বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইউএনও’র প্রতারণার সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এমনকি অভিযোগকারী নারীকে না জানিয়ে তার নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের প্রমাণও মিলেছে। সরকারের একজন দায়িত্বশালী কর্মকর্তার এ ধরনের কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ হয়েছে বলেও মতামত দেওয়া হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। ওই নারী বলছেন, ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ থাকার পরও তদন্ত কর্মকর্তা কৌশলে সেগুলো এড়িয়ে গেছেন।
তবে আসিফ ইমতিয়াজ বলছেন, তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই মিথ্যা।
সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে প্রত্যাহারসহ বিভাগীয় মামলা করার প্রস্তুতি চলছে।
ময়মনসিংহের ওই নারী ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন, হত্যার হুমকি, ব্যাংকে অবৈধ লেনদেন ও সন্তানের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ‘লোক লাগিয়ে’ হামলা চালিয়ে গর্ভের সন্তান নষ্ট করে দেওয়ার অভিযোগ করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। এরপর মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি করে। সেখানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. হারুন অর রশীদকে আহ্বায়ক করা হয়। তিনি গত ১৪ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছে বিস্তারিত উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন জমা দেন।
হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমি নিয়ম অনুযায়ী উভয়পক্ষকে সমান সুযোগ দিয়ে তদন্ত করেছি। খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তদন্তকাজ শেষ করে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছি। এর বেশি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সরকারের একজন অফিসারের এ ধরনের কর্মকাণ্ড আমরা কোনোভাবেই সহ্য করব না। তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। প্রত্যাহার ও বিভাগীয় মামলাসহ সব ধরনের শান্তি নিশ্চিত করতে আমরা মন্ত্রণালয়কে বলেছি।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী ওই নারী জানান, গত বছর এপ্রিলের শুরুর দিকে এক বান্ধবীর মাধ্যমে আসিফ ইমতিয়াজের সঙ্গে পরিচয়। তারপর থেকে ফোনে নিয়মিত কথা হতো। এপ্রিল মাসে ঢাকায় এসে সাক্ষাৎ করেন আসিফ ইমতিয়াজ। দুজন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর কাজি এনে আসিফ ইমতিয়াজের বোন ও ভগ্নিপতির সামনে মিরপুরের একটি রেস্টুরেন্টে বিয়ে করেন তারা। তখন আগের স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্সের কারণে কিছু সময় অতিবাহিত না হলে বিয়ের রেজিস্ট্রেশন করা যাচ্ছে না এমন কথা জানান আসিফ। বিষয়টি মেনে নিয়ে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতে শুরু করেন তারা। এরপর মিরপুরের বাসা ছেড়ে তারা বনশ্রীতে বাসা ভাড়া নেন। এ সময় আসিফ ইমতিয়াজ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সরকারি ছুটির দিনগুলোতে তিনি ঢাকায় আসতেন। একপর্যায়ে বনশ্রীর বাসাও তারা ছেড়ে দেন। এরপর ওই নারী একটি হোস্টেলে থাকতেন। আর আসিফ ঢাকায় এলে তাকে নিয়ে প্রগতি সরণি ও বিজয়নগরের আবাসিক হোটেলে থাকতেন।
ওই নারী জানান, বিউটি পার্লার করার জন্য আসিফ তাকে ট্রেড লাইন্সেস করতে বলেন। এরপর ব্যাংক থেকে লোন করে দেওয়ার কথা বলে ট্রেড লাইন্সেস, পাসপোর্ট ও ছবি নেন। পরে জানতে পারেন, তাকে না জানিয়ে কদমতলীর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে তার নামেই অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। ওই অ্যাকাউন্ট থেকে ডেবিট কার্ডও ব্যবহার করেছেন আসিফ। বিষয়টি নিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
