চার হাজার বছরের রক্তাক্ত নগরী গাজা
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বর্তমান সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়ের নাম গাজা। তিন মাস ধরে ইসরায়েলি বাহিনী ওই ছোট্ট জনপদের ওপর যে পরিমাণ বর্বরতা দেখিয়েছে এবং এখনো দেখিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। গাজা উপত্যকার এ দুর্যোগ আদিকাল থেকেই যেন নিয়তি নির্ধারিত। প্রাচীনকাল থেকে বহুবার পৃথিবীর শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর কাছ থেকে আক্রমণের শিকার হয়েছে এ জনপদ। মিসরের ফারাও থেকে শুরু করে আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার, হেরাক্লিয়াস, খসরু, নেবুচাদনেজার কেউ বাদ ছিল না আগ্রাসনের তালিকা থেকে। পারস্য-ব্যাবিলন-আসিরিয়া-গ্রিক-রোমান-ইহুদি-মুসলিম সবাই গাজার দখল নিয়ে যুদ্ধ করেছে।
গাজার বর্তমান সংকটের উৎস ও পরাশক্তিগুলোর স্বার্থ সম্পর্কে কমবেশি সবারই জানা। কিন্তু সুদূর অতীতে কী কারণে গাজার মতো ছোট্ট একটা জনপদের দখল নিয়ে এতগুলো যুদ্ধবিগ্রহের ঘটনা ঘটিয়েছিল বড় সাম্রাজ্যগুলো? জেরুজালেমের দখল নিয়ে ধর্মীয় ইস্যু থাকলেও গাজার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না।
বস্তুতপক্ষে গাজা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার মূলে ছিল তার ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থান। হাজার হাজার বছর ধরে ভূমধ্যসাগরের তীরে বিস্তীর্ণ মরুভূমির মাঝে একটি মরূদ্যান হিসেবে পরিচিত ছিল গাজা। বিশেষ করে ওয়াদি গাজা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত স্রোতস্বিনীর কারণে ওই এলাকা ছিল বৃক্ষশোভিত ও প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মরুভূমির মধ্যে এক টুকরো ব্যতিক্রমী স্বস্তি। সে কারণে ওই এলাকায় মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখির বিচরণও ছিল বেশি। এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে গাজার অবস্থানটা এমন গুরুত্বপূর্ণ যে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের যেকোনো শক্তির জন্য গাজাকে ব্যবহার করে আক্রমণ চালানো সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হতো। গাজা দখলে রাখতে পারলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে রণকৌশলগত সুবিধা পাওয়া যেত। নৌ ও স্থলপথ দুটো ক্ষেত্রেই সুবিধাটা ছিল। এ কৌশলগত অবস্থানই গাজার জন্য অভিশাপ বয়ে আনে। হাজার হাজার বছর ধরে গাজাকে একের পর এক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে।
আনুমানিক চার হাজার বছর আগে গাজা এলাকায় প্রথম বসতি গড়ে তুলেছিল হিকসস (Hyksos) নামে পরিচিত একটা প্রাচীন জাতি, যারা কেনানাইট অঞ্চলে রাজত্ব করত। হিকসস শব্দটি মিসরীয়দের উচ্চারিত ‘হেকাও খাসুত’ (hekau khasut) থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ভিনদেশী শাসক’। গাজার মধ্যভাগে তাদের যে প্রধান দুর্গটি ছিল এখনো তার ধ্বংসাবশেষ আছে তেল আল-আজ্জুল নামক স্থানে। ১৯৩২ সালে বিশ্বখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার ফ্লিন্ডার্স পেত্রি সে এলাকা খনন করে ফারাওদের বিপুল সম্পদ আবিষ্কার করেছিলেন। সেসব ফারাও ছিল হিকসস জাতিভুক্ত। