গল্প-গুজবের সাংবাদিকতা?
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : আগেও কথা হয়েছে। কিন্তু মেজর(অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার পর ‘গল্প-গুজবের’ সাংবাদিকতা আলোচনায়। আর গল্প দোষে দুষ্ট এই সব প্রতিবেদন পাঠকদের কেউ কেউ পড়ে বেশ মজাও পাচ্ছেন। শেয়ার করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
করোনার শুরুতে এই বাংলাদেশই আমরা অনেক গুজব দেখেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তার দুই-একটি কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে খবর হিসেবেও উঠে এসছে। আর পদ্মা সেতুতে ‘শিশুদের মাথা ও রক্ত লাগবে’- এই গুজবে গত বছরের জুন মাস থেকে পরবর্তী তিন মাসে বাংলাদেশে ছেলে ধরা আতঙ্কে অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কয়েক দশক আগে ১৯৮৭ সালে ‘ঢোল কলমির’ গুজব যখন ছড়ায় তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। তখন মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমের হাত ধরেই এই গুজব ছড়িয়েছিলো। ওই গুজবের ডালপালাও বেশ ছড়িয়েছিল। প্রথম গুজব ছিলো ওই গাছের পাতা গায়ে লাগলে মানুষ মারা যায়। তার পরে বলা হলো ওই গাছে যে পোকা বসে তা গায়ে লাগলে বা কামড় দিলে মানুষ মারা যায়৷ পরে দেখা গেল পুরোটাই গুজব।
কোনো একটি ঘটনা ঘটলে বাতাসে অনেক ধরনের কান কথা থাকে৷ থাকে নানা ধরনের সত্য-অসত্য তথ্য। কখনো আবার সত্যের সাথে রঙ চড়িয়ে বাজারে অনেক তথ্য ছাড়া হয়। আর সাংবাদিকতা যদি তার ভিত্তিতে হয় তাহলে সেটা গল্প হতে পারে সংবাদ নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘‘সংবাদে কখনো সত্য আর অসত্যের মিশ্রণ থাকতে পারেনা। সংবাদ শতভাগ তথ্য ভিত্তিক। শত ভাগ সত্য৷’’ তার মতে, ‘‘নিউজ কখনো ফেক নিউজ হতে পারে না। ফেক তো ফেক৷ সেটা আবার নিউজ হয় কিভাবে!’’
ডেভেলপিং স্টোরির ক্ষেত্রে এই গল্প-গুজবের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়৷ বিশেষ করে ঘটনাটি যদি আলোচিত হয়। যেমন হয়েছে মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায়। কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম এমন ধরনের সংবাদ এরইমধ্যে প্রকাশ করেছে যাতে তারা হত্যা রহস্য উদঘাটন করে ফেলেছেন। জড়িতদের সবাইকে চিহ্নিতও করে ফেলেছেন। সিনহার সাথে থাকা সিফাত এখনো সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা না বললেও তার মুখ দিয়েই হত্যার বিবরণও প্রকাশ করেছে আরেকটি পত্রিকা। তাতে কোনো সোর্স নেই। সিফাত কার সাথে কথা বলেছেন? তদন্তকারীদের সাথে না ওই প্রতিবেদকের সাথে তাও বলা হয়নি। মনে হচ্ছে সংবাদ নয়, গল্প লেখার প্রতিযোগিতায় কেউ কেউ পিছিয়ে থাকতে চান না।
সিনিয়র সাংবাদিক এবং টিভি টুডে’র প্রধান সম্পাদক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘‘এখন আমরা দেখছি প্রভাবশালী গণমাধ্যমের দুর্বল সাংবাদিকতা। কোনো সাংবাদিক যা লিখেন তা তাকে প্রমাণ করতে হয়। প্রমাণ করতে না পারলে সাময়িক বাহবা হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।’’
বাংলাদেশে কয়েক ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে সাংবাদিক কন্যা শারমিন রিমা হত্যা খুব আলোচিত হয়েছিলো। তখন এই হত্যাকাণ্ড কেন্দ্র করে। খাটের তলার সাংবাদিকতা। নামে একধরনের সাংবাদিকতাকে নাম দেয়া হয়। সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তখন কোনো কোনো সাংবাদিক নানা সূত্রের বরাতে এমনভাবে ওই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিতেন যেন যে খাটের ওপরে খুন হয়, ঘটনার সময় তিনি সেই খাটের তলায় ছিলেন।
