আলোচিত

সড়ক আগের মতোই বিশৃঙ্খল

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : নিরাপদ সড়কসহ নয় দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের অভুতপূর্ব আন্দোলনের এক বছর পার হতে চললেও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। আন্দোলনের মুখে সব দাবি মেনে নিলেও দীর্ঘমেয়াদি দাবি বাস্তবায়নে তেমন উদ্যোগ নেই।

গত বছরের ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আবদুল করিম রাজীব নিহত হওয়ার পর সারাদেশে আন্দোলন দানা বাঁধে।

সারা জাগানো ওই আন্দোলনের নয় দফা মধ্যে প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার নির্মাণ, ফিটনেসবিহীন ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালানো বন্ধ এবং বাসে অতিরিক্ত যাত্রী বহন বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের।

এক বছরের মাথায় দাবিগুলোর বাস্তবায়ন কতদূর হয়েছে, এমন প্রশ্নে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘‘গত বছর যে আন্দোলন হল, তারপরে প্রয়োজন যা ছিল, আমরা যেগুলো করেছি, একটা আইন হয়েছে, কিন্তু আইনের প্রয়োগ হয়নি এখনো পর্যন্ত৷ তার মানে এখনো পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নাই।”

‘‘দ্বিতীয় যে বিষয় ছিল, বাস রুটকে রেশনালাইজেশন করা… এখনো পর্যন্ত কিন্তু মিটিংয়ের পর মিটিং চলছে, এটারও কোনো সুফল নাই৷ বাস্তব পক্ষে একটা আইওয়াশই বলতে পারি। টুকটাক কিছু হয়েছে, আবার আগের মত চলছে। যেটা আমার লংটার্ম বা টেকসই পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন, সেগুলো কিছু হচ্ছে না। আমি মনে করব যে, সময় চলে যাচ্ছে,” বলেন এই গবেষক।

জুলাইয়ের শেষ ও আগস্টের শুরুর ওই আন্দোলনে সড়কে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা অবতীর্ণ হয় পুলিশের ভূমিকায়; শুরু করে চালকের লাইসেন্স ও যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা। শুরুতে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হলেও এক পর্যায়ে তৈরি হয় উত্তেজনা, ঘটনাপ্রবাহ গড়ায় সহিংসতায়।

বিক্ষোভের মধ্যে কয়েকটি স্থানে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ চড়াও হয় পুলিশ, তাদের সঙ্গে কোথাও কোথাও যুবলীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরাও হামলায় অংশ নেয় বলে অভিযোগ ওঠে।

এই আন্দোলনের মুখে সরকার সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। মন্ত্রিসভায় পাস করা হয় দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা সড়ক নিরাপত্তা আইনের খসড়া।

এরমধ্যে গত মার্চে রাজধানীর বসুন্ধরা গেট এলাকায় রুট পারমিবিহীন একটি বাসের চাপায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হলেও আবারও আন্দোলেন নেমেছিল শিক্ষার্থীরা৷

সে সময় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছিলেন, ‘‘মেধাবী ছাত্র আবরারের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরা রাস্তায় শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারিনি। এই ব্যর্থতা আমাদের সবার। এর দায়ভার কেউ এড়াতে পারেন না। আমরা কেউ চাই না এ রকম দুর্ঘটনা হোক।”

কয়েক বছর ধরে ঝুলে থাকা সড়ক পরিবহন আইনের খসড়াটি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত ৬ অগাস্ট মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে বিলটি পাস হলে পরিবহন শ্রমিক ও মালিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।

পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে আইনটি কার্যকরে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিন মন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেয় সরকার। কিন্তু কয়েক মাসে তাদের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায় নি।

গত এপ্রিলে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১১১টি সুপারিশ উপস্থাপন করে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল। কিন্তু এখনো সেগুলো বাস্তবায়নে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সুপারিশ প্রণয়নের অন্যতম অংশীদার দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান সাইফুন নেওয়াজ।

