আলোচিত

প্যারোলেই মুক্ত হতে হবে খালেদা জিয়াকে?

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি নিয়ে এই বছরের মার্চ-এপ্রিল নাগাদ আলোচনা উঠেছিল। ওই সময় বিএনপির পক্ষ থেকে তা প্রত্যাখ্যান করে বলা হয়েছিল, দলীয় প্রধানের নিঃশর্ত মুক্তিই চায় তারা। ওই ঘটনার ঠিক দুই মাস পর শুক্রবার (২৬ জুলাই) এই আলোচনা আবার শুরু হয়েছে দলে ও দলের বাইরে। এদিন, বিকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘অবিলম্বে সরকারের কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি জানাচ্ছি। তার পছন্দ অনুযায়ী দেশে অথবা বিদেশে যেখানে তিনি চিকিৎসা করাতে চান, সেখানেই তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানাচ্ছি।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে আলাপকালে তারা দাবি করেন, খালেদা জিয়ার সম্মতি নিয়েই সরকারের প্রতি আবারও তার মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আহ্বান জানিয়েছেন মির্জা ফখরুল। গত ঈদের একদিন আগে সাক্ষাৎ করে আসার পর সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব আবারও খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতের সময় বিষয়টি সম্পর্কে খালেদা জিয়া তার মনোভাবের বিষয়ে জানান।

প্রসঙ্গটি নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের ভাষ্য, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত। সেক্ষেত্রে জামিন বা প্যারোলের বাইরে অন্য কোনও উপায়ে তাকে মুক্তির কোনও সম্ভাবনা নেই। দলের পক্ষ থেকে ন্যূনতম রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা এই মুহূর্তে অসম্ভব।

খালেদা জিয়ার পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) রাতে খালি পেটে খালেদা জিয়ার ডায়বেটিস ছিল ২২। এটা অব্যাহত থাকলে যে কোনও সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আগে তো একটু-আধটুকু হাঁটতে পারতে পারতেন, এখন একদম হাঁটতে পারছেন না। এই বিষয়গুলো গতরাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জানানো হয়েছিল। এই জন্য আজকে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তার স্বাস্থ্যের বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে।’

বিএনপির নীতি-নির্ধারণী ফোরামের এক সদস্য বলেন, ‘খালেদা জিয়ার কাছ থেকে মির্জা ফখরুল নিশ্চিত হয়েই বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে বলেছেন। খালেদা জিয়া তো এভাবে পড়ে থাকতে পারেন না। দল কোনও প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে, তাকে তো জেলে পচতে দেওয়া যাবে না। সেজন্য আমরা চাই, তিনি যেভাবেই হোক মুক্তি পান। চিকিৎসা নিন। জামিনের বিষয়টি তো সরকারের কাছে। সরকার না চাইলে কোর্ট জামিন দেবেন না। একইসঙ্গে খালেদা জিয়া মুক্তি না পেলে দলের সাংগঠনিক ঐক্যও ধরে রাখা সম্ভব না। খালেদা জিয়া জীবিত অবস্থাতেই পার্টি নিয়ে একটি শক্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সেজন্য তাকে প্রয়োজন।’

এক্ষেত্রে দ্বিমত আছে বিএনপির চেয়ারপারসন কার্যালয়ের দায়িত্বশীল একটি পক্ষের। এই পক্ষের পর্যবেক্ষণ, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে তার মুক্তির বিষয়টিকে সামনে আনতে হলে তার পরিবারের যুক্ত হওয়া অপরিহার্য। এছাড়া, তার মুক্তি নিয়ে বিএনপি কী চিন্তা করছে, খালেদা জিয়া নিজে কী ভাবছেন, সরকারের আচরণ কী হবে, তাও বিবেচনাযোগ্য বলে মনে করছে এই পক্ষটি।

দায়িত্বশীল এই সূত্রটির ভাষ্য, সরকারের কাছে আবেদন করে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত করবে, সেটা বিবেচনা করবে বিএনপি। এক্ষেত্রে নেতাদের একটি পক্ষ আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করছে। তবে সিনিয়র নেতাদের কেউ-কেউ খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে প্রভাব-প্রতিপত্তিতে সমস্যা তৈরি হবে ভেবে, এ প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকছেন।

সূত্রের দাবি, দলের স্থায়ী কমিটির নেতাদের মধ্যে কারও কারও ধারণা, মিনতি করেই হোক বা সরকারের নমনীয়তার কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া কারাগারের বাইরে থাকবেন, এটাই বড় প্রাপ্তি। এদিক থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আবেগের বিষয় আছে। তারা হয়তো মনে করেন, খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে সরকারের পতন হবে, দল চাঙ্গা হবে। কিন্তু এই বিষয়টি নির্বাচনের আগে হলেও ভিন্ন চেহারা থাকার সম্ভাবনা থাকলেও এই মুহূর্তে একেবারেই হচ্ছে না। নিশ্চিতভাবেই খালেদা জিয়া দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে গেলে মুক্তির বিষয়টি বাস্তবে রূপ পাবে।

