আলোচিত

এবার সাংবাদিকরাও হামলার শিকার

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : যমুনা টেলিভিশন এবং দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিকদের ওপর সোমবার রাতে হামলা হয়েছে। সংবাদমাধ্যম দু’টির একই মালিক৷ আর মালিকের স্ত্রী হামলাস্থল, অর্থাৎ ঢাকার অদূরে নবাবগঞ্জে এলাকার সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী।

হামলায় জড়িতদের পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি। হামলায় দুই প্রতিষ্ঠানের অন্তত ১০ জন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। তাঁদের ১৭টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। দুই প্রতিষ্ঠানের ৪০ জন সাংবাদিক নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের কাজে সেখানকার একটি গেস্ট হাউজে অবস্থান করছিলেন। সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা রাত সাড়ে ১০টা থেকে পরবর্তী এক ঘণ্টা ধরে এই হামলা চালায়। তারা গেস্ট হাউজও ভাঙচুর করে৷ হামলার সময় সাংবাদিকরা পুলিশের সহায়তা চেয়েও পাননি বলেও অভিযোগ উঠেছে। সাংবাদিকরা জানান, পুলিশ অনেক পরে এসেছে।

যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার জাহাঙ্গির আলম হামলার সময় সেখানে ছিলেন। মঙ্গলবার বিকেলে তিনি বলেন, ‘‘দুর্বৃত্তরা চলে যাওয়ার পর আমরা রাতে আতঙ্কের মধ্যেই গেস্ট হাউজে অবস্থান করি। কোনো পুলিশ পাহারা ছিল না। এখন আমাদের গেস্ট হাউজেও এখন অবস্থান করতে দিচ্ছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে গেস্ট হাউজের মালিকককে গেস্ট হাউজ খালি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা গেস্ট হাউজ ছেড়ে দিচ্ছি। নবাবগঞ্জ প্রেস ক্লাবে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করব। তারপর সিদ্ধান্ত নেবো ঢাকায় ফিরব কিনা।”

মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান দু’টি প্রতিষ্ঠান থেকে একই আসনের নির্বাচন কাভার করতে যাওয়া ৪০ জন সাংবাদিকের ওপর এই হামলা প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘এই হামলা ন্যক্কারজনক এবং নিন্দনীয়। হামলার সময় পুলিশও সাংবাদিকদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল তাঁদের রক্ষা করা এবং নিরাপত্তা দেয়া৷ সেটা দেয়া হয়নি। সাংবাদিকদের স্বাধীন সাংবাদিকতা হুমকির মুখে পড়েছে।”

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিউল আলম ভুঁইয়া বলেন, ‘‘এই হামলার নিন্দা জানানোর ভাষা আমার নেই। সরকারের উচিত হবে হামলায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেপ্তার করা, তাদের আইনের আওতায় আনা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।”

নবাবগঞ্জ এবং দোহার উপজেলা নিয়ে ঢাকা-১ আসন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সালমান এফ রাহমান। তিনি নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন। ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপি’র প্রার্থী খন্দকার আবু আশফাকের প্রার্থীতা বাতিল হয়েছে। মোটর গাড়ি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন সালমা ইসলাম। আরো ৫ জন প্রার্থী থাকলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে সালমান এফ রহমান ও সালমা ইসলামের মধ্যে। সালমা ইসলাম যুগান্তর এবং যমুনা টিভির মালিকের স্ত্রী।

জাহাঙ্গীর আলম জানান তিনি হামলাকারীদের চিনতে পারেননি। ‘‘হামলাকারীরা ছিল মুখোশধারী। তাই আমরা দুর্বৃত্তদের চিনতে পারিনি। তবে ২৩ তারিখে আমরা গেস্ট হাউজে ওঠার পরই তার সামনে নৌকা প্রতীকের একটি নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। আমাদের ধারণা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের লোকজন হামলা চালিয়েছে।”

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা যুগান্তর ও যমুনা টিভির ৪০ জন সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের কাজেই গিয়েছি। কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচার বা কাজ করতে সেখানে যাইনি। আমাদের অফিস থেকে যেভাবে অ্যাসাইনমেন্ট দেয়, আমরা সেভাবেই কাজ করি। আমরা পেশাদার সাংবাদিক৷ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকজনও তো নির্বাচনি এলাকায় আছে।”