ভুক্তভোগী ওই নারী আরও জানান, চলতি বছর জানুয়ারি মাসে তিনি সন্তানসম্ভবা হন। এ খবর আসিফকে জানানোর পরই তাদের সম্পর্কে অবনতি হতে শুরু করে। একপর্যায়ে তার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন আসিফ। গর্ভে থাকা সন্তান নষ্ট করার জন্য নানামুখী চাপ দেন। বাধ্য হয়ে তিনি আসিফের কর্মস্থল চট্টগ্রামে যান। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানোর পর তিনি কৌশলে আসিফকে বদলি করেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের ইউএনও হিসেবে। বদলি হওয়ার পর ওই নারী সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছে বিচার চেয়ে অভিযোগ করেন। সেখানে তদন্ত কর্মকর্তা চিঠি দিয়ে ওই নারীকে ডেকে পাঠালে যাওয়ার পথে রাস্তায় আসিফ ইমতিয়াজের লোকজন তার ওপর হামলা করে। এতে তার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় গিয়ে মামলা করতে চেয়েও সাড়া পাননি বলে অভিযোগ ওই নারীর।
তিনি জানান, আসিফের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্ত কর্মকর্তা তাকে নানাভাবে হয়রানি করেছেন। তিনি বলেন, আসিফ ইমতিয়াজ তার নামে স্বাক্ষর জাল করে একটি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে সবকিছু মীমাংসা করার কথা রটাচ্ছেন। বিষয়টি আমি চ্যালেঞ্জ করে তদন্ত কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। তারা স্বাক্ষর এবং ওইদিন আমার অবস্থান নিশ্চিত করার বিষয়ে কোনো ধরনের প্রযুক্তির সহযোগিতা নেননি। এখন তিনি ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে সংশয়ে আছেন।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) ও তদন্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশীদ ১৪ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছে বিস্তারিত উল্লেখ করে প্রতিবেদনটি জমা দেন। ২৪৭ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে ভুক্তভোগী নারীর সঙ্গে আসিফ ইমতিয়াজের যোগাযোগের স্ক্রিনশট ও কথোপকথনের দুটি অডিও সিডি দাখিল করা হয়। সার্বিক মন্তব্যে প্রতিবেদনে তিনি বলেন, উভয়ের মধ্যে ২০১৮ সালের ১০ মার্চ নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে আপস-মীমাংসার একটি চুক্তিনামা সম্পাদিত হয়েছিল এবং সে অনুযায়ী আসিফ ইমতিয়াজের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা গ্রহণ করেছেন তিনি। সেহেতু তাদের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক ছিল মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলেও ডিএনসি করানোর বিষয়টি উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণ দিয়ে অভিযোগকারী প্রমাণ করতে সক্ষম হননি। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে অভিযোগকারীর নামে অ্যাকাউন্ট করার বিষয়ে আসিফ ইমতিয়াজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত। আসিফ ইমতিয়াজের মতো একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অভিযোগকারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করায় বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘এ ধরনের বিচার ফৌজদারি আদালতে হওয়া ভালো। কারণ চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী এর প্রতিকার খুব বেশি পাওয়া যায় না। এ ধরনের ঘটনায় কী শাস্তি হবে তা বর্তমান প্রশাসন ঠিক করবে। অভিযুক্ত কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতি, একধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া, কিছু সময়ের জন্য বেতন বন্ধ করতে পারে। আবার সর্বনিম্ন শাস্তি হিসেবে সতর্ক করেও মুক্তি দিতে পারে।’
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগ) মো. মনির উদ্দিন বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির প্রতিবেদন এখনো আমি দেখিনি। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারছি না।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩০তম ব্যাচের কর্মকর্তা ও তাহিরপুরের ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। আমি এ তদন্তের বিরুদ্ধে আপিল করব।’ ওই নারীর অভিযোগ সংক্রান্ত স্ক্রিনশট ও অডিও রেকর্ড হাতে থাকার কথা জানালে তিনি বলেন, ‘দেখেন এসব বানানো যায়। আমি এসবের কিছুই জানি না।’
সূত্র: দেশ রূপান্তর