গত তিন দশকে রাজধানীর জলাধারের ৭২% ভরাট ও বেদখল
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : রাজধানীর মিরপুর সড়কের যেখানে এখন পান্থপথ গিয়ে মিলেছে, সত্তরের দশকেও সেখানে বাঁধা থাকত বড় বড় নৌকা। বেগুনবাড়ী খাল সেখান থেকেই শুরু হয়ে হাতিরঝিলে মিলেছিল। রামপুরায় এখন যেখানে স্লুইস গেটগুলো আছে, সেখানে নব্বইয়ের দশকেও বড় নৌকা আসত। বনশ্রীতে বেগুনবাড়ী খালের দুই পাশে বছরের এই সময়টাই কোমরপানি থাকত, এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো ভবন। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায়ও আগে প্রচুর জলাভূমি ছিল, সব ভরাট হয়ে গেছে এখন। গবেষণার তথ্য বলছে, গত তিন দশকে রাজধানীর জলাভূমিগুলোর ৭২ শতাংশই হয় দখল, নয়তো ভরাট হয়ে গেছে।
তিন দশকে রাজধানীর জলাশয়গুলোর রূপান্তর নিয়ে গবেষণা করেছেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইএসটি) দুই গবেষক। ‘এস্টিমেশন অব দ্য চেঞ্জেস ইন ওয়েটল্যান্ডস অব ঢাকা সিটি’ শীর্ষক এ গবেষণায় তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ল্যান্ডস্যাট স্যাটেলাইটের চিত্র। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের (ইউএসজিএস) কাছ থেকে সংগৃহীত ১৯৮৮, ২০০২ ও ২০১৬ সালের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রাজধানীর ২৫৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা এ গবেষণার আওতাভুক্ত ছিল। গবেষণাটির পরবর্তী ধাপ এখনো চলমান।
বিভিন্ন মানচিত্র ও স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকার জলাশয়গুলো খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। ১৯৮৮ সালে ঢাকায় মোট ভূমির ৪৩ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ছিল জলাশয় শ্রেণীভুক্ত। ২০০২ সালে এটি কমে দাঁড়ায় ২৬ দশমিক ৯ শতাংশে। আর সর্বশেষ ২০১৬ সাল নাগাদ জলাশয় শ্রেণীভুক্ত ভূমি কমে ১২ দশমিক ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
গবেষণার তথ্যমতে, ১৯৮৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪২ বর্গকিলোমিটার জলাশয়ের রূপান্তর ঘটেছে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত পরিবর্তনের এ ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। ২০০২-২০১৬ সময়ে ঢাকা থেকে ৩৮ দশমিক ৪ বর্গকিলোমিটার জলাভূমি হারিয়ে গেছে। আশির দশকের শেষ দিকে রাজধানীর পূর্ব ও পশ্চিম দিকেই বেশির ভাগ জলাভূমির অবস্থান ছিল।
২০১৬ সাল নাগাদ পূর্ব অংশে থাকা জলাভূমি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। রাজধানীর এ অংশে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবাসিক প্রকল্প হচ্ছে—বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, লেক সিটি কনকর্ড ও পিংক সিটি মডেল টাউন। রামপুরা ও বাড্ডায় গড়ে উঠেছে আফতাবনগরসহ আরো বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকা। রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমে নিচুভূমি ভরাট করে গড়ে ওঠা উত্তরা মডেল টাউন এখনো সম্প্রসারিত হচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমে জলাভূমি ভরাট করে গড়ে উঠেছে পিসি কালচার হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিংসহ আরো বেশকিছু আবাসিক এলাকা। নগরীর পূর্ব ও মধ্য অংশের মাঝখানে এখনো কিছু জলাশয় রয়েছে, যা ভবিষ্যতে কপোতাক্ষ গ্রিন সিটি ও জলসিঁড়ি আবাসনসহ অন্যান্য প্রকল্পের দখলে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে গবেষণায়।
গবেষকদের একজন এমআইএসটি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদ উর রহমান বলেন, এখন সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। আগে জলাভূমিগুলোতে এ পানি জমা থাকত। অথচ সেগুলোর অধিকাংশই এখন ভরাট হয়ে গেছে। জলাধার সংরক্ষণ করেও আবাসনের ব্যবস্থা করা যায়। যদিও অত্যধিক মানুষের চাপের কারণে জলাভূমিগুলোর দিকে সেভাবে নজর দেয়া হয়নি। জলাভূমি সংরক্ষণে নীতিমালা ও আইন থাকলেও সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। বিদ্যমান খাল ও জলাভূমিগুলোকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। এতে এখনকার থেকে কিছুটা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
গবেষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১৬ সাল পর্যন্ত গবেষণায় ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ দখল ও ভরাটের তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণাটির পরবর্তী ধাপ নিয়ে কাজ চলছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে রাজধানী ঢাকার ভূচিত্র নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। নগরায়ণ প্রক্রিয়া অতি দ্রুত হওয়ায় এ পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকায় খাল, ঝিল মিলিয়ে ছোট-বড় অসংখ্য জলাশয় ছিল। নগরের নিষ্কাশন ব্যবস্থায় এগুলোর যেমন ভূমিকা ছিল, তেমনি প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এসব জলাশয়। তবে ক্রমেই কমে আসছে জলাশয়গুলোর আকার-বিস্তৃতি। এর প্রভাবে প্রত্যক্ষভাবে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। পরোক্ষভাবে বাড়ছে উষ্ণতা, নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর।
পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, আমরা জলাভূমিগুলোকে জীববৈচিত্র্যের আধার বলে থাকি। বালু নদের পাশে বিল ছিল, ছিল জলাভূমি। সেখানে প্রচুর মাছও হতো। এসব জলাভূমির কারণে ঢাকা শহরে প্রচুর পাখি আসত। এখন আর আসে না। জলাভূমি কমে যাওয়ায় ঢাকার অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, জলাভূমি কমলে যা ক্ষতি হয়, তা-ই হয়েছে এখন। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে পানির স্তর নিচে যাওয়া।
ঢাকার জলাশয় নিয়ে পরিচালিত অন্য এক গবেষণার তথ্য বলছে, ১৯৬০ সালে জলাশয়ের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৯৫২ দশমিক শূন্য ২ হেক্টর। আর নিম্নভূমি ছিল ১৩ হাজার ৫২৭ দশমিক ৫৮ হেক্টর। অথচ ২০০৮ সালে রাজধানীতে জলাশয়ের পরিমাণ কমে ১ হাজার ৯৯০ দশমিক ৭১ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে এবং নিম্নভূমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪১৪ দশমিক ৫৮ হেক্টরে। অর্থাৎ ১৯৬০-২০০৮ সাল পর্যন্ত মোট জলাশয়ের পরিমাণ হ্রাস পায় ৩২ দশমিক ৫৭ শতাংশ ও নিম্নভূমির পরিমাণ হ্রাস পায় ৫২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। জলাশয় পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান এ ধারা ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার মারাত্মক পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, যার ফলে জলাবদ্ধতা সমস্যার মতো পরিবেশগত বিভিন্ন প্রভাব পড়ছে।
যদি জলাশয় পরিবর্তন বন্ধের জন্য সরকার এখনই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তবে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা শহর একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের শহরে পরিণত হতে পারে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, জলাভূমিগুলো যদি হারিয়ে যায়, বসবাসের জন্য আমাদের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার। এগুলো সংরক্ষণে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
জলাভূমি ভরাটের ফলে রাজধানী থেকে বিলীন হয়েছে ১০০-এর বেশি জলজ উদ্ভিদের প্রজাতি। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় জলজ এসব উদ্ভিদেরও ভূমিকা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, দ্রুত নগরায়ণের প্রভাবে রাজধানী থেকে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে। দখল কিংবা ভরাট হয়ে গেছে অনেক জলাধার। একসময় দেশীয় নানা প্রজাতির গাছ ছিল, যার অনেকগুলোই এ শহর থেকে হারিয়ে গেছে। এখন যেসব গাছ রয়েছে, তার অধিকাংশই বিদেশী। ঢাকা নগরী থেকে হারিয়ে যাওয়া দেশীয় প্রজাতিগুলোর মধ্যে সিংহভাই জলজ উদ্ভিদ।
এদিকে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের পরিবেশগত সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান হারে কমতে থাকলে ২০৩১ সাল নাগাদ ঢাকার অস্থায়ী সব জলাশয় হারিয়ে যাবে।
ঢাকার জলাভূমি আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, মহাপরিকল্পনায় জলাভূমিগুলো চিহ্নিত করা ছিল। ব্যক্তিমালিকানাধীন জলাভূমিগুলো রক্ষায় উদ্যোগ নেয়ার সুযোগ নেই বিদ্যমান পরিকল্পনায়। তবে ড্যাপের নতুন সংশোধিত খসড়ায় বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেসব খাল বেদখল হয়ে আছে, সেগুলো উদ্ধারের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। এটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
সূত্র: বণিক বার্তা