গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সব ধরনের খতিয়ানে ব্যক্তির নাম থাকার পর কোনো জমি সরকারের নামে রেকর্ডভুক্ত হলে এবং নিম্ন আদালত সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিলে তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে নামজারি করে দিতে হবে। রবিবার এ সম্পর্কিত পুরনো আদেশ বাতিল করে নতুন আদেশ জারি করেছে সরকার।
পুরনো পরিপত্র অনুযায়ী, নিম্ন আদালত কোনো ব্যক্তির পক্ষে জমির মালিকানার রায় দিলেও রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশনে রিভিউর আবেদন করে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ আদালতের রায় না হওয়া পর্যন্ত সরকার ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা চালিয়ে যেতে থাকে। একই পরিপত্রে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে ন্যস্ত করা হয়।
ভূমি সচিব মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, ‘পূর্ববর্তী সব রেকর্ডে ব্যক্তির নামে রেকর্ডভুক্ত এবং সরকার কর্তৃক মালিকানা অর্জনের উপযুক্ত আইনগত কোনো ভিত্তি বা প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও কোনো কোনো জমি সরকারের নামে রেকর্ড হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট ভূমি মালিকের পক্ষে জমির নিরঙ্কুশ ভোগদখল ব্যাহত হচ্ছে। জনগণ অযথা হয়রানির শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারও ভূমি উন্নয়ন কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে সরকার অথবা ভূমি দাবিদার উভয়ের পক্ষে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত মামলা চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য বিষয়। মামলা শেষে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন গ্রহণ সাধারণ জনগণের জন্য আরেক শ্রমসাধ্য ও কষ্টসাধ্য কাজ। এরকম পরিস্থিতিতে জনগণের ভোগান্তি লাঘব ও সেবা সহজীকরণের জন্য সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পত্তিতে দেওয়ানি মামলার রায়ের ভিত্তিতে রেকর্ড সংশোধনসহ সরকারি সম্পত্তি সুষ্ঠুভাবে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আগের পরিপত্র বাতিল করে নতুন পরিপত্র জারি করা হয়েছে।’
রোববার পর্যন্ত বহাল পরিপত্রটি ১৯৯৪ সালে জারি করা হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় জারি করা সেই পরিপত্রে বলা হয়েছিল সরকারি সম্পত্তি রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত যেতে হবে। এর ফলে সিএস, এসএ বা আরএস খতিয়ানে ব্যক্তির নামে রেকর্ডকৃত অথবা কোনো আইনগত প্রক্রিয়ায় খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্তির কোনো তথ্য নেই বা সরকারের দখলেও নেই এমন ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ভুলবশত সরকারের নামে রেকর্ডভুক্ত হয়ে থাকলে তা আদালতের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে সর্বোচ্চ ধাপ পর্যন্ত যেতে হয়েছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের এবারের পরিপত্রটি ঐতিহাসিক। কারণ ১৯৯৪ সালের পরিপত্রের জন্য সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ ছিল না। যে জমির সিএস, এসএ বা আরএস ব্যক্তির নামে রয়েছে সেই জমি নানা কারণে সরকারের নামে উঠতে পারে। নতুন করে ভূমি জরিপের সময় ভুলবশত ব্যক্তির জমির সরকারের নামে রেকর্ডভুক্ত হতে পারে। ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যক্তির জমি সরকারের নামে তুলে রাখতে পারে।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হয়রানি করার জন্য ভূমি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় ব্যক্তির জমি সরকারের নামে রেজিস্টারে তুলে রাখতে পারে। যে কারণেই ঘটুক না কেন, ব্যক্তির জমি সরকারের নামে রেকর্ডভুক্ত হলে সেই ব্যক্তির হয়রানির শেষ নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি প্রথমে ভূমি অফিসে যান। সেখানে রেকর্ড সংশোধন করার জন্য আবেদন করেন। তার আবেদনে সাড়া দেয় না ভূমি অফিস। তখন তিনি বাধ্য হয়ে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল বা সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা করেন। সরকার ওই মামলায় হেরে গেলে হাইকোর্টে যায়। সেখানে হেরে গেলে যায় সুপ্রিম কোর্টে। সেখানেও হেরে গেলে যায় রিভিউতে। রিভিউর রায় ব্যক্তির পক্ষে গেলে শুরু হয় নতুন বিড়ম্বনা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তখন ভূমির মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে আসে। ভূমি মন্ত্রণালয় বছরের পর বছর ঘোরাতে