গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সচিবালয়ে গভীর রাতে ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বিদ্যুতের ‘ক্রুটি’ থেকে; প্রাথমিক তদন্তে অন্য কিছু বা ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি।
মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় তদন্ত কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর এ তথ্য জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বিদ্যুতের ‘লুজ কানেকশনের’ কারণে।
গত ২৫ ডিসেম্বর রাতে লাগা আগুনের কারণ অনুসন্ধানে একাধিক দল কাজ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ”বুয়েটের একটি বিশেষজ্ঞ দল ছিল, দমকল বাহিনীর যারা ফায়ার হ্যান্ডেল করে তাদের এক্সপার্ট ছিল, সেনাবাহিনী থেকে তাদের বোম্ব স্কোয়াড ছিল, তাদের বিশেষায়িত ককুরগুলো-ডগ স্কোয়াড তারাও কাজ করেছে। পুলিশের সিআইডি থেকে তারা কাজ করেছে।
“এরা সকলে মিলে একত্রে একটি বিষয়ে এক মত হয়েছি যে এটি একটি লুজ কানেকশনের কারণে ইলেকট্রিসিটি থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়েছে। এটি আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত। এতে অন্য কোনো ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা আমরা খুঁজে পাইনি।”
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায তদন্তে গঠিত আট সদস্যের এ তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে সন্ধ্যায় তদন্ত কমিটির প্রধান সংবাদিকদের সামনে আসেন।
গত ২৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে সচিবালয়ের সাত নম্বর ভবনে আগুন লেগে ষষ্ঠ থেকে নবম তলায় থাকা পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের দপ্তর পুড়ে যায়। এর মধ্যে অষ্টম ও নবম তলার অধিকাংশ নথি পুড