গাজীপুর

জালিয়াতির ‘মাস্টার’ এক সাব-রেজিস্ট্রার, জমি লিখে নিতে মালিককে অপহরণ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কালীগঞ্জের মঠবাড়ী গ্রামের কলেজছাত্র প্রভাস রোজারিওকে এক বছর আগে ৫ অক্টোবর অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হোটেলে।

এরপর অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে দলিলে স্বাক্ষর ও টিপসই নেয় অপহরণকারীরা। পরদিন সকালে তাকে বাড়ির পাশের রাস্তায় ফেলে যায়। খোঁজ নিয়ে প্রভাস জানতে পারে, তার স্বাক্ষরে স্থানীয় দীপু মিত্রের নামে ৬২ দশমিক ০২ শতাংশ জমি লিখে নেয়া হয়েছে। জোর করে স্বাক্ষর ও টিপসই নেয়ার সময় কালীগঞ্জের তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডলের পক্ষে নকলনবিশ হাফিজ উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

পরে ওই জমি কমিশনে রেজিস্ট্রি করা হয়। রেজিস্ট্রির সময় সাব-রেজিস্ট্রারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নকলনবিশ সমর কুমার ধর। অপহরণ থেকে শুরু করে পুরো ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন সাবরেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডল। বর্তমানে তিনি নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় কর্মরত।

শুধু এ ঘটনা নয়, জাল দলিলের মাধ্যমে জমি বিক্রির পর ওই জমি রেজিস্ট্রির মতো একাধিক ঘটনার নেপথ্য কারিগর এছহাক আলী মণ্ডল। কালীগঞ্জে তিনি জালিয়াতির ‘মাস্টার’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

প্রভাবশালী অপরাধী চক্র তার সঙ্গে সখ্য গড়ে জাল দলিল তৈরি করত। ৬৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টার ঘটনায় এ বছরের ২৬ অক্টোবর কালীগঞ্জ থানায় এছহাক মণ্ডলসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী মতিউর রহমান। সরেজমিন অনুসন্ধান, স্থানীয় সূত্র, মামলার নথি ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রভাস রোজারিওকে অপহরণ করে জমি হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় ওই সময় কালীগঞ্জ থানায় মামলা হয়েছিল। মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে। শিগগিরই সাবরেজিস্ট্রার এছহাক মণ্ডলসহ অন্য আসামিদের বিরদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হবে। সম্প্রতি দায়ের করা মতিউর রহমানের মামলার অভিযোগেরও প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে।

প্রভাস রোজারিওর মামলা প্রসঙ্গে কালীগঞ্জ থানার ওসি আলম চাঁন বলেন, জালিয়াতির সঙ্গে সাবরেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডলের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হবে।

এদিকে কালীগঞ্জ থানায় মতিউর রহমানের করা মামলার তদন্ত করছে গাজীপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই গোলাম কিবরিয়া বলেন, জাল দলিল তৈরি করে জমি হাতিয়ে নেয়ার যে অভিযোগ বাদী করেছেন, তদন্তে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডল জালিয়াতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, এটা প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডলের মোবাইল ফোনে বৃহস্পতিবার যোগাযোগ করা হলে তিনি নেটওয়ার্কের সমস্যার কথা জানান। বলেন, এখানে নেটওয়ার্কের সমস্যা রয়েছে। পরে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব। তারপর একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

শনিবার আবারও এছহাক আলী মণ্ডলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অভিযোগের বিষয়বস্তু লিখে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি। এ দিন সন্ধ্যায় টিএন্ডটি নম্বর থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন। এবার বলেন, আমি জার্নিতে, পরে কথা বলব। পরে আর তিনি কোনো সাড়া দেননি।

নকলনবিশ হাফিজ উদ্দিন বলেন, ফার্মগেটের একটি হোটেলে প্রভাস স্বেচ্ছায় দীপু মিত্রের সঙ্গে জমির বায়না করেন। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। তাকে কোনো ধরনের জোর করা হয়নি। তাকে কেউ অপহরণও করেনি।

এদিকে কমিশনে জমি রেজিস্ট্রির সময় সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডলের প্রতিনিধি ছিলেন সমর কুমার ধর নামে এক নকলনবিশ। তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। সরেজমিন রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।

অপহরণ ও জমি রেজিস্ট্রি : মামলার নথি থেকে জানা যায়, প্রভাস রোজারিও গত বছরের ৫ অক্টোবর সকালে কলেজে যাওয়ার উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়। উলুখোলা-ভুলতা মহাসড়কে সে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। এ সময় একটি মাইক্রোবাসে করে দীপু মিত্র, তরুণ টমাস রোজারিও, স্বপন মিয়া, বাবু চার্লস রোজারিও, ইয়াছিন মিয়া, মজিবরসহ কয়েকজন তাকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে। ফার্মগেটের একটি হোটেলে জোর করে আমমোক্তারনামা দলিলে স্বাক্ষরের পর প্রভাসকে বাড়ির পাশে ফেলে যায় তারা।

প্রভাস রোজারিও ভয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, মামলার এজাহারে সব উল্লেখ করেছি। আমি নতুন করে কিছু বলতে চাই না।

অভিযোগের বিষয়ে দীপু মিত্র ও মজিবরের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করে মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তরুণ টমাস রোজারিও কোনো কথা বলতে রাজি হননি। বাবু চার্লস কল রিসিভ করেননি। তাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, জোর করে দলিলে স্বাক্ষর নেয়ার পর প্রভাস রোজারিও কালীগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডলের কাছে ছুটে যায়। এছহাক আলী তাকে অভিযোগ দিতে বলেন। অভিযোগ দেয়ার পর কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ওই জমি রেজিস্ট্রি করার উদ্যোগ নেন এছহাক মণ্ডল। পরে ওই জমি রেজিস্ট্রি হয়।

জাল দলিলে জমি বিক্রি : জাল দলিল তৈরি করে জমি হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টার ঘটনায় ২৬ অক্টোবর কালীগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন ভুক্তভোগী মতিউর রহমান। মামলার নথি, রেজিস্ট্রি অফিস ও প্রকৃত দলিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেলোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তি ভুয়া দলিল তৈরি করে ৬৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ জমি হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে। ওই জমি কাওছার নামে এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয় দেলোয়ার। জমি রেজিস্ট্রি হয় সাব-রেজিস্ট্রার এছহাক আলী মণ্ডলের কক্ষে। ওই জমির প্রকৃত মালিক আফাজ উদ্দিন। তিনি মারা যাওয়ায় এখন ওয়ারিশ সূত্রে ওই জমির মালিক মতিউর রহমানসহ কয়েকজন। ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে মতিউর রহমান মামলাটি করেন।

মামলার বাদী মতিউর রহমান বলেন, এছহাক আলী মণ্ডল এ ধরনের জালিয়াতি এর আগেও করেছেন। তিনি অপরাধী চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে পরিকল্পিতভাবে জালিয়াতি করছেন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কালীগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার থাকাকালীন রেজিস্ট্রি অফিসে এছহাক আলী মণ্ডল ঘুষের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। নকলনবিশ হাফিজ ও সমরের মাধ্যমে তিনি দলিল গ্রহীতাদের কাছ থেকে সরকারি ফি’র বাইরে অতিরক্ত অর্থ আদায় করতেন। অর্থ ছাড়া সেখানে সেবা মিলত না। গত জুনে তিনি কালীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় বদলি হন।

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button