মানবাধিকার কর্মী নূর খানের মতে, ‘‘ওখানে সালমা ইসলাম একজন প্রার্থী। যুগান্তর এবং যমুনা টেলিভিশনের মালিক। আমি জানি না একটি হাউজের এত বেশি সংখ্যক সাংবাদিক ওখানে কেন গিয়েছিলেন। যে কারণেই যান না কেন, রাষ্ট্রের দয়িত্ব ছিল তাঁদের রক্ষা করা। সংবাদ কর্মীদের যেমন স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করা উচিত, কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থী বা দলের পক্ষে যেমন কাজ করা উচিত নয়, পাশাপাশি সংবাদকর্মীরা যখন আক্রান্ত হন, রাষ্ট্রের সবার আগে দায়িত্ব হলো তাঁদের সুরক্ষা দেয়া।”

শফিউল আলম ভুঁইয়া বলেন, ‘‘তাঁরা যদি সাংবাদিকতার কারণে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলে এটা এক ধরনের বিষয়। আমি বলবো, তাহলে স্বাধীন সাংবাদিকতা আক্রমণের শিকার হয়েছে। আর তাঁরা যদি কোনো রাজনৈতিক কারণে আক্রান্ত হন বা কোনো প্রার্থীর পক্ষের লোক হিসেবে আক্রান্ত হন, তাহলে সেটা আরেকটি বিষয়। সেটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর হামলা করে। তবে সেই হামলায় যারা জড়িত, তাদেরও তো গ্রেপ্তার করতে হবে। আইনের আওতায় আনতে হবে।”

তিনি আরো বলেন, ‘‘কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠান যদি কোনো একটি সংসদীয় আসনের খবর কাভার করতে ৪০ জন সাংবাদিক পাঠান, তাহলে বুঝতে হবে তারা ওই আসনটিকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিচ্ছেন। কেন দিচ্ছেন, সেটা তাদের বিষয়। আর সাংবাকিরা স্বেচ্ছায়, না অন্য কোনো কারণে গেছেন, তা ওই প্রতিষ্ঠানই বলতে পারবে। আমি বলবো, এই কারণে অন্য আসনগুলোর পাঠক বা দর্শক খবর থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।”

এদিকে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নবাবগঞ্জের গেস্ট হাউসে অবস্থানরত যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিকদের উপর সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। সংগঠন দু’টি এক বিবৃতিতে এ ঘটনাকে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক উল্লেখ করে এর সঙ্গে জড়িতদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে।

যৌথ বিবৃতিতে সাংবাদিক নেতারা বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের ওপর এ ধরনের হামলা সাংবাদিক সমাজকেই আতঙ্কিত করে। সাংবাদিকরা দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করে থাকেন। কিন্তু বিভিন্ন সময় তাঁদেরকে নানাভাবে হয়রানি-নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়, যেটা পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য হুমকিস্বরূপ। এর অবসান হওয়া জরুরি এবং এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত।

বিএফইউজে ও ডিইউজে নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলায় ১০ জন সাংবাদিক আহত হওয়া এবং ১৮টি গাড়ি ভাংচুরের বিষয়টি মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু তাই নয়, দীর্ঘসময় ধরে চলা সন্ত্রাসী হামলার সময় স্থানীয় পুলিশের ভূমিকাও সন্দেহজনক। পুলিশ এ ধরনের ঘটনার সময় সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বদলে নিশ্চুপ ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ সাংবাদিক সমাজসহ জনগণের কাম্য নয়। পুলিশের কাজ হলো শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেখানে পুলিশের স্থানীয় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফোন রিসিভ না করা মানে সন্ত্রাসীদের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতা করা৷ এটা কখনোই রাষ্ট্রের জন্য শুভ লক্ষণ নয়।

সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে নবাবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তফা কামালের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা তদন্ত করে দেখছি হামলার সাথে কারা জড়িত। তাদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হবে৷ আর তদন্তে এখনো আমরা ছাত্রলীগ-যুবলীগের জড়িত থাকার প্রমাণ পাইনি। সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মামলা হয়নি। তবে তারা মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন।”

পুলিশ সাংবাদিকদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি- এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা খবর পাওয়া মাত্রই ফোর্স পাঠিয়েছি৷ আমি একটা কাজে ঢাকায় থাকায় খবর পেতে একটু দেরি হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশে নির্বাচনি প্রচারণায় বিরোধী নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা অব্যাহত আছে৷ কয়েকটি ঘটনায় আওয়ামী লীগের অফিসে ভাঙচুর হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় ১৭ জেলায় ২১ টি নির্বাচনি আসনে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২২৬ জন আহত এবং ৪১ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। হামলার শিকারদের মধ্যে বিএনপি’র একজন নারীসহ চার জন সংসদ সদস্য প্রার্থী রয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে নূর খান বলেন, ‘‘গত ২৪ ঘণ্টায় যে চার জন প্রার্থী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যাহত হবে। এক ধরনের এনার্কির আশঙ্কা আছে। এতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হবে।’

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button