থাকে। এক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ভূমির মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য পুনরায় আদালতে মামলা করেন। তখন আদালত সরকারকে নির্দেশ দেয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে নামজারি বা মিউটেশন করে ভূমির মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। আদালত ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের চক্করে পড়ে যুগের পর যুগ পার হয়ে যায়। অনেক সময় তিন পুরুষ পার হয়ে গিয়ে জমির দখলস্বত্ব বুঝে পায়। এই প্রক্রিয়ায় জমির যে দাম তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা চলে যায় আদালতে ঘুরতে ঘুরতে।
এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য ১৯৯৪ সালের পরিপত্র বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আরও তিন মাস আগেই। কিন্তু পরিপত্রটি বাতিল করে নতুন পরিপত্র জারি করলে কোনো জটিলতা সৃষ্টি হবে কি না তা বোঝার চেষ্টা করেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। শেষ পর্যন্ত মাঠ প্রশাসন ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে নতুন পরিপত্রের খসড়া করে ভূমি মন্ত্রণালয়। সার্বিক বিষয় যাচাই-বাছাই করার পর এ পরিপত্র জারি করে ভূমি মন্ত্রণালয়।
নতুন পরিপত্র অনুযায়ী, সিএস, এসএ বা আরএস জরিপে ব্যক্তির জমি সঠিকভাবে রেকর্ডভুক্ত হলেও ভুলবশত পরে সরকারের নামে রেকর্ড হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল বা এখতিয়ার সম্পন্ন আদালতে দায়েরকৃত মামলায় সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হলে তা পর্যালোচনা করতে হবে। রেকর্ড পর্যালোচনা ও সরেজমিন পরিদর্শন করে সরকারি স্বার্থ না থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হবেন সহকারী কমিশনার (ভূমি)। তিনি নামজারির নথি সিদ্ধান্তের জন্য জেলা প্রশাসকের (ডিসি) কাছে পাঠাবেন। এই নথি পাওয়ার পর ডিসি পুনরায় রেকর্ড পর্যালোচনা করে প্রয়োজনবোধে সরেজমিন পরিদর্শন করে সরকারি স্বার্থ না থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হবেন। এরপর তিনি নামজারির নথিটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ বিভাগীয় কমিশনারের কাছে পাঠাবেন। কমিশনার নথিপত্র পর্যালোচনা করে নামজারির আদেশ দেবেন। বিভাগীয় কমিশনার নামজারি অনুমোদন সংক্রান্ত মাসিক বিবরণী ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।
সরকারি খাস ও অন্যান্য জমি ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত আদালতে প্রতিকার চেয়ে মামলা করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষে যথাযথ প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চিত করতে হবে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) দেওয়ানি মামলা সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়মিত তদারকি করবেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রেভিনিউ মুনশিখানা শাখা প্রতি মাসে কমপক্ষে একবার পরিদর্শন করবেন। এছাড়া তিনি দেওয়ানি মামলার রেজিস্টার সংরক্ষণ, আদালতে সময়মতো লিখিত জবাব পাঠানো, আদালতে উপযুক্ত প্রতিনিধির উপস্থিতি নিশ্চিত করবেন।
যেসব জমি সিএস, এসএ বা আরএস খতিয়ানে সরকারের নামে রেকর্ডভুক্ত আছে বা বিভিন্ন কারণে খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ওইসব সম্পত্তি পরবর্তী সব জরিপে খাস খতিয়ানে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের জমি সিটি জরিপে ব্যক্তির নামে রেকর্ড হলেও জেলা প্রশাসক সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত আপিল বা রিভিশন করবেন। তিনি মামলায় সরকার পক্ষে যথাযথ প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চিত করবেন।
কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর গাফিলতির কারণে মামলা বা মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বীর ক্ষেত্রে কাগজপত্র না পাঠানোর কারণে সরকারি স্বার্থ ক্ষুণ হলে দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারি সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে যেকোনো ধরনের অবহেলা বা গাফিলতি করা হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয় পরিপত্রে।
এছাড়া ভূমি মন্ত্রণালয়, ভূমি সংস্কার বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাঠপর্যায়ের ভূমি অফিসসমূহ পরিদর্শনের সময় সরকারি সম্পত্তি রক্ষার জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার জন্যও পরিপত্রে বলা হয়েছে।
সূত্র: দেশ রূপান্তর