শ্রীপুরের ফোর মার্ডার : কার নির্দেশে অন্য আসামিদের ছাড় দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : মা ও দুই কিশোরী মেয়েসহ চারজনকে হত্যা এবং ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই ঘটনায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ১৭ বছর বয়সী কিশোর পারভেজকে গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদের পর পারভেজ এই ঘটনায় একাই জড়িত বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ঘটনায় পারভেজকে একমাত্র আসামি হিসেবে হাজির করে পিবিআই। এর পর মা ও দুই কিশোরী মেয়েসহ চারজনকে হত্যা এবং ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত আরও ৫ জন র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর পাল্টে যেতে থাকে নৃশংস এই ঘটনার দৃশ্যপট। পুরো তদন্ত কার্যক্রম নাটকীয়ভাবে মোড় নিয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে ঘটনাস্থল শ্রীপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ও মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা জাফর, পরিদর্শক (অপারেশন) তারিকুজ্জামান ও পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানাকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এই মামলার তদন্ত ভিন্ন খাতে নিয়ে অন্য আসামিদের দায়মুক্তির পথ তৈরি করা হচ্ছিল। এতে জেলা পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার ইন্ধন ছিল।
তবে র্যাবের হাতে ৫ জন আসামি গ্রেপ্তারের পর দৃশ্যত দায়মুক্তির পথ বন্ধ হওয়ার পথে। প্রায় ২২ বছর আগে ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক স্মৃতি আক্তার ফাতেমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেন বাংলাদেশের যুবক রেজোয়ান হোসেন। তারা দুজনই তখন মালয়েশিয়ায় থাকতেন। ২০১০ সালে সন্তানদের শ্রীপুর আবদার গ্রামে ফেরেন তারা। রেজোয়ান ফের মালয়েশিয়া ফিরে যান কাজের জন্য। গত ২৩ এপ্রিল রেজোয়ান হোসেন স্ত্রী ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক স্মৃতি আক্তার ফাতেমা (৪৫), তার বড় মেয়ে সাবরিনা সুলতানা নূরা (১৬), ছোট মেয়ে হাওয়ারিন (১০) ও প্রতিবন্ধী ছেলে ফাদিলের (৮) গলা কেটে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় জড়িত পারভেজকে গত ২৬ এপ্রিল রাতে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। গ্রেপ্তারের পর পিবিআই জানায়, পারভেজ একাই এই চার খুন এবং ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত। বিষয়টি নিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয় পারভেজ। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন ১৭ বছর বয়সী পারভেজের একার পক্ষে তিনজনকে ধর্ষণ এবং চারজনকে হত্যা করা সম্ভব কিনা। যদিও পিবিআইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী, পারভেজ হত্যার পর অর্ধমৃত অবস্থায় তাদের ধর্ষণ করে। মোবাইল চুরি করতে গিয়ে সে এই ঘটনা ঘটায়।
এমন প্রেক্ষাপটে এই ঘটনায় আরও অন্তত ৮-৯ জন জড়িত এমন তথ্যপ্রমাণ নিয়ে দৃশ্যপটে হাজির হয় র্যাব। গত ২৮ এপ্রিল এই ঘটনায় জড়িত ৫ জনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাব এই তথ্য দেয়। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- কাজিম উদ্দিন (৫০), হানিফ (৩২), বশির (২৬), হেলাল (৩০) ও এলাহি মিয়া (৩৫)। পিবিআইর হাতে গ্রেপ্তার একমাত্র আসামি পারভেজ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার কাজিম উদ্দিনের ছেলে।
র্যাব জানায়, বাবা-ছেলে একই সঙ্গে মা ও দুই মেয়ে শিশুকে ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজে অংশ নেয়। আসামিরা ডাকাতি করতে ওই বাসায় হানা দিয়েছিল। এ ছাড়া গণধর্ষণের পর তাদের হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে র্যাব।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, র্যাব ৫ আসামিকে গ্রেপ্তারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার আদ্যপান্ত উঠে আসে। পরে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের বিশেষায়িত এই তদন্ত ইউনিট।
এই প্রতিবেদক মামলা তদন্তকাজে যুক্ত বেশ কয়েক জন অভিজ্ঞ পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বিষয়টি নিয়ে। তারা সবাই বলেছেন, সাধারণত এমন চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার ক্ষেত্রে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে দালিলিক প্রমাণ মিলিয়ে ঘটনা নিশ্চিত হয়েই তাদের স্বীকারোক্তির জন্য আদালতে পাঠানো হয়। ফোর মার্ডারের ক্ষেত্রে তদন্তকারীদের উচিত ছিল, পারভেজের কাছ থেকে অন্য খুনিদের বিষয়ে তথ্য বের করে আনা। তারা সেটি কেন করলেন না এটি প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে বলে মনে করছেন তারা।
তদন্তে ঘাটতি ছিল কিনা সেটি জানতে চাইলে গাজীপুর পিবিআইর পরিদর্শক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘বারবার জিজ্ঞাসাবাদ সে (পারভেজ) একাই জড়িত থাকার কথা বলেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো গাফিলতি ছিল না। এখানে আসলে কিছু করার ছিল না। এখন র্যাবের আসামিদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি।’
গাজীপুর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) শামসুন্নাহার দাবি করেন, তিন কর্মকর্তা প্রত্যাহারের সঙ্গে ফোর মার্ডারের তদন্তের সম্পর্ক নেই। এটি রুটিন ওয়ার্ক।
এদিকে, মামলার বাদী এজাহারে এটিকে সংবদ্ধ অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে অজ্ঞাত একাধিক ব্যক্তিকে আসামি করেন। ঘটনাস্থলের আলামত সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়। এখনো পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রস্তুত হয়নি। তবে সিআইডির ফরেনসিক শাখার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এ ঘটনায় একজন জড়িত থাকা অসম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘এই ঘটনায় জড়িত আরও কয়েকজন পলাতক রয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে র্যাব।’
এ বিষয়ে অপরাধ বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘পিবিআই তদন্ত সংস্থা হিসেবে মানুষের আস্থা অর্জন করেছে। তাদের এমন কিছু করা ঠিক হবে না যেটির কারণে সেই আস্থার জায়গায় চিড় ধরে। পিবিআইসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত হবে পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা।’
এ সংক্রান্ত আরো জানতে…..
শ্রীপুরে ফোর মার্ডার: ডাকাতি করতে গিয়ে বাবা ছেলে মিলে অংশ নেয় ধর্ষন ও হত্যায়
শ্রীপুরের চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডার: আরও পাঁচজনকে আটক করেছে র্যাব
শ্রীপুরে চাঞ্চল্যকর ফোর মার্ডার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুই পরিদর্শককে প্রত্যাহার
মোবাইল চুরি করতে গিয়ে ইন্দোনেশীয় নারী ও তিন সন্তানকে একাই গলা কেটে হত্যা করে পারভেজ!
শ্রীপুরে ইন্দোনেশীয় নারী ও তিন সন্তানকে হত্যার মূল হোতাকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই
শ্রীপুরে ইন্দোনেশিয়ার এক নারীসহ চারজনকে গলা কেটে হত্যা