যমুনা টেলিভিশনের অনুসন্ধানী সাংবাদিক মোহসীন উল হাকিম বলেন, ‘‘এই প্রবণতা এখনো আছে। বিশেষ করে মেজর(অব.) সিনহা হত্যার ঘটনায় এটা আমরা প্রবলভাবে দেখছি। আমার মনে হচেছ পাঠক বা দর্শক পেতে এটা কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম করছে। এটার জন্য প্রতিবেদকের দায়তো আছেই। কিন্তু নিউজরুম বা এডিটোরিয়াল পলিসিও দায়ী৷’’ তার মতে এই প্রবণতা সংবাদমাধ্যমের ব্যাপারে গ্রাহকের শেষ পর্যন্ত আস্থাহীনতা তৈরি করে৷ আর সেটার দায় সব সংবাদধ্যমের ওপর গিয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নানা বাধা আছে৷ সেটা দক্ষতা, আর্থিক, মালিক পক্ষ বা সরকারের দিক থেকে হতে পারে৷ তাই এখানে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও কম। কিন্তু এই অজুহাতে প্রতিবেদনের নামে গল্প লেখার সুযোগ নেই। মন্ত্রণালয়ের কোনো নথি, গোয়েন্দা সংস্থার কোনো প্রতিবেদন প্রাথমিক সূত্র হতে পারে। কিন্তু সেটাই সংবাদ নয়। তথ্য আর সংবাদ আলাদা। তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সাংবাদিক পরবর্তী অনুসন্ধান করে প্রতিবেদনটি পূর্ণাঙ্গ করবেন।
মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘‘এই যে লেখা হলো, সিনহা ওসি প্রদীপের সাথে মাদক নিয়ে কথা বলেন। তারপর ঝড়ের গতিতে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। তারপর পথে হত্যাকাণ্ড ঘটে। যিনি এটা লিখলেন তার সোর্স কি? কারা তাকে এটা জানিয়েছেন? আর সেটা কি তিনি ক্রসচেক করেছেন? এখন তিনি যদি এটা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারেন। তাহলে এটাকেই তো মানুষ গল্প বলে অভিহিত করবেন।’’
‘‘যা সত্য তাই খবর। এর সাথে নিজের আবেগ বা ধারণা করা কোনো বিষয় যুক্ত করে দিলে তা সংবাদ হবে না। সেটা কোনো সৃষ্টিশীল লেখা বা গল্প হতে পারে।”- এই অভিমত দিয়ে আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘‘মনে রাখতে হবে এটা সাংবাদিকতার ক্ষতি তো করেই, সমাজেরও ক্ষতি করে। সাংবাদিকতা তো সমাজ ও মানুষের জন্য। মিথ্যা তথ্য, ভুল তথ্য, গুজব সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। এর ফলে কোনো বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা তৈরি হয়। সন্দেহ ও সংশয়ের সৃষ্টি করে।’’
দায় কার?
তাহলে এই গল্প-গুজবের সাংবাদিকতার দায় কার? যারা সংবাদমাধ্যমে সম্পাদনা করেন, সম্পাদকীয় নীতি দেখেন, সম্পাদনা করেন তারাই প্রধান গেটকিপার। প্রতিবেদকের যে দায় নেই তা কিন্তু নয়। কিন্তু কোনো প্রতিবেদন প্রস্তুত করলেই তো সেটা প্রকাশ হয়ে যায় না। সম্পাদনার টেবিল হয়ে যায়। তাই গল্প-গুজবের খবর যারা প্রকাশ হতে দেন সবার আগে দায়টি তাদেরই নিতে হবে আর এই গল্প-গুজবের পেছনে নানা পক্ষ কাজ করতে পারে। এর ভেতরে রাজনীতি থাকতে পারে। অসৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘‘সত্য কখনো কম বেশি হয় না। কোনো কিছু রঙ লাগিয়ে, ফুলিয়ে বা অসত্য তথ্য প্রকাশ করা যেমন সাংবাদিকতা নয়। তেমনি সত্য গোপন করা বা প্রকাশ না কারাও অপসাংবাদিকতা৷ এই দুইটি দিকেই খেয়াল রাখা প্রয়োজন।’’
আর মনজুরুল আহসান বুলবুল মনে করেন, ‘‘সাংবাদিককে যেমন পেশাদার হতে হবে। তেমনি যারা সম্পাদনা করেন তাদেরও দক্ষ ও পেশাদার হতে হবে। শুধু ধারনা, শোনা কথা, অসর্থিত তথ্য, সন্দেহ কখনোই সংবাদ হতে পারেনা। কারুর প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ প্রকাশ সাংবাদিকতা নয়।’’
সূত্র: ডয়চে ভেলে