গাজীপুর

ছয়মাস ধরে পরিকল্পনা করে হত্যা করা হয় শ্রীপুরের শিশু রাকিনকে

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ছাত্রকে অপহরণ ও ‍মুক্তিপণ আদায়ের জন্য গাজীপুরের শ্রীপুরে এক গৃহশিক্ষক ছয়মাস ধরে পরিকল্পনা করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্রকে অপহরণও করে, তবে মুক্তিপণ না পেয়ে ছাত্রকে গলাটিপে হত্যা করেছে ওই শিক্ষক। এই গৃহশিক্ষকের নাম পারভেজ শিকদার (১৮) ও নিহত শিশুটির নাম ইকবাল রাকিন (১০)।একটি মোবাইল রিচার্জের দোকানের ময়লার ঝুড়িতে পড়ে থাকা চিরকুটের সূত্র ধরে ওই শিক্ষক ও তার সহযোগীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। সহযোগীর নাম ফয়সাল আহম্মেদ (১৫)।

গত ৫ ডিসেম্বর শ্রীপুর থানার ফাউগান গ্রামে ইকবাল রাকিন (১০) নামে পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া শিশুকে হত্যা করা হয়। এবছর শিশুটি পিইসি পরীক্ষা দিয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের পর র‌্যাব তদন্ত করে জানতে পেরেছে তার গৃহশিক্ষক পারভেজ শিকদারই এক সহযোগীসহ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত। দ্রুত অনেক টাকার মালিক হওয়ার লোভে ভারতীয় চ্যানেলের অপরাধমূলক অনুষ্ঠান ক্রাইম পেট্রোল দেখে সে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটায়।

মোবাইল রিচার্জের দোকানের ময়লার ঝুড়ি থেকে হাতে লেখা একটি চিরকুটের নম্বরের সূত্র ধরে গত রবিবার (১৬ ডিসেম্বর) বিজয় দিবসের দিনে গ্রেফতার করা হয়েছে ওই গৃহশিক্ষক ও তার সহযোগী ফয়সাল আহম্মেদকে (১৫)। তারা দুজনেই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

সোমবার (১৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর কাওরানবাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম এই তথ্য জানান।

তিনি জানান, গত ৫ ডিসেম্বর বিকাল ৫ টার দিকে গাজীপুরের শ্রীপুর থানার ফাউগান গ্রামের সৈয়দ শামীম ইকবালের ছেলে সাদমান ইকবাল রাকিন অপহৃত হয়। এরপর তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ওইদিন রাতে রাকিনের মায়ের ছয়মাস আগে চুরি হওয়া মোবাইল ফোন থেকে শামীম ইকবালের মোবাইলে একটি ফোন আসে। কলদাতা জানায়, রাকিন তাদের কাছে আছে, তাকে পেতে হলে দশলাখ টাকা দিতে হবে।

সৈয়দ শামীম ইকবাল বলেন, ‘রাতে হঠাৎ রাকিনের মায়ের হারিয়ে যাওয়া মোবাইল নম্বর থেকে আমার ফোনে কল আসে। তারা আমাকে বলল, ‘রাকিন হারিয়ে যায়নি, তাকে অপহরণ করা হয়েছে। তাকে ফেরত নিতে হলে দশ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হবে।’ আমি তাদের ফোন পেয়ে হতবাক হয়ে যাই। বারবার ওই নম্বরে ফোন করি, কিন্তু তাদের নম্বর বন্ধ পাই। উপায় না পেয়ে পরের দিন আমি শ্রীপুর থানায় গিয়ে একটি অপহরণ মামলা করি। এরপর পুলিশ ও র‌্যাব তদন্ত শুরু করে। কিন্তু একসপ্তাহেও রাকিনের কোনও খোঁজ দিতে পারেনি। ১১ ডিসেম্বর তাদের বাড়ির ১৫০ গজ দূরের একটি বাঁশঝাড় থেকে রাকিনের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।’

র‌্যাব- ১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘ঘটনার পর থেকেই র‌্যাব ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে। ওই এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়। ভিকটিম পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তবে কোন সূত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। যে মোবাইল নম্বরটি থেকে ফোন দেওয়া হয়েছিল, সেটি ছয়মাস আগে চুরি হয়েছিল, তার কললিস্টেও কোন যোগাযোগ নম্বর পাওয়া যায়নি। তাই তদন্তটি চ্যালেঞ্জিং ছিল।’

