আলোচিত

পাসপোর্ট করাতে পুলিশ ভেরিফিকেশন কতটা জরুরী

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দেশে পাসপোর্ট করাতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হতে হয় পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় — এমন অভিযোগ বহু মানুষের।

তবে অনেকের মতে, জাতীয় পরিচয়পত্র দেবার সময়েই যেহেতু নাগরিকদের পরিচয় যাচাই হচ্ছে এবং সে তথ্য কর্তৃপক্ষের ডাটাবেসে রক্ষিতও আছে – তাই পাসপোর্ট করানোর সময় আবার নতুন করে পরিচয় যাচাইয়ের দরকার আছে কি?

বিশ্লেষকদের অনেকেই এ প্রশ্ন তুলছেন এখন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবি’র ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন এমন মানুষের তিন-চতুর্থাংশকেই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হয়ে ‘ঘুষ বা নিয়ম-বহির্ভূত টাকা’ দিতে হয়।

যেকারণে ইতিমধ্যেই দুর্নীতি দমন কমিশন এবং টিআইবিসহ অনেক সংস্থা পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা তুলে দেবার প্রস্তাব করেছে।

জনভোগান্তি
নতুন পাসপোর্ট করতে গিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের শেষ নেই।

ঢাকার একজন ব্যাংকার সানজিদা কিবরিয়া বলছিলেন, চার বছর আগে যখন পাসপোর্ট করান, সে সময় তাকে বেশ বিব্রত হতে হয়েছিল।

“শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সদস্য যখন আমাদের বাসায় আসেন, আমি অফিসে ছিলাম। তিনি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে আমার এসএসসির সনদের সঙ্গে মিলিয়ে জন্মতারিখ ও অন্যান্য তথ্য মিলিয়ে নেন।”

এরপর আমার ভোটার আইডি কার্ডের তথ্য এবং বাড়ির বিদ্যুৎ বিল দেখে ঠিকানার ব্যপারে নিশ্চিত হন তিনি।”

“কিন্তু কাজ শেষ হবার পরে চা-বিস্কিট খেয়েও তিনি কিছুক্ষণ বসে থাকেন। আমার বাবা-মা বুঝতে পারেননি উনার হাতে কিছু দিতে হবে।

এক পর্যায়ে উনি নিজেই বলেন যে তাকে ‘কনভেন্স’ দিতে হবে।”

কনভেন্স বা যাতায়াতের ভাড়া হিসেবে হাতে টাকা তুলে দেবার পর স্থানত্যাগ করেন সেই কর্মকর্তা।

দন্ত চিকিৎসক কায়ফি আজমীর অভিজ্ঞতা একটু আলাদা।

পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় তিনিও বাড়িতে ছিলেন না। তথ্য যাচাই হয়ে যাবার পর বাড়িতে আসা কর্মকর্তাকে ‘বখশিশ’ দিতে রাজি হননি আজমীর শ্বশুর।

“এরপর একমাস পেরিয়ে যায়, দুই মাস পেরিয়ে যায় – আমার আর পাসপোর্ট আসে না।

আমি ও আমার স্বামী এক বন্ধুর মাধ্যমে পাসপোর্ট অফিসে যোগাযোগ করি, তারা জানান যে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট আসেনি।”

এরপর সরকারী কয়েকটি অফিস ঘুরে আরো প্রায় দেড় মাস পরে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছিলেন আজমী।

সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধরণের অভিযোগ হরহামেশা শোনা যায়।

এমনকি ২০১৬ সালে পাসপোর্ট ভেরিফিকেশনের জন্য একজন বিচারপতির বাসায় গিয়ে ঘুষ দাবি করার পর পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন এএসআই এর বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করেছিলেন সেই বিচারপতি।

এ বছরের মার্চে পরে ঐ এএসআইকে আদালত এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে।

এই ঘটনা নিয়ে সেসময় ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল।

পুলিশ ভেরিফিকেশন কী?
আবেদন পত্র হাতে পেয়ে প্রাথমিক কাজ শেষ করে পাসপোর্ট অফিস আবেদনকারীর তথ্য যাচাইয়ের জন্য পাঠায় পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ বা এসবি কার্যালয়ে।। জেলা পর্যায়ে হলে সেটা যায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে।

সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট থানার একজন উপ-সহকারী পরিদর্শক বা এএসআই, সহকারী পরিদর্শক বা সাব ইন্সপেক্টর কিংবা ইন্সপেক্টরকে তথ্য যাচাইয়ের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এরপর ঐ কর্মকর্তা তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে পাসপোর্ট অফিসে যে প্রতিবেদন পাঠান – সেটাই ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ নামে পরিচিত।

কতটা জরুরী পুলিশ ভেরিফিকেশন?
বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রথমে ব্যাংকে ফি জমা দিয়ে, একজন আবেদনকারী পাসপোর্ট ফর্ম পূরণ করেন।

এক্ষেত্রে সাধারণ অর্থাৎ এক মাস সময়ের মধ্যে, জরুরী অর্থাৎ সাত দিনের মধ্যে পাসপোর্ট পাবার ব্যবস্থা রয়েছে।

আর সে অনুযায়ী নির্ধারিত ফি জমা দিতে হয় ব্যাংকে। এরপর সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যুক্ত করে জমা দেন নিকটস্থ পাসপোর্ট অফিসে।

পরের ধাপ, পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং নির্ধারিত একটি সময়ের মধ্যে রিপোর্ট দেবার কথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এই রিপোর্ট পাওয়া সাপেক্ষে পাসপোর্ট ইস্যু করে পাসপোর্ট অফিস।

এ পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে নানা ধরণের হয়রানির অভিযোগ শোনা যায়।

কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুজ্জামান মনে করেন, এ ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

“রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রয়োজনে পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা থাকা দরকার। ধরুন কোন দুষ্কৃতিকারী অথবা কেউ আগে জাতীয় পরিচয়পত্র করেছে, পরে সে ব্যক্তি বিপথগামী হতে পারে। তাদের সম্পর্কে পুলিশ বা স্পেশাল ব্রাঞ্চ মারফত আমাদের তথ্য সংগ্রহ করতে হয়।”

“একজন ব্যক্তির পরিচয়পত্র করার পরে বর্তমান অবস্থা তো আর জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেসে সংরক্ষণ হয় না। এসব তথ্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যই প্রয়োজন।”

“না হলে হয়ত একজন অপরাধী পাসপোর্ট পেয়ে যেতে পারে এবং সে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারে।”

পাসপোর্ট অফিস কী বলছে?
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সোহায়েল হোসেন খান জানিয়েছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা সহজীকরণ করার জন্য তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কিছু সুপারিশ পাঠিয়েছেন।

ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় সভাও হয়েছে।

“এছাড়া পুলিশ ভেরিফিকেশন সহজ করার জন্য নতুন পাসপোর্টে একটা প্রক্রিয়া চলছে যে, কেউ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করার আগে প্রি-ভেরিফিকেশন করিয়ে নিতে পারে কিনা সে ব্যবস্থা চালু করার।”

এখন পাসপোর্টের পুরো ব্যবস্থাকে অন-লাইন করা গেলে এ ধরণের অভিযোগ আর থাকবে না বলে মনে করেন মিঃ খান।

পুলিশ ভেরিফিকেশন কি থাকবে?
ভোগান্তি ও হয়রানির অভিযোগের কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন এবং টিআইবিসহ অনেক সংস্থা পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা তুলে দেবার প্রস্তাব করেছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের যুক্তি পাসপোর্ট পেতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি দেয়া হয়।

সরকারী ডাটাবেসে রক্ষিত তথ্যের সঙ্গে আবেদনকারীর তথ্য মিলিয়ে দেখলেই যাচাই করা সম্ভব। নতুন করে পরিচয় যাচাই করার দরকার আদৌ নেই।

এক্ষেত্রে যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে তাদের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের পরিচয়পত্র যাচাই করে পাসপোর্ট দেয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

তবে, সামনের দিনে পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা থাকবে কি না, সেটি নির্ভর করবে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর।

তবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শহিদুজ্জামান মনে করেন, এজন্য পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পাঠানো সুপারিশ পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

 

সূত্র: বিবিসি

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button