চাকরি ‘ভাড়া’ দিচ্ছেন দুই সিটির পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : তখন সবে ভোর হয়েছে। রাজধানীর সেগুনবাগিচার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সামনে পাইওনিয়ার রোডে বেলচা দিয়ে আবর্জনা তুলছিল ১৩ বছরের কিশোর হানিফ বাদশা। তার পেশা- সারাদিন মাঝে মাঝে স্বল্পবিরতি দিয়ে রাস্তা থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করা। সাপ্তাহিক ছুটি না থাকায় প্রতিরাতেই কাজের শেষে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে হানিফ।
অথচ শ্রমিক আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে কাউকে দিয়ে দিনমজুরের কাজ করানো আইনত দণ্ডনীয় অপরাধের আওতায় পড়ে। তাই এরকম একটি অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কিশোর হানিফকে কাজ করতে দেখে এই প্রতিবেদক তার সাথে কথা বলে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিবেদকের সাথে কথা বলছিল হানিফ। কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসে তার পেশার বিভিন্ন অনিয়মের কথা।
হানিফ জানায়, প্রতিদিন ভোর ৫টা থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে সে প্রতিমাসে পায় মাত্র ৫০০ টাকা। সে বলে, “আমার নিজের খাবার নিজের যোগাড় করা লাগে। তাই অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য সারাদিন আবর্জনা পরিস্কার করার ফাঁকে রাস্তায় পড়ে থাকা বোতল সংগ্রহ করে বিক্রি করি।”
তবে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নথিপত্র অনুযায়ী হানিফকে করপোরেশন থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তারপরও গত কয়েক বছর ধরেই ‘বদলি’ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানায় সে।
তাকে এই ‘বদলি’র চাকরি দিয়েছেন সিটি করপোরেশন থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী। হানিফ বলে, “শুধু আমি না। আলাউদ্দিনও বদলি হিসেবে কাজ করে। ওই আমাকে এই চাকরির খবর দিয়েছিল।”
এতো কম টাকায় এই চাকরি কেন করে জানতে চাইলে হানিফ বলে, “মা-বাবা মারা যাওয়ার পর কাজ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। রাস্তার ফুটপাতেই ঘুমাতে হয় আমাকে।”
দুই সিটি করপোরেশনেই একই হাল
রাজধানীর উত্তর (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নানা জায়গায় ঘুরে এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সাথে কথা বলে একই চিত্র পাওয়া যায়।
ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির কার্যালয় থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের তালিকা পাওয়া যায়। ওই তালিকা থেকে জানা যায়, ডিএসসিসির আওতায় ৫ হাজারেরও বেশি এবং ডিএনসিসি’র প্রায় ২,৭০০ জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রতিদিন ২০%-২৫% পরিচ্ছন্নতা কর্মী কাজে অনুপস্থিত থাকেন। তাদের বদলি হিসেবে ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকায় লোক নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে বদলি বাণিজ্যের এই চর্চা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে।
করপোরেশন থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা সাধারণত অন্য কাজ কিংবা ব্যবসার কাজে যুক্ত থাকেন। আর তাদের স্থলে যারা বদলি হিসেবে কাজ করেন তাদের অধিকাংশই দেশের অপেক্ষাকৃত অর্থনৈতিক সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলো থেকে এসেছেন। এসব এলাকার দারিদ্র্যের হার ২১.৮%।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এই নিয়ম-বহির্ভূত কাজটি হাসিল করার জন্য সিটি করপোরেশনের কনজারভ্যান্সি ইন্সপেক্টরদের (সিআই) ঘুষ দিয়ে থাকেন। এই সিআই’রা টাকার বিনিময়ে হাজিরা খাতায় অনুপস্থিত কর্মীদেরও উপস্থিত হিসেবে দেখিয়ে থাকেন।
ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি’র হিসাবমতে, অস্থায়ী পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চুক্তিবদ্ধ প্রত্যেককে প্রতিদিন ৪৭৫ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি হিসেবে দেওয়া হয়। সেই হিসেবে তারা প্রতিমাসে সব মিলিয়ে ১৪,২৫০ থেকে ১৫,০০০ টাকা পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে সিটি করপোরেশন থেকে স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীরা মাসে ১৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। অথচ হানিফ দুইবেলা কাজ করে প্রতিমাসে পায় মাত্র ৫০০ টাকা।