যেভাবে রাকিনকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়

রাকিন এবছর পিইসি পরীক্ষা দিয়েছে। গত ৫ ডিসেম্বর বিকালে বাড়ির পাশের একটি মসজিদে আসরের নামাজ ও আরবি পড়া শেষে অন্যান্য শিশু ও কিশোরদের সঙ্গে খেলতেছিল। ফয়সাল তাকে পাখির বাসা দেখানোর কথা বলে, অদূরে একটি নির্জন বাঁশঝাড়ে নিয়ে যায়। পাখির বাসা আরও ভেতরে বলে শিশুটিকে বাঁশঝাড়ের আরও গভীরে নিয়ে যায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে পারভেজও যায়। তাকে বাঁশঝাড়ের ভেতরে আটকে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু জঙ্গলের ভেতরে তাকে আটকে রাখতে ব্যর্থ হয় তারা। তাই তাকে তাৎক্ষণিক হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ফয়সাল রাকিনকে মাটিতে ফেলে প্রথমে গলা টিপে ধরে। এরপর শিশুটির গৃহশিক্ষক তার শরীরের উপর উঠে গলাটিপে ধরে। দুজনে গলাটিপে ধরে রাকিনকে হত্যা করে লাশ সেখানে রেখে আসে।

যেভাবে খুনিদের গ্রেফতার করা হয়

পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ফয়সাল শিশুটির পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাওয়ার জন্য ছয়মাস আগে চুরি করে আনা রাকিনের মায়ের মোবাইল ফোনটি দিয়ে ফোন করার চেষ্টা করে। কিন্তু ফয়সাল দেখে মোবাইলে টাকা নেই। এরপর দুজন মিলে ফাউগান বাজারের রনি নামে এক ব্যক্তির ফার্মেসিতে যায়, এই ফার্মেসিতে মোবাইল ফোনেও রিচার্জ করা হয়। তবে তারা রিচার্জের জন্য মোবাইল নম্বর লেখা খাতায় নম্বর না লিখে ০.৫ বাই ২.৫ ইঞ্চি একটি ছোট্ট চিরকুটে নম্বর লিখে দিয়ে ২০ টাকা রিচার্জ করে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসে। এরপর রাকিনের বাবার মোবাইলে ফোন দিয়ে ফয়সাল দশলাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে দেয়।

অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘মুক্তিপণ চাওয়ার পর ওই মোবাইল নম্বরটি বন্ধ করে দেয়। আমরা কললিস্ট তুললাম, কিন্তু গত ছয়মাসে এই মোবাইল নম্বর ব্যবহৃত হয়নি। তবে ওই ফোন নম্বরটিতে একটি নম্বর থেকে ২০ টাকা ফ্লেক্সিলোড করা হয়েছে। আমরা প্রযুক্তির মাধ্যমে সেই বিষয়টি নিশ্চিত হলাম। এরপর সেই নম্বরটি চিহ্নিত করলাম। সেটি ফাউগান বাজারের একটি ফার্মেসি। আমরা দোকানে গেলাম। রিচার্জের জন্য নম্বর লেখা খাতাটির আমরা প্রতি পাতা দেখলাম, কোথাও ওই নম্বরটি নেই। এরপর ফার্মেসির মালিককে প্রশ্ন করলাম, কী কী প্রক্রিয়ায় রিচার্জ করা হয়, সে বলল, খাতায় লিখে, চিরকুটের মাধ্যমে এবং মুখেও অনেকে নম্বর বলে। এরপর তাকে বললাম, চিরকুট কী করেন, তিনি জানালেন, ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেন। এরপর আমরা ঝুড়িটি তল্লাশি করলাম সেখান থেকে চিরকুটটি পেলাম। এরপর আমরা রাকিনের স্বজন, প্রতিবেশী ও পরিচিতদের সবার সঙ্গে হাতের লেখা মেলাতে লাগলাম। চিরকুটের লেখার নম্বরটি তাদের আত্মীয় স্বজনের কারও সঙ্গে সেভাবে মিললো না, এরপর আমরা একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা করি। তাদের ডেকে ডেকে নম্বরটি লিখতে দেওয়া হয়, তখন ফয়সালের সঙ্গে মিলে যায়। তার বাড়িতে থাকা খাতার লেখার সঙ্গেও চিরকুটের সঙ্গে মিলে যায়। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ফয়সালকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পারভেজকেও গ্রেফতার করে র‌্যাব।’

তিনি বলেন, ‘তারা দুজনেই অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে। তাদের শ্রীপুর থানায় সোপর্দ করা হয়েছে।’

কেন এই হত্যাকাণ্ড

পারভেজ শিকদার ২০১৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে। এরপর শিমুলতলী কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ডিপ্লোমা করছে। সে মেধাবী। তার বাবা মানসিক ভারসাম্যহীন। মা গৃহিণী। দুইভাইয়ের মধ্যে পারভেজ বড়। রাকিনকে দুই বছর ধরে বাসায় গিয়ে পড়ায় পারভেজ। রাকিনকে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের জন্য ছয়মাস আগে রাকিনের মোবাইল নম্বরটি চুরি করে পারভেজ। ক্রাইম পেট্রোল অনুষ্ঠান দেখে দ্রুত টাকার মালিক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই এই অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে র‌্যাব তদন্তে পেয়েছে।

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button