ছয় মাস আগে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্যারোলের আবেদনের বিষয়টি নিজে থেকেই উত্থাপন করেছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুবু হোসেন। এই সঙ্গে শুক্রবার (২৬ জুলাই) তিনি বলেন, ‘আমি তো ছয় মাস আগে তার চিকিৎিসার জন্য প্যারোলে মুক্তির কথা বলেছিলাম। কিন্তু তিনি তখন রাজি হননি। আমাদের মধ্যে অনেকে রাজি হননি। তারা ধারণা করেছিলেন, খালেদা জিয়াকে জামিনেই মুক্ত করবেন। আমি তো সব সময়ই বলেছি, খালেদা জিয়ার এই মামলা রাজনৈতিক মামলা। রাজনৈতিক কারণেই তাকে জেলে নেওয়া হয়েছে। এখন তার জীবনরক্ষা করাটাই জরুরি ব্যাপার। সে কারণেই আমি প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এরআগে, শেখ হাসিনা ও আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেবও প্যারোলে নিয়ে বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন।’

খন্দকার মাহবুব হোসেন মনে করেন, ‘এখনও বিষয়টা নির্ভর করে খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি চাইলে দরখাস্ত করতে হবে, সরকার আবেদন অনুমোদন করবে। এ কারণেই দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হতে হবে, না হলে তো হবে না।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, প্যারোলের বিষয়টি হোক বা বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের বিষয়টি হোক, উভয় পরিস্থিতিতেই খালেদা জিয়ার সম্মতি লাগবে। এর ন্যূনতম প্রক্রিয়া কেমন হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা হতে হবে।

দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘আন্দোলন ছাড়া কোনোভাবেই খালেদা জিয়ার মুক্তি নিশ্চিত হবে না।’

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র মনে করে, কর্মীদের চাপের কারণে বর্ষার সময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে বিভাগীয় সমাবেশ করতে হচ্ছে। কর্মসূচি না দিলে নেতাকর্মীরা কেন্দ্র্রীয় নেতাদের অপমান করতেন, এমন আশঙ্কা থেকে তারা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির জেলা, মহানগর ও তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠন অনেক দুর্বল বলে কার্যকর কোনও প্রতিরোধ গড়ে তোলা এই মুহূর্তে অসম্ভব।

বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান মনে করেন, ‘নানা কারণে দেশের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক থাকায় সরকার বিএনপির প্রধানকে মুক্তির বিষয়ে ইতিবাচক অবস্থানে যেতে পারে।’

সম্প্রতি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রভাবশালী একনেতা বলেন, ‘বিএনপির আচরণে মনে হচ্ছে, খালেদা জিয়া মুক্ত হচ্ছেন।’

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপির চেয়ারপারসনকে সরকার কোর্টের মাধ্যমে আটকে রেখেছে, এটা তো অন্ধ লোকও বুঝতে পারে। সরকার যদি কালকে বলে, তাহলে কালই বেল হয়ে যাবে। প্রায় সব মামলায়ই বেল হয়ে রয়েছে।’

প্যারোলের বিষয়ে মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘‘এটার চিন্তা থেকে আমরা বলিনি। এটা প্রধানমন্ত্রী নিজেই লন্ডনে বলেছেন যে, ‘তারেক রহমান বাড়াবাড়ি করলে সারাজীবন তার মা জেলে থাকবেন’। সুতরাং জেলে তো রাখছেন প্রধানমন্ত্রী। ফলে, তিনি যদি মনে করেন, তাহলে একদিনেই দুইটি মামলায়ই জামিন হবে।’’

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে আছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পরে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ বাতিল চেয়ে করা আপিলে সাজা ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করেন উচ্চ আদালত। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে ৩৩ টি মামলা চলছে।

শুক্রবার (২৬ জুলাই) খালেদ জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থার ভয়াবহ অবনতি হয়েছে বলে জানান মির্জা ফখরুল। গত ১৭ মাসে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার ভয়াবহ অবনতি হয়েছে দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি কারাগারে যাওয়ার সময় অত্যন্ত সুস্থ অবস্থায় পায়ে হেঁটে গেছেন। এখন তিনি হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারছেন না।’

বিএনপির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চেয়ে একাধিকার যোগাযোগ করা হলেও বিএসএমএমইউ’র ডিজিকে পাওয়া যায়নি। পরে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য বিষয়ে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের চিকিৎসক, কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার তানজিলা পারভিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি মন্তব্য প্রদানে অনিচ্ছার কথা জানান।

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button