগল বাদশাহের ন্যায্য দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকারকে তার কর্মসূচির তালিকার পেছন দিকে সরিয়ে রাখেননি। নানা বাধা-বিঘ্নকে তিনি তার প্রতিভার অস্ত্রে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিঘ্ন এসেছিল বিলিতি সমাজ থেকে কম, সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে ভারতের ইংরেজ প্রশাসককুল।

সমাচার দর্পণ (৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৭। ২৩ মাঘ ১২৪৩)

দিল্লীর শ্রীলশ্রীযুত বাদশাহের মুশাহেরা বৃদ্ধি।—উক্ত শ্রীযুক্ত বাদশাহের উকীল হইয়া প্রাপ্ত রামমোহন রায় ইঙ্গলণ্ডে গমন করিয়াছিলেন তিনি ঐ বাদশাহের মুশাহেরা মাসে ২৫০০০ অর্থাৎ বার্ষিক ৩ লক্ষ টাকা পর্য্যন্ত বৃদ্ধিকরণের চেষ্টা করিয়া তাহাতে কৃতকার্য্য হইয়া ছিলেন। অবগত হওয়া গেল যে উক্ত বাদশাহের মুশাহেরা বৃদ্ধিকরণের এই নিয়ম হইবে যে উত্তরকালে ঐ বাদশাহ বা তদীয় কোন পরিজন ইঙ্গলণ্ডীয় বাদশাহের প্রতি আর কোন দাওয়া না করেন। ইঙ্গলণ্ডীয় রাজকর্ম্মকারকেরা ৪ বৎসরঅবধি উক্ত প্রকার মুশাহেরা বৃদ্ধি স্থির করিয়াছেন কিন্তু অবগত হওয়া গেল যে কেবল বর্ত্তমান বৎসরের প্রথমেই তাহার দান আরম্ভ হইবে। দিল্লীর শ্রীযুক্ত বাদশাহ রামমোহন রায়ের সঙ্গে এই বন্দোবস্ত করিয়াছেন যে রাজবংশের নিমিত্ত যত টাকা বৃদ্ধি করিতে পারিবেন তাহার দশমাংশ আপনাকে ও আপনার পুত্র পৌত্রাদিক্রমে পরিবারকে দেওয়া যাইবে। এইক্ষণে রামমোহন রায়ের পুত্র দিল্লীতে এই অঙ্গীকৃত বিষয় সিদ্ধকরণের চেষ্টায় আছেন ভরসা হয় যে তাহাতে কৃতকার্য্য হইবেন।

পত্রিকার আরো একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘রাজার উত্তরাধিকারী শ্রীযুক্ত রাধা প্রসাদ রায় প্রতি মাসেই দিল্লি দরবারে উপস্থিত থাকেন কিন্তু তাহার প্রার্থনা সিদ্ধির কোনো চিহ্নই নেই। এই ক্ষণে বাদশাহের মরণাবস্থা হইয়াছে। তিনি মরিলে রাজার পরিবার একেবারেই নিরাকাঙ্খ হইবেন।’

বাদশাহর মৃত্যু এবং রামমোহনের আকস্মিক প্রয়াণের কারণে এ ব্যাপার নিয়ে খানিকটা অষ্পষ্টতা রয়ে গেছে। রামমোহন রায়ের উত্তরাধিকারীদের তরফ থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল বলে মনে করা যেতে পারে। তবে সুস্পষ্ট কিছু তথ্যপ্রমাণ এই লেখক খুঁজে পাননি। যদি কোনো আগ্রহী পাঠক এ সম্পর্কে কিছু তথ্যনিষ্ঠ আলোকপাত করেন, তবে সবাই উপকৃত হবেন।

দিল্লির বাদশাহের তরফ থেকে যে পত্রটি লেখা হয়েছিল কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ডেপুটি চেয়ারম্যানের কাছে, তাতে আবেদনপত্রের পরিশিষ্টে দিল্লির তদানীন্তন রেসিডেন্ট স্যার চার্লস মেটকাফের রিপোর্টের সত্যাসত্য সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তুলেছিলেন রামমোহন। সেই সঙ্গে আরো একটি দলিল দাখিল করা হয়েছিল—তার লেখক মেটকাফের পূর্ববর্তী রেসিডেন্ট (দিল্লির) আলেকজান্ডার রস। রস মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাদশাহের প্রতি কোম্পানির কর্তৃপক্ষ একাধিক বিষয়ে অবিচার করেছেন’—রামমোহনের এহেন অভিযোগের পুনরাবৃত্তি মেটকাফের পছন্দ হয়নি। এই ‘অপছন্দের’ কথা তিনি উল্লেখ করেছেন বড়লাট বেন্টিংকের কাছে লেখা চিঠিতে। এতে তিনি আরো লিখেছেন, ‘রামমোহনের মাধ্যমে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করা বিলাতের কর্তৃপক্ষের সঙ্গত হবে না।’ বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ভারত সরকারই যথেষ্ট। এ ব্যাপারটি আপাতদৃষ্টিতে একটু অস্পষ্ট মনে হয়েছে গবেষকদের। কারণ মেটকাফ শুধু তার স্বজাতিমহলেই নয়, ভারতীয় মহলেও প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তার উদারতার জন্য। (সূত্র দ্য করেসপনডেন্স অব রাজা রামমোহন রায়। সম্পাদক: দিলীপ কুমার বিশ্বাস, সারস্বত লাইব্রেরি কলকাতা।)

সমাচার দর্পণের বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে বাদশাহ-রামমোহন রায় সম্পর্কিত আরো একটি তথ্য নজরে এসেছে। সংবাদটির তারিখ ৫ জুন, ১৯৩৩। অকুস্থল দিল্লির বাদশাহের দরবার। বাদশাহের দুই প্রখ্যাত মন্ত্রী রাজা সোহনলাল এবং ওই দরবারের খোজা জাকুত আলী খাঁ পবন্দবের ঘোর বিরোধী। ‘সম্প্রতি এক দিবসে তাহারা বাদশাহের সম্মুখে পরস্পর কূটকাটব্য করিলেন। ঐ বিবাদে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হইতে পারে না… কিন্তু রাজা রামমোহন রায় বাদশাহের উকীলস্বরূপ ইঙ্গলণ্ড দেশে গমন সময় সত্তর হাজার ৭০,০০০ টাকা প্রাপ্ত হন এই কথা ঐ বিবাদকালেই প্রকাশ পায়।’ ওই বাদানুবাদের সময় খোজা সোহনলালকে উদ্দেশ করিয়া বলে ওঠেন, ‘তুমি বাদশাহের কী উপকার করিয়াছ—তুমি ৭০,০০০ টাকা ব্যয় করিয়া রামমোহন রায়কে বিলায়েত পাঠাইয়াছ বটে কিন্তু তাহাতেও কি ফলোদয় হইয়াছে?’ সমাচার দর্পণ লিখেছে, ‘রামমোহন রায় বিলাত গমনকালে বাদশাহের কাছে ৭০,০০০ টাকা পান কেবল এতদর্থেই আমরা ঐ বিবাদের প্রসঙ্গ করলাম।’

এ ব্যাপারটি নিয়েও যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। অন্য কোনো সূত্র থেকে এ পর্যন্ত রামমোহন রায়ের এমন অর্থপ্রাপ্তির স্পষ্ট তথ্য বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

গবেষক অমলেন্দু দে এক গ্রন্থ সমালোচনায় বলেন, ‘সমুদ্রপথে যাত্রার ও ইংল্যান্ডে থাকার ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজনে রামমোহন দিল্লির দরবার থেকে কোনো অগ্রিম বেতন গ্রহণ করেননি।’ কিন্তু সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ‘নবজাগরণের নায়কেরা’ গ্রন্থে লিখেছেন, দিল্লির দরবার থেকে রামমোহনকে ৭০ হাজার টাকা দেয়া হয়। (দেশ গ্রন্থলোক ৭ মার্চ ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১০৪)।

