গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা এক হাজার। এর মধ্যে চালু আছে ৭০০টি। এর বিপরীতে প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকে এর কয়েক গুণ। শয্যা সংকটে ভর্তি রোগীদের বেশির ভাগেরই স্থান হয় মেঝে কিংবা বারান্দায়। দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর মধ্যে শয্যাপ্রতি রোগীর চাপ এ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিন ২০১৮-এর তথ্যমতে, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেড অকুপেন্সি রেট বা শয্যাপ্রতি রোগীর হার প্রায় ২৩৯ শতাংশ।
ভর্তি রোগীর বাইরেও হাসপাতালটির জরুরি বিভাগের ওয়ান স্টপ সার্ভিসে প্রতিদিন সেবা নেয় এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ রোগী। বহির্বিভাগে আরো পাঁচ-ছয় হাজার রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয় হাসপাতালটিতে। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটির অবকাঠামো সক্ষমতার তুলনায় রোগীর এ চাপ বেশি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
হাসপাতালটির হূদরোগ বিভাগে শয্যা রয়েছে ৪০টি। সেখানে রোগী ভর্তি আছে ৩০০-এর বেশি। হাসপাতালের অর্থোপেডিকস সার্জারির ৯ নম্বর ওয়ার্ডে রোগীর চাপ এতটাই বেশি যে পা ফেলার জায়গা থাকে না। কখনো কখনো রোগীদের ডিঙিয়ে চিকিৎসকদের সেবা দিতে হয়। মেডিসিন বিভাগে শয্যা রয়েছে ১৫০টি। এর বিপরীতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭০০-এর মতো। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, সরকারি বরাদ্দের শতভাগ ওষুধ বিনামূল্যে সরবরাহসহ নামমাত্র ফিতে সব পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকায় রোগীর চাপ দিন দিন বাড়ছে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, সুচিকিৎসা নিশ্চিতের মাধ্যমে সরকারি এ হাসপাতালটির ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাজ করছি। উন্নত ও সহজ সেবা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে স্বল্প সময়ের মধ্যে ত্বরিত চিকিৎসা দিতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করেছি। ফলে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় ও ভোগান্তি কমেছে।
অবকাঠামোর তুলনায় রোগীর চাপ বেশি দেশের অন্য সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেড অকুপেন্সির হার ১০০ শতাংশের উপরে। কোনো কোনো হাসপাতালে এ হার আবার ২০০ শতাংশের বেশি।
রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালকেও। শয্যার তুলনায় রোগী ভর্তির হার অনেক বেশি। এক হাজার শয্যার এ হাসপাতালে ভর্তি থাকছে দুই-আড়াই হাজার রোগী। নগরীর ধাপ এলাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারের বিপরীতে ৬৫ একর জমিতে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালে ১০টি ব্লক রয়েছে। হাসপাতালের প্রায় ৪২টি ওয়ার্ড ও ৪৪টি কেবিনে প্রতিদিন ভর্তি থাকছে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার রোগী। এছাড়া প্রতিদিন পাঁচ-সাত হাজার মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে হাসপাতালে আসছে।
হাসপাতালটি এক হাজার শয্যায় উন্নীত হলেও অবকাঠামো ও লোকবল তেমন বাড়েনি। হাসপাতালে চিকিৎসকসহ প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের ২৬০টি পদ থাকলেও এর বিপরীতে কর্মরত আছেন ১৯৩ জন। ৬৭টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে জুনিয়র কলসালট্যান্ট ছয়জন, সহকারী রেজিস্ট্রারের ১৯, ডেন্টাল সার্জনের ১২ ও ইনডোর মেডিকেল অফিসারের ১২টি পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে।
ওয়ার্ডমাস্টার হাসান মাহমুদ বলেন, চিকিৎসক ও নার্সরা অনেক আন্তরিক থাকার পরও প্রতিদিন বাড়তি রোগীর চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
আশপাশের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষের জন্য চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির অন্যতম কেন্দ্র বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতাল। বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। ৫০০ শয্যার হাসপাতালটিতে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। শয্যা না থাকায় হাসপাতালের ওয়ার্ড, করিডোরের মেঝেতে স্থান করে নিতে হচ্ছে রোগীদের। সক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগীর কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রাপ্তি।
শজিমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ গোলাম রসুল বলেন, আমাদের হাসপাতালে রোগীর চাপ আছে। বহির্বিভাগ থেকে শুরু করে ওয়ার্ডে রোগীর চাপ প্রচুর। আমাদের যে বরাদ্দ ও জনবল আছে, তা দিয়েই সেবা দেয়া হচ্ছে। হাসপাতালের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। রোগীদের আরো উত্তম সেবা দিতে হাসপাতাল ভবন ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণের প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রস্তাবটি দেয়ার পর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা সরেজমিন দেখেছেন। ২০২০ সালের মধ্যে দেড় হাজার শয্যায় উন্নীত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
শয্যা সংখ্যায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল। ২ হাজার ৬০০ শয্যা থাকলেও রোগী অনুপাতে তা পর্যাপ্ত নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযাযী, এ হাসপাতালে বেড অকুপেন্সির হার ১৩৩ শতাংশ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ নিউরোসার্জারি বিভাগ। চারটি ওয়ার্ডে এ বিভাগে সেবা নিতে আসা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। এর মধ্যে ঢামেক হাসপাতালের পুরনো ভবনের নিচতলায় রয়েছে নিউরোসার্জারি বিভাগের ১০০ নম্বর ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডে নির্ধারিত শয্যা সংখ্যা ৫০। বারান্দায় যুক্ত করা হয়েছে অতিরিক্ত আরো পাঁচটি শয্যা। কিন্তু হাসপাতালের রেজিস্টারের তথ্যমতে, সোমবার ১০০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল ৭৫ জন রোগী। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগীদের স্থান হয়েছে মেঝেতে।
ঢামেক পুরনো ভবনের দোতলায় নিউরোসার্জারি বিভাগের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডেও নির্ধারিত শয্যা ৫০টি। বারান্দায় অতিরিক্ত যুক্ত করা হয়েছে আরো পাঁচটি শয্যা। এর বিপরীতে সেখানে রোগী রয়েছে ৭৮ জন।
নিউরোসার্জারি বিভাগের এ দুটি ওয়ার্ডের চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা ২০০ নম্বর ওয়ার্ডের। এ ওয়ার্ডের নির্ধারিত শয্যা সংখ্যা ১৯। বারান্দায় ও র্যাম্পে যুক্ত করা হয়েছে আরো ২৯টি শয্যা। কিন্তু সেখানে রোগী রয়েছে ৯৪ জন। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রোগীদের পুরো বারান্দা ও হাসপাতালের র্যাম্পে বিছানা করে চিকিৎসা নিতে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়। এর বাইরে ২০১ নম্বর ওয়ার্ডটি নিউরোসার্জারি বিভাগে পেইং বেড ওয়ার্ড।
হেলথ বুলেটিনের তথ্যমতে, সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর বেড অকুপেন্সির গড় হার ১৫৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তবে হাসপাতালভেদে এ হারে কম-বেশি আছে। ১ হাজার ৩১৩ শয্যার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ হার ১৯০ দশমিক ৩, ৫০০ শয্যার খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৬২ দশমিক ৮, এক হাজার শয্যার বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫৯ দশমিক ২, ৫০০ শয্যার কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫৬ দশমিক ৯, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫৬ দশমিক ৪ ও ৬০০ শয্যার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৫১ শতাংশ। এছাড়া ১ হাজার ২০০ শয্যাবিশিষ্ট রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেড অকুপেন্সির হার ১৪৫ দশমিক ৮, ৮৫০ শয্যার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩২ দশমিক ৭, ৫০০ শয্যার ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১৪ দশমিক ৫, ৫০০ শয্যার দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১২ দশমিক ৫ ও ২১৪ শয্যার গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেড অকুপেন্সির হার ১০৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে শয্যাসংকট কাটাতে এরই মধ্যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে পাঁচ হাজার শয্যায় উন্নীত করা হবে। অন্যান্য হাসপাতালেও শয্যার সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট জেলা হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হবে, যাতে মেডিকেল কলেজগুলোর ওপর চাপ কমে আসে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওপর চাপ কমিয়ে আনতে রাজধানীতেও বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলা হচ্ছে।
সূত্র: বণিক বার্তা