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতাব্দীতে যুদ্ধে ফারাওদের কাছ থেকে মিসরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিশাল একটা অঞ্চল কেড়ে নিয়েছিল হিকসসেরা। হিকসস শাসক নিজেকে পঞ্চদশ ফারাও হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। প্রায় ২০০ বছর মিসর শাসন করার পর খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩০ সালে মিসরীয়রা পাল্টা আক্রমণ করে হিকসসদের বিতাড়িত করে এবং গাজাসহ পুরো লেভান্ট অঞ্চল নিজেদের দখলে নেয়। বর্তমান সিরিয়া-জর্ডান-লেবানন-ইসরায়েল এলাকাকে লেভান্ট অঞ্চল বলা হতো। সে সময় থেকে রাফাহ ও দিয়ের-আল-বালাহ ইত্যাদি শহর বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে।
১২৯৪ সালে ওই অঞ্চলে নতুন একটা শক্তিশালী জাতিগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। তাদের ‘সমুদ্রমানব’ বলা হতো। সে জাতি এতই দুর্ধর্ষ ছিল যে মিসরের সম্রাটও তাদের ভয়ে লেভান্ট অঞ্চল ছেড়ে মিসরে সরে গিয়েছিলেন। এমনকি সিনাই উপত্যকার পশ্চিমভাগ পর্যন্ত তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব বারো শতকে সে সমুদ্রমানবেরা কেনান অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকাজুড়ে নিজেদের একটা শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলে। সে অঞ্চলের নামকরণ করা হয় ফিলিস্টিয়া। পরবর্তীকালে এলাকাটি প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত হয়। প্রাথমিক পর্বে ফিলিস্টিয়া এলাকাটি গাজার নিকটবর্তী পাঁচটি নগরীকে নিয়ে একটা পেন্টাপলিস হিসেবে গড়ে উঠেছিল।
এ ফিলিস্টিয়াদের সঙ্গে সমুদ্র উপকূলের দখল নিয়ে পূর্বদিকের স্থানীয় ইহুদি উপজাতিদের সংঘাত লেগে যেত মাঝেমধ্যেই। পুরো উপকূলীয় এলাকা ছিল ফিলিস্টিয়াদের অধীনে। সেসব সংঘাত নিয়ে কিংবদন্তিও কম নেই। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতটি হলো ওল্ড টেস্টামেন্টে কথিত স্যামসনের কিংবদন্তি। সেখানে ঈশ্বরের প্রতিনিধির বরাতে বলা হয়েছে স্যামসনই ফিলিস্টিয়াদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত ভূমি অধিকার করতে সক্ষম হবে। তবে সফল হওয়ার জন্য শর্ত ছিল সে কখনো চুল কাটতে পারবে না। স্যামসন প্রায়ই ফিলিস্টিয়াদের লড়াই করতে আহ্বান করত এবং তাকে পরাস্ত করা কঠিন ব্যাপার ছিল। একবার সে ডেলিলাহ নামের এক ফিলিস্টিয়া তরুণীর প্রেমে পড়ে। সে প্রেমটা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। মেয়েটা ঘুমন্ত অবস্থায় স্যামসনের চুল কেটে ফিলিস্টিয়াদের কাছে ধরিয়ে দেয়। ফিলিস্টিয়ারা তাকে শেকলে বেঁধে কল ঘুরানোর কাজে লাগায়। কিন্তু এরই মধ্যে তার চুল আবারো বেড়ে উঠতে থাকলে সে শক্তিমান হয়ে ওঠে এবং শেকলবন্দি অবস্থায় দাগোন মন্দিরের স্তম্ভ উপড়ে ফেলে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করে। এ ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল মিলটনের ‘স্যামসন এগোনিস্টিকস’।
খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে শেশংক নামে পরিচিত ২২তম ফারাও কেনান প্রদেশ অধিকার করলে গাজা আবারো মিসরের অধীনস্থ হয়। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত গাজার ভাগ্য ঝুলতে থাকে আসিরিয়া ও মিসরের টানাটানির মধ্যে। খ্রিস্টপূর্ব ৬০৯ সালে আসিরীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে গাজা পুরোপুরি মিসরের অধীনে চলে যায়। কিন্তু সে অধিকার বেশিদিন টেকেনি। মাত্র এক দশক পর ব্যাবিলনের প্রতাপশালী সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার হাত বাড়ায় গাজার দিকে। তারপর ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে গাজা।