তিনি আরো বলেন, এমনকি সতীদাহ প্রথাবিরোধী সংগ্রামে যেসব উদারপন্থী বন্ধুরা তার পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ান, তাদের আর্থিক সাহায্য তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি এবং তার অন্য চার সঙ্গী ছিলেন, তাদের সব খরচ রামমোহন নিজেই বহন করেন। পাঁচ একর জমির তার যে বিশাল মানিকতলার বাড়ি ছিল, তা তিনি ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসের নিলামে বিক্রি করেন এবং তার যাবতীয় সম্পত্তিই পরিচালনার দায়িত্ব দেন মেসার্স ম্যাকিনটস অ্যান্ড কোম্পানি কলকাতা এবং মেসার্স রিকার্ডস ম্যাকিন্টস অ্যান্ড কোম্পানি লন্ডন নামের দুই হাউজকে। তাদের সঙ্গে এ ব্যবস্থা করা হয় যে তারা ইংল্যান্ডে রামমোহনের ব্যয় নির্বাহের জন্য নিয়মিত সুদের বিনিময়ে অর্থ পাঠাবে। বিলাতে থাকাকালীন শেষের দিকে এজেন্সি হাউজগুলোর পতন হওয়ায় তাকে প্রচণ্ড আর্থিক সংকটে পড়তে হয়। তার ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে অর্থ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই রামমোহন একটি চিঠি লিখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টরসকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিদর্শনপত্র নির্ভর করে তাকে ২ হাজার পাউন্ড ঋণ দিতে অনুরোধ করেন, কিন্তু কোম্পানি তাকে এ ঋণ দিতে অস্বীকৃত হয়।

বিদেশে হঠাৎ দেউলিয়া হয়ে পড়ায় তার শরীর সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে। অমলেন্দু দে বলেছেন, তার ছেলেরা কলকাতা থেকে সময়মতো অর্থ পাঠাতে আগ্রহী ছিলেন না বলে যে ধারণা রয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। রামমোহনের পত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। যেসব ব্যাংকের ওপর তিনি আস্থা করেছিলেন, তাদের অসততার ফলেই রামমোহনের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে—মন্তব্য করেন অমলেন্দু দে।

রামমোহন রায়ের প্রায় ৫০ বছর আগে দিল্লির মোগল বাদশাহ শাহ আলম বিলাতের রাজার কাছে তার দূত পাঠিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যাতে চুক্তিমাফিক বাদশাহকে তার ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দেয়। প্রধান দূত ছিলেন লে. সুইনটন, যিনি উপমহাদেশে সুলতিন সাহেব নামে পরিচিত। সহকারী দূত ছিলেন মালদহের পাঁচদোনা গ্রামের মির্জা ইহতেশাম উদ্দিন—কোম্পানির অভিজ্ঞ মুনশি। ক্লাইভের পরামর্শমাফিক এ দূতরা বাদশাহর চিঠি ও উপহারের জন্য ১ লাখ টাকা নিয়ে লন্ডন রওনা হন।

পথিমধ্যে ইহতেশাম উদ্দিন জানতে পারেন ক্লাইভ বাদশাহের সেই চিঠি ও উপঢৌকনের অর্থ নিজে রেখে দিয়েছেন, পরে তিনি বিলাতে এসে নিজে ইংল্যান্ডের রাজাকে দেবেন। ধূর্ত ক্লাইভ সেই চিঠি ও অর্থ কোনোটিই ইংল্যান্ডের রাজাকে দেননি। মির্জা ইহতেশামের দৌত্যকার্য শুরু না হতেই নিষ্ফল হয়ে গেল। পুরো মিশনটি ব্যর্থতা আর ক্লাইভের প্রতারণায় ভরা।