তিনি বলেন, ‘‘সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সবসময় দেখা যায়, সুপারিশগুলো দিয়ে আসা হয়। গত ২৮ এপ্রিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে ১১১ টি সুপারিশ দেওয়া হয় জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের মাধ্যমে যেখানে বুয়েটের থেকেও কিন্তু সুপারিশগুলো ছিল। এরপরেও বাস্তবায়নের বিষয়ে যে উদ্যোগটা থাকা প্রয়োজন ছিল, সেটা কিন্তু আসলেই নাই। এখানে কিছু সুপারিশ ছিল ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে, সে সময়টা কিন্তু এখন চলে যাচ্ছে।”

সাইফুন নেওয়াজ আরো বলেন, ‘‘২০২৪ সালের মধ্যে ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা কমানো ও সড়কের শৃঙ্খলা অনেকাংশে ফিরিয়ে আনা যেত। এই বিষয়ে এখনো পর্যন্ত বাস্তবধর্মী কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি।”

সুপারিশগুলোর ইতিবাচক দিক উল্লেখ করে এই গবেষক বলেন, ‘‘যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে, তার বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে সেটা একে একে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং ওই সুপারিশটা বাস্তবায়ন হলে কত শতাংশ দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব, কি কি টাইপের দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব, সেটাও উল্লেখ করা রয়েছে। এই জায়গাতে এই প্রথম একটা খুব প্রফেশনাল সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া হয়েছে। যেখানে প্রত্যেকটা আইটেম ধরে ধরে দেওয়া আছে, কোনটায় কোন ধরনের দুর্ঘটনা কমানো হবে, কারা কাজ করবে, কত সময়ের মধ্যে কাজ করতে হবে এবং তাদের চ্যালেঞ্জগুলো কি কি, সমস্ত কিছুই কিন্তু সেখানে আছে৷ আমি মনে করি, এই জায়গাতে উদ্যোগ গ্রহণটা খুবই জরুরি।’‘

তিনি আরো বলেন, ‘‘২০১৯ সালের মধ্যে ৫০টা সুপারিশ বাস্তবায়ন করার যোগ্য এবং সম্ভব। করতে হবে। সে জায়গাতে এখনই যদি উদ্যোগ না নেওয়া হয়, প্রথমে কিন্তু আমরা ফিফটি পার্সেন্ট পিছিয়ে পড়লাম। ১১১টি সুপারিশ আমরা ২৮ এপ্রিল যখন প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দিই, এরপরে মন্ত্রণালয়ে হয়ত দুটো মিটিং হয়েছে, কারা কারা বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু সুপারিশ প্রণয়নের সাথে যারা জড়িত এবং বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে কোনো সমন্বয় হয় নাই৷ আমি বলব, এই সমন্বয়টা খুব জরুরি।’’

কমপ্রোমাইজ করা চলবে না: ইলিয়াস কাঞ্চন

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসাবে দেখলেও সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে হুঁশিয়ার থাকার আহ্বান জানিয়েছেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন।

তিনি বলেন, ‘‘একটা চেইঞ্জ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আবার একটু হতাশা তৈরি হতে পারে৷ ২০১২ সাল থেকে আইন নিয়ে কাজ হচ্ছিল, কিন্তু পাস হচ্ছিল না। এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পাস হয়েছে, রাষ্ট্রপতিও সই করেছেন। এটির মধ্যেও তারা এসে বাগড়া দিচ্ছে। বিশেষ করে, শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণ কমানোর জন্য। এটাই হল মূল দাবি তাদের। বিধি প্রণয়ন হতে পারে।

সরকারের নমনীয়তায় পদক্ষেপে সন্দিহান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আমার মনে হচ্ছে, সরকার ওদের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করতে পারে। যদি কমপ্রোমাইজ করে তাহলে আমাদেরতো কমপ্রোমাইজ করা চলবে না। আইনটিকে যদি জামিনযোগ্য করে ফেলা হয়, তাহলে আমরা আগে দেখেছি ২৭ বছরেও কোনো মামলার রায় হয়নি। এদিকে, চালকদের প্রশিক্ষিত করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগে সরকারের প্রশংসা করেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন। চালকদের প্রশিক্ষণ এবং পথচারীরা সচেতন হলে দুর্ঘটনা অনেকটা কমে আসবে বলে মন্তব্য করেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন।

সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে সরকারি উদ্যোগ জানতে ইতোমধ্যে রুল জারি করেছে হাই কোর্ট৷ সেটি এখনো শুনানির অপেক্ষায় আছে।

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button