তার কিছুকাল পরেই পারস্যের আক্রমণে ব্যাবিলনের পরাজয় ঘটে। তখন গাজা ২০০ বছরের জন্য পারস্যের অধীনে চলে যায়। এ সময়ে গাজার ব্যাপক সমৃদ্ধি ঘটেছিল এবং নিজস্ব মুদ্রাও প্রচলিত হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৪৩ সালে পারস্য যখন মিসর আক্রমণ করে, তখন গাজা ছিল তার প্রধান সীমান্ত ঘাঁটি। পারস্য শাসনের সে ২০০ বছরে গাজা মনেপ্রাণে আরব হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু ১০ বছর না যেতেই আবারো যুদ্ধের দামামা বাজল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩২ সালে আলেকজান্ডার যখন বিশ্বজয়ের অভিযান শুরু করে, তখন ভূমধ্যসাগরের টায়ার নগরী অধিকার করার পর মিসর আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। মিসর আক্রমণ করার পথে তিনি সহজ টার্গেট হিসেবে গাজা দখল করে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কাজটা কঠিন করে দিয়েছিল বাতিস নামের গাজার এক স্বাধীনচেতা শাসক, যিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তিনি আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আলেকজান্ডার বাহিনী যুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে গাজা অবরোধ করে। অবরোধকালীন দুই পক্ষই গাজার ভেতরে বাইরে প্রচুর সুড়ঙ্গ খনন করেছিল। এক পক্ষ করেছিল শহরে প্রবেশ করার জন্য, অন্যপক্ষ শহর থেকে বেরোনোর জন্য। ঐতিহাসিকভাবে সেই প্রথম গাজার ভূগর্ভে সুড়ঙ্গ তৈরির ঘটনা ঘটে। যে সুড়ঙ্গ এখন হামাসের আত্মরক্ষার অস্ত্র, সে সুড়ঙ্গের ঐতিহ্য দুই হাজার বছরের বেশি পুরনো। ১০০ দিনের অবরোধ শেষেও গাজা দখল করতে ব্যর্থ হওয়ার পর গ্রিক বাহিনী আবারো আক্রমণ শুরু করে। বাতিস বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে এবং সে আক্রমণে স্বয়ং আলেকজান্ডার আহত হয়েছিলেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে অবশ্য বাতিস বাহিনীকে পরাজয় মেনে নিতে হয়। তার পরই ক্রুদ্ধ আলেকজান্ডার বাহিনী পুরো গাজা শহরের ওপর প্রতিশোধমূলক তাণ্ডব চালাতে শুরু করে। আত্মসমর্পণে অসম্মত বাতিসের পা ভেঙে তাকে রথের চাকায় বেঁধে পুরো শহরে ঘুরানো হয়। গাজার প্রায় সব সক্ষম পুরুষকে হত্যা করা হয়। তাদের স্ত্রী-কন্যাকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হয়। গাজা থেকে লুট করা সম্পদগুলো ম্যাসিডোনিয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং গাজাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য গ্রিক উপনিবেশে পরিণত করা হয়।
আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর গাজা দখল নিয়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে আবারো টানাহেঁচড়া শুরু হয়। বিশেষ করে মিসর, টলেমি ও সেলুসিড সাম্রাজ্যের মধ্যে। অবশেষে গাজা টলেমি সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত টলেমি সাম্রাজ্যের অধীনে থাকার সময় বন্দর হিসেবে গাজা খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এমনকি আলেকজান্দ্রিয়ার চেয়েও গাজার বন্দরে বাণিজ্যের পরিমাণ বেশি ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সিরিয়াসহ পুরো লেভান্ট অঞ্চল সেলুসিড সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। তখন গাজাও সেলুসিড সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। তাতে গাজার আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণ সেলুসিডদের দেবতা জিউস মারনাসের সঙ্গে গাজার দাগোন মন্দিরের তেমন বিরোধ ছিল না। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ১৮৮ সালে পরাক্রমশালী সেলুসিড সম্রাট তৃতীয় এন্টিয়োকাস রোমান সাম্রাজ্যের দিকে হাত বাড়িয়ে বড় ধরনের খেসারত দিয়েছিলেন। পরাজিত হওয়ার পর নিজের বেশকিছু অঞ্চলকে ছেড়ে দিতে হয় রোমানদের। গাজা তখনো সেলুসিডদের অধীনে থাকলেও শিথিল হয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণ।
সে পরিস্থিতিতে আরো কয়েক দশক পর গাজার ম্যাকাবি পরিবারের নেতৃত্বে স্থানীয় ইহুদি উপজাতিরা সেলুসিড সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলনের সূচনা করে। তারা সেলুসিডদের প্যাগান দেবতার উপাসনা করতে অস্বীকার করার মাধ্যমে বিদ্রোহ শুরু করেছিল। বিষয়টা ওই অঞ্চলে ব্যাপক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিল এবং আট বছর স্থায়ী ছিল সে অস্থিরতা। ইহুদি বিদ্রোহীরা গাজা নগরীতে আক্রমণ চালিয়ে বিশিষ্ট নাগরিক ও তাদের সন্তানদের জিম্মি করে জেরুজালেমে নিয়ে আটকে রেখেছিল। এ ঘটনার উল্লেখ বাইবেলেও আছে।
সে ঘটনার বেশ কিছুকাল পর জেরুজালেমকেন্দ্রিক হাসমোনিয়ান রাজ্যের উত্থান ঘটে। সেলুসিড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও সে রাজ্যটি সীমিত স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। হাসমোনিয়ান রাজ্যের উত্থান গাজার অধিবাসীদের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। সে রাজ্যটির সম্প্রসারণবাদী মনোভাবের কারণে গাজাবাসী আতঙ্কে থাকত। সে সময় গাজার পাশ দিয়ে ইয়েমেন থেকে আসা দীর্ঘ উটের কাফেলাগুলো যাতায়াত করত নাবাতিয়ান সাম্রাজ্যের উদ্দেশে। গাজার শাসক সে কাফেলার মাধ্যমে নাবাতিয়ান সম্রাটের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করত, যাতে বিপদে সাহায্য পাওয়া যায়। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৯৭ সালে হাসমোনিয়ান সাম্রাজ্য যখন গাজা আক্রমণ করে, তখন গভর্নর অ্যাপোলোডটাস কোনো সাহায্য পাননি। নিজের ভাইয়ের হাতে অ্যাপোলোডটাস নিহত হওয়ার পর গাজা হাসনোমিয়ানদের দখলে চলে যায়। সে পর্বে আলেকজান্ডারের নির্বিচার হতাকাণ্ডের মতো আরেকটি গণহত্যার সম্ভাবনা দেখা দিলে স্থানীয় লোকজন দলে দলে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে প্রাণ রক্ষা করেছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে রোমান আক্রমণে যখন জেরুজালেমের পতন ঘটে, তখন গাজায় হাসমোনিয়ান শাসনেরও অবসান হয়। কিন্তু গাজার ভাগ্য তখনো ঝুলতে থাকে অনিশ্চয়তার দোলায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ সালে রোমান সম্রাট মার্ক এন্তোনিও ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে গাজা দখল করে নেন এবং শহরটিকে তার স্ত্রী ক্লিওপেট্রাকে উপহার দেন। রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে যাওয়ার পর গাজা নতুন করে জেগে উঠতে শুরু করে। এ সময়ে গাজার বাণিজ্যিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া ইত্যাদি বিষয়েও অগ্রগতি ছিল উল্লেখযোগ্য। রোমান সম্রাট গাজার কোনো বিষয়ের ওপর খবরদারি করতেন না। এ পর্বে গাজা দীর্ঘ সময় রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।