এর ৫০ বছর পর রাজা রামমোহন রায়ের মিশন সফল হয়েছিল বলা অত্যুক্তি হবে না।

‘রামমোহন দিল্লির সম্রাটের দূত হয়ে তার সমর্থনে যে তদবির করেন, তার প্রভাব ভারতের অন্য রাজন্যদের ওপরও পড়ে’—মন্তব্য করেছেন গবেষক অমলেন্দু দে। তার এ দৌত্য সমকালীন ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা যায়। পরে, অন্যান্য ভারতীয় রাজন্য ও তাদের অভাব ও অভিযোগ নিয়ে সরাসরি ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।

১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে গোয়ালিয়রের মহারানী বাঈজা বাঈ রামমোহনকে ইংল্যান্ডে তার দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু রামমোহন প্রয়াত হওয়ায় তিনি এ ইচ্ছাকে কার্যকর করতে পারেননি। অযোধ্যার নবাব, মহীশূরের রাজা, মুর্শিদাবাদের নবাব প্রমুখ ব্যক্তি ইংল্যান্ডে দূত পাঠানোর পরিকল্পনা করেন। মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের পুত্র শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ তার পিতার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ব্রিটিশ র্যাডিক্যাল জর্জ টমসনকে ইংল্যান্ডে তার দূত মনোনীত করেন।

১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে জর্জ টমসন দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিলাত থেকে ভারতে আসেন। নানা ধুন্দুপন্থ নানা সাহেব আজিমুল্লাহ খানকে (যিনি পরে বিদ্রোহীদের নেতা হন) তার প্রতিনিধি করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে অভাব ও অভিযোগ পেশ করতে পাঠান। এসব পরিকল্পনা অবশ্য সবসময় বাস্তবায়ন হয়নি অথবা কোনো কোনো পরিকল্পনা পুরোপুরি ব্যর্থ হলেও রামমোহনের আংশিক সাফল্য সম্পর্কে ভারতীয় রাজন্যবর্গের বিশ্বাস ও আকর্ষণের পরিচয় পাওয়া যায়। রামমোহন আরবি-ফারসি ভালো করেই জানতেন। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ পাঠ করে তিনি মূর্তি পূজায় বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন এবং সারা জীবন ধরেই ইসলামের একেশ্বরবাদের প্রশংসা করেন।

ঋণ স্বীকার

১. সংবাদপত্রে সেকালের কথা

প্রথম খণ্ড

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় সংকলিত ও সম্পাদিত

২. সংবাদপত্রে সেকালের কথা

দ্বিতীয় খণ্ড

ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় সংকলিত ও সম্পাদিত

৩. বঙ্গভূমি ও বাঙ্গালির ইতিহাস

ড. নীতিশ সেন গুপ্ত

দেজ ২০০৮-কলকাতা

৪. মধ্যযুগে বাংলা ও বাঙ্গালী

অনিল চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়

কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি কলকাতা

৫. নবজাগরণের নায়কেরা

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

পত্র ভারতী কলকাতা

৬. শনিবারের চিঠি

রামমোহন সংখ্যা

রঞ্জন কুমার দাশ সম্পাদিত

নাথ পাবলিশিং কলকাতা

দিল্লির মোগল বাদশাহর দূত রামমোহন রায় রাজা খেতাব পেলেন।

মাহবুব আলম

০১৮১৯১৩৭৬৬৭

—রাজা উপাধিসহ বিলাত গেলেন দিল্লির বাদশাহের দূত

—রামমোহন রায়

—দিল্লির মোগল বাদশা তার বাঙ্গালি দূত রামমোহনকে রাজা উপাধি দিয়ে বিলাত পাঠালেন

 

লেখক: মাহবুব আলম

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button