ঈদযাত্রায় সড়কে গেল ২২৪ প্রাণ
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : এবারের ঈদুল আজহায় যাতায়াতে দেশের সড়ক ও মহাসড়কে মোট ২০৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ২২৪ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ৮৬৬ জন। এছাড়া সড়ক, রেল ও নৌপথে সম্মিলিতভাবে ২৪৪টি দুর্ঘটনায় ২৫৩ জন নিহত ও ৯০৮ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। ঈদযাত্রায় এতসংখ্যক মৃত্যুর জন্য সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী যানবাহনের বেপরোয়া গতি, বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো এবং ঈদফেরত যাতায়াতে মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করেছেন।
অন্যদিকে এর জন্য সরকারের ভুল কার্যক্রমকে দায়ী করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক। তিনি এর জন্য শুধু ঈদ বা যেকোনো উৎসবের সময় গায়ে গতরে ঠেকা দেওয়ার কাজ না করে সড়কে সারা বছর নজরদারির ওপর জোর দিয়েছেন।
রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০১৯’ প্রকাশ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। ৪১টি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক এবং ১১টি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদ পর্যবেক্ষণ করে তারা এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ৬ আগস্ট থেকে ঈদ শেষে বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরা ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২ দিনে ২০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৪ জন নিহত ও ৮৬৬ জন আহত হয়েছে। একই সময় রেলপথে ১৭টি দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত ও ১৫ জন আহত হয়েছে। নৌপথে ২৪টি দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত, ৫৯ জন নিখোঁজ এবং ২৭ জন আহত হয়েছে।
গত বছরের তুলনায় এবার সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে দাবি করে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ঈদুল আজহায় ২৩৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৫৯ জন নিহত হয়েছে। তার তুলনায় এবার দুর্ঘটনা ৬ দশমিক ৪০ শতাংশ, নিহত ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ও আহত ১ দশমিক ৫০ শতাংশ কমেছে। তবে এবার ঈদের আগের চেয়ে ঈদের পরে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ঈদের আগের দিন ৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ জন মারা গেছে। আর ঈদের পরদিন ২৪টি দুর্ঘটনায় ২৬ জন নিহত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ঈদের পর সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। কারণ বাসচালক, যানবাহনগুলোকে বিরতি দেওয়া হয়নি। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, ঈদের আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে সড়কমন্ত্রী, র্যাব, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে ছিল। তবে ঈদের পরদিনই তার উল্টো চিত্র। সড়কে মনিটরিংয়ে কেউ ছিল না, সবাই ঘরে ঢুকে পড়েছে। সে সময় দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও হতাহতের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।’
এ বিষয়ে প্রায় একই মত প্রকাশ করেছেন ড. শামসুল হক। গণপরিবহন প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ এই অধ্যাপক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঈদের পর দুর্ঘটনা বেশি হয় এটা সরকারেরও জানা। তাদের কাছেও পরিসংখ্যান আছে। কিন্তু সরকার ভুল পথে আছে। ক্লান্ত-শ্রান্ত চালকরা তখন ফাঁকা রাস্তা পেয়ে দ্রুত পারাপারের জন্য বেপরোয়া হয়ে যায়। অনিয়ম বেশি করে। এ সময় প্রশাসনেরও নজরদারি কম থাকে। অথচ এই সময় নজরদারি প্রয়োজন বেশি।’
তিনি বলেন, ‘সড়কের সব অনিয়ম সারা বছরই চলতে দেওয়া হচ্ছে। ঈদ এলেই সরকার গায়ে গতরে ছুটি বন্ধ করে ঠেকা দেওয়ার কাজ করছে। এভাবে ঠেকা দেওয়ার কাজ হয়, টেকসই করা যায় না।’
বুয়েটের এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘ঈদের সময় যানবাহন বাড়ে, আনুপাতিক হারে দুর্ঘটনাও বাড়ে। কিন্তু সারা বছর নিবিড় নজরদারির মাধ্যমে এটাকে কমিয়ে আনা সম্ভব। বর্তমান সরকার যেহেতু একটি ধারাবাহিক সরকার, সেহেতু তারা ধাপে ধাপে পরিকল্পনা সম্পন্নের পর এখন বাস্তবায়নের পালায় ছিল। কিন্তু এরপরও সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সারা বছর নজরদারি হচ্ছে না। সরকার দুষ্ট চক্রের মধ্যে আছে। তাই সড়কের এই মহামারী কমছে না।’
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন মতে, এবারের দুর্ঘটনাগুলোর ৬৭টি ঘটেছে মোটরসাইকেলের সঙ্গে অন্যান্য যানবাহনের সংঘর্ষে, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৩ শতাংশ। মোট নিহতের ৩৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ ও আহতের ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ঘটেছে এসব দুর্ঘটনায়।
অন্যদিকে পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ। আগামী ঈদে এ দুটি ঘটনা এড়ানো সম্ভব হলে সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৮৫ দশমিক ২১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে জানায় সংগঠনটি।
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বিগত ঈদের চেয়ে এবার রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো। নৌপথে বেশ কিছু নতুন লঞ্চ বহরে যুক্ত হয়েছে। রেলপথেও বেশ কয়েক জোড়া নতুন রেল ও বগি সংযুক্ত হয়েছে। তবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য, যানজটের ভোগান্তি, রেলপথে শিডিউল বিপর্যয় ও টিকিট কালোবাজারি, ফেরি পারাপারে ভোগান্তিসহ নানা কারণে যাত্রী হয়রানি বেড়েছে।’
ঈদুল ফিতরের মতো এ ঈদে লম্বা ছুটি থাকায় যাত্রীসাধারণকে আগেভাগে বাড়ি পাঠানোর সুযোগ কাজে লাগানো গেলে ঈদযাত্রা আরও স্বস্তিদায়ক হতো বলে মন্তব্য করেন তিনি।