ডিএসসিসি’র পরিচ্ছনতাকর্মীদের তালিকানুসারে, হানিফ সেগুনবাগিচার যেখানে কাজ করছিল ওই এলাকায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে ২ জনকে নিয়োগ দিয়েছে করপোরেশন। সেগুনবাগিচার ওই এলাকায় প্রতিদিন সকালে কাজ করার কথা সুখেন দে নামে এক ব্যক্তির। সন্ধ্যায় সেখানে ইমান আলি নামে আরেকজনের কাজ করার কথা। তবে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাদের দুজনের বদলে হানিফ একাই কাজ করে। সেগুনবাগিচার ওই এলাকায় পরপর কয়েকদিন যাওয়ার পরও সুখেন দে কিংবা ইমান আলির দেখা মেলেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাজাহানপুরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের এক পরিচ্ছন্নতাকর্মীও এই ‘বদলি’ প্রথা চালু থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “আগে আমিও ‘বদলি’ হিসেবে কাজ করতাম। পরে সিটি করপোরেশন থেকে নিয়োগ পাই।”
একই অবস্থা ১১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্যান্য এলাকাতেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার এক ‘বদলি’ জানান, তিনজনের স্থলে তিনি একাই কাজ করছেন। তিনি মারি আম্মা, আব্দুল কাদের ও বাবুল নামের ৩ কর্মীর ‘বদলি’ হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, “গত ৫ বছর ধরে আমি এই কাজ করছি। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দুই বেলা কাজ করে ৩ জনের কাছ থেকে আমি ৩ হাজার করে টাকা পাই।”
“তারা কাজে না আসলেও হাজিরা খাতায় তাদের উপস্থিত দেখানো হয়। সিটি করপোরেশনের কাজের বদলে তারা অন্য কাজ কিংবা নিজেদের ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন”, যোগ করেন তিনি।
ওই কর্মী আরও জানান, সিটি করপোরেশন কর্মী বাবুলের ঠাটারিবাজারে একটি পাখির দোকান ছিল। সেখানেই সে সময় দিতো।
এ ব্যাপারে রাজধানীর ঠাটারিবাজার এলাকার কয়েকজন দোকানির সাথে কথা হয়। তারাও জানান, ঠাটারিবাজারে বাবুলের একটি দোকান ছিল। সেখানেই সকাল থেকে ব্যস্ত থাকতেন তিনি।
এদিকে সিটি করপোরেশনের নথিপত্র থেকে জানা যায় এই ৩ জনের মধ্যে অনুপস্থিতির জন্য বাবুলের চাকরিই নেই। অথচ এই বিষয়ে বদলি হিসেবে কাজ করা এই কর্মী কিছুই জানেন না। বাবুলের জায়গায় ইয়াসমিন নামে একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাকেও কখনও কাজে দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সিআই অরুণের কাছে জিজ্ঞেস করা হলে ঘুষের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, “বদলি হিসেবে কাজ করার বিষয়টি সত্য। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বদলি হয় কর্মীদের নিজের পরিবারের সদস্যরা। “
কিন্তু পরিবারের বাইরের লোকদের বদলি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রমাণ রয়েছে জানালে তিনি সিটি করপোরেশন অফিসে যোগাযোগ করার কথা বলে ফোন রেখে দেন।
সিআই’দের ঘুষ বাণিজ্য
স্থায়ী পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে সিটি করপোরেশন থেকে নিয়োগপ্রাপ্তরা জানান অনুপস্থিত থেকেও হাজিরা খাতায় নাম উঠানোর জন্য সিআইদের নিয়মিত টাকা দিয়ে থাকেন তারা। এমনকি মাঝে মাঝে তারা মাসপ্রতি ঘুষ হিসেবে ৩ হাজার টাকা কিংবা এরও বেশি দাবি করে থাকেন বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বদলি।
জানা যায়, কেউ যাতে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে সেজন্য সিআই’রা বদলিদের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে বরাদ্দ পরিচ্ছনতাকর্মীদের ইউনিফর্ম সরবরাহ করে থাকেন।
একই অবস্থা ডিএনসিসি’র বিভিন্ন এলাকাতেও। ফার্মগেটের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের খামারবাড়ি এলাকায় মো. রফিকের ‘বদলি’ হিসেবে কাজ করেন মো. মফিজ। রফিককেও কখনও তার কাজের জায়গায় দেখা যায় না।
মিরপুর এলাকার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর জোনে কাজ করার কথা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নেতা হিসেবে পরিচিত নুরুল ইসলাম শিকদারের। তিনিও কখনও কাজে আসেন না। তবে, প্রতিমাসেই সিটি করপোরেশন থেকে বেতন তোলেন।
এ প্রসঙ্গে পরিচ্ছন্নতাকর্মী ফরহাদ বলেন, “এইসব দুর্নীতিবাজেরা এখন নেতা হয়ে গেছে। তারা কাজে আসবে না এটাই স্বাভাবিক।”
এই ৪ নম্বর ওয়ার্ডেই রয়েছে এইরকম অসংখ্য বদলি। ফারুক গাজীর বদলে সোহাগ গাজী; কোহিনুর বেগমের জায়গায় রুমা; রহিমা বেগমের পরিবর্তে ঝুমা- বদলি বাণিজ্যের এইরকম অসংখ্য ফাঁদের কবলে পড়ে দুই সিটি করপোরেশনের হাজারো কর্মী প্রবঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বদলির এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে।