জঙ্গিরা আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : কেবল আইএসপন্থীরাই নয়, আল–কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণ করা জঙ্গিরাও আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে জেএমবির সদস্যরা আল–কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছে, এমন তথ্য জানা গেছে। দেশের পুরোনো এই জঙ্গিগোষ্ঠী নতুন লক্ষ্য নিয়ে কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। গোপনে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে আনসার আল ইসলামও।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার জ্যেষ্ঠ একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে এসব কর্মকর্তা জানান, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবির বর্তমান শীর্ষ নেতা পলাতক সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন ভারতে বসেই একিউআইএসের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেছেন বলে তাঁরা ধারণা করছেন। এ ক্ষেত্রে জেএমবির কারাবন্দী আমির মাওলানা সাইদুর রহমানের এক মেয়ে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করছেন। সাইদুর রহমানের ওই মেয়েকে বিয়ে করেন একসময়কার জামায়াতুল মুসলেমিনের নেতা এজাজ হোসেন ওরফে সাজ্জাদ ওরফে কারগিল। বেশ কয়েক বছর আগে এজাজ সস্ত্রীক পাকিস্তান চলে যান।
পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন-এর খবর অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি করাচিতে পাকিস্তানি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এজাজসহ আল-কায়েদার চার জঙ্গি নিহত হন। এখন এজাজের স্ত্রী পাকিস্তানে আল–কায়েদার আশ্রয়ে রয়েছেন। তাঁর মাধ্যমে সালাহউদ্দিন আল–কায়েদার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তুলেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অবশ্য বছর দুয়েক আগে থেকেই জানা যাচ্ছিল, একিউআইএসের বাংলাদেশ শাখা হিসেবে দাবি করা আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে কারাগারে পুরোনো জেএমবির সখ্য গড়ে উঠেছে।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে উভয় জঙ্গিগোষ্ঠীর শীর্ষ নেতারা দীর্ঘদিন ধরে বন্দী রয়েছেন। সেখানে তাঁদের সম্পর্ক নিবিড় হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে এ–সংক্রান্ত দুই রকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, একটা সূত্রের দাবি, কারাগারে আনসার আল ইসলামের শীর্ষ নেতা জসীমুদ্দীন রাহমানীর কাছে বায়াত (নেতা মেনে আনুগত্য প্রকাশ) নিয়েছেন সালাহউদ্দিন। আবার আরেক সূত্রের দাবি, সালাহউদ্দিনের কাছে বায়াত নিয়েছেন জসীমুদ্দীন রাহমানী।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান বলেন, একিউআইএস ভারতে বেশ তৎপর। তাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি নতুন করে নজর দেওয়া হচ্ছে। একিউআইএসের তৎপরতা অনেকখানি বৃদ্ধি পাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
এ মুহূর্তে দেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে জেএমবি সবচেয়ে পুরোনো। ১৪ বছর আগে সারা দেশে ৬৩ জেলায় একযোগে ৫০০ বোমা ফাটিয়ে আলোচনায় আসা এই সংগঠনের সদস্যসংখ্যাও অন্য জঙ্গিগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি বলে ধারণা করা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমানসহ পাঁচ শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর হয় ২০০৭ সালে। এরপর আমির হন সাইদুর রহমান। তিনিও ৯ বছর ধরে কারাগারে। পুরোনো নেতাদের মধ্যে সালাহউদ্দিনই এখন জেএমবির মূল নেতৃত্বে। তাঁকেসহ তিন জঙ্গিকে ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে মুক্ত করে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। সেই থেকে সালাহউদ্দিন ভারতে আছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে। সেখানে বসেই তিনি জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, বাংলাদেশে র্যাব–পুলিশের টানা অভিযানের মুখে জেএমবি দেশে সুবিধা করতে না পেরে ভারতে সংগঠনের বিস্তার ঘটায়। ২০১৪ সালের অক্টোবরে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পর বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর ভারতে সেখানকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বিভিন্ন সময়ে জেএমবির বেশ কয়েকজন সদস্য গ্রেপ্তার হন।
‘সাহম আল হিন্দ’ নামক ইন্টারনেটভিত্তিক জেএমবির প্রচারমাধ্যমে ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে পলাতক জঙ্গি সালাহউদ্দিন বলেছেন, ‘আমরা যখন কাজ শুরু করি, তখন প্রথমত আমাদের টার্গেট ছিল বাংলাদেশকে নিয়ে। যার জন্য জামাহর নাম ছিল জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ। সংক্ষেপে জেএমবি। কিন্তু আমরা এই দীর্ঘ পথচলা পাড়ি দিয়ে এখন আর আঞ্চলিক কোনো তানজীমে (সংগঠন) সীমাবদ্ধ নই। বিভিন্ন রাষ্ট্রে আমাদের শাখা স্থাপন করেছি। যেমন জামাআতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া–জেএমআই। এ ছাড়া আরও কিছু ভূখণ্ডে কাজ চলছে। বর্তমানে আমাদের মূল জামাহকে (সংগঠন) “জামাআতুল মুজাহিদীন” হিসেবে প্রকাশ করছি।’
তবে ভারতে সাংগঠনিক বিস্তার ঘটালেও জেএমবির মূল দৃষ্টি বাংলাদেশেই। জঙ্গি কার্যক্রম প্রতিরোধে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, দেশে বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেও জেএমবি কোনো নেতৃত্বকাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। তারা অর্থসংকটে আছে। এ কারণে জেএমবি অনেক দিন ধরে ডাকাতিতে যুক্ত হয়েছে তহবিল সংগ্রহের নামে।
তবে আল–কায়েদার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের পর এখন নতুন করে জেএমবি এ দেশে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় আছে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। গত বছর মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে ব্লগার ও প্রকাশক শাজাহান বাচ্চুকে হত্যা করে সেটার জানান দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই হত্যার পর ইন্টারনেটে জেএমবির প্রচার সাইট ‘সাহম আল হিন্দ’–এ এর দায় স্বীকার করে জেএমবি। এ ছাড়া পীর, মাজার–খানকার মতো পুরোনো লক্ষ্যবস্তুতেও জেএমবি কয়েক বছর ধরে বিক্ষিপ্তভাবে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছে।
জঙ্গিরা বিচ্ছিন্নভাবে হামলা চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে গত রোববার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তবে তিনি বলেন, আগের মতো সক্ষমতা জঙ্গিদের নেই। হোলি আর্টিজান হামলার পরপরই দেশে থাকা জঙ্গি সংগঠনগুলোকে দুর্বল করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ঘাপটি মেরে আছে আনসার আল ইসলাম
এদিকে এদেশে আল–কায়েদাপন্থী হিসেবে পরিচিত সংগঠন আনসার আল ইসলামকে এ মুহূর্তে জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সংগঠিত বলে মনে করছেন জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা।
২০০৮ সালে জন্ম নেওয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম ২০১৩ সাল থেকে ব্লগার হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে। তাদের সর্বশেষ হত্যাযজ্ঞ ছিল ২০১৬ সালের এপ্রিলে রাজধানীর কলাবাগানে সমকামী অধিকারকর্মী ও মার্কিন দূতাবাসের কর্মী জুলহাজ মান্নান এবং তাঁর বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয় হত্যা।
জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করেন এমন ব্যক্তিদের মতে, আনসার আল ইসলাম ঘাপটি মেরে আছে। হামলার লক্ষ্যবস্তু থেকে তারা সরে আসেনি। সাম্প্রতিক সময়ে সংগঠনটির অনুসারীদের অনলাইনে তৎপরতা বেড়েছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, তাদের কথিত দাওয়াতি কার্যক্রমও থেমে নেই। যদিও বিভিন্ন সময়ে এই সংগঠনের অনেকে গ্রেপ্তার, কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।
আনসার আল ইসলামের কথিত সামরিক শাখার প্রধান চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক। তাঁকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই সংগঠনের তৎপরতা নজরদারি করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একজন কর্মকর্তার মতে, আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য ৪০ থেকে ৫০ জন হতে পারে। যাদের অনেকে প্রশিক্ষিত ও তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ। এদের সদস্যদের বড় অংশই শিক্ষিত। এ ছাড়া এদের বেশ কিছু অনুসারী আছে। এরা জেএমবির সঙ্গে যৌথভাবে নাশকতায় নামে কি না, সেটাই এখন বড় দুশ্চিন্তার কারণ।