৩১৩ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টাইন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর গাজায় খ্রিস্টধর্ম প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তখন গাজায় জিউস মারনাস নামের এক প্যাগান দেবতার উপাসনা হতো। প্রথম দিকে ধর্ম নিয়ে বিবাদ ছিল। নব্যদীক্ষিত খ্রিস্টানদের ওপর আক্রমণ চালানো হতো। পরে ধীরে ধীরে খ্রিস্টধর্ম জায়গা করে নিতে শুরু করে, তবে পাশাপাশি প্যাগান দেবতার উপাসনাও চলত। বাইজেন্টাইন আমলে খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে ভালো প্রসার ঘটেছিল।
কিন্তু সপ্তম শতাব্দীতে এসে গাজার ভাগ্য নতুন দিকে মোড় নেয়, যখন অল্প সময়ের ব্যবধানে গাজা কয়েকবার হাত বদল হয়। ৬১৮ খ্রিস্টাব্দে পারস্য সম্রাট খসরুর আক্রমণে জেরুজালেমসহ পুরো প্যালেস্টাইন রোমানদের হাতছাড়া হয়। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে হেরাক্লিয়াস পাল্টা আক্রমণ করে গাজাকে রোমের দখলে আনে। কিন্তু মাত্র আট বছর পর ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে এক নাটকীয় যুদ্ধে মুসলমান বাহিনীর কাছে হেরাক্লিয়াসের পরাজয় ঘটার পর বাইজেন্টাইন শাসনের অবসান ঘটে। গাজার দখল চলে যায় আরবের মুসলমানদের হাতে। তখন থেকে গাজা মুসলিমপ্রধান শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। মুসলিম শাসকদের মধ্যেও অনেক বিভক্তি বিবাদ ছিল। ফলে যুদ্ধ, হানাহানি আর রক্তপাতের দুর্ভাগ্য কখনই গাজাকে মুক্তি দেয়নি। বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার ইতিহাসই বারবার ফিরে এসেছে গাজাবাসীর ওপর।
শেষ করার আগে বাইজেন্টাইন আমলের ছোট্ট একটি ঘটনার কথা বলার লোভ সামলানো যাচ্ছে না। ৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে আরবের মক্কা নগরী থেকে এক আরব বণিক বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে গাজা নগরীতে গিয়েছিলেন। তখন মক্কা নগরীতে যারা তীর্থ দর্শনে যেত, তাদের নিরাপত্তা ও যাতায়াতের বিষয় দেখভাল করার জন্য তিনি বাইজেন্টাইন সম্রাটের অনুমোদিত প্রতিনিধি ছিলেন। সেবার কাফেলা নিয়ে গাজা পৌঁছানোর পর তিনি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে গাজায় সমাধিস্থ করা হয়। তার নাম হাশিম ইবনে আবদে মানাফ। গাজাবাসী তখন কল্পনাও করেনি যে মাত্র ১০০ বছরের মধ্যে তার প্রপৌত্রের মাধ্যমে পৃথিবীতে আরেকটি নতুন ধর্ম আসতে চলেছে। তিনি ছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর প্রপিতামহ। বারো শতকে তার স্মরণে গাজার আল-দারাজ এলাকায় সাইয়েদ হাশিম নামে একটা মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।
১৯৩২ সালে স্যার ফ্লিন্ডার্স পেত্রি যখন ওয়াদি গাজা অঞ্চল খনন করে চার হাজার বছর পুরনো হিকসস আমলের ফারাওদের বিপুল সম্পদ আবিষ্কার করেন, সেটা সারা পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিল। গাজার প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে নতুন করে গবেষণাও শুরু হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের ওই অঞ্চলে পৃথিবীর যে প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর জন্ম হয়েছিল তার অনেক কিছু এখনো উন্মোচন হয়নি। কিন্তু একের পর এক ঘটতে থাকা ধ্বংসযজ্ঞ আর রক্তপাতের ভেতর হাজার হাজার মানুষের পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে গাজার গৌরবময় ইতিহাসের সূত্রগুলো। এ ক্ষতি পৃথিবীর ইতিহাসের জন্য অপূরণীয়।
হারুন রশীদ: প্রাচীন সভ্যতা ও ইতিহাস অনুসন্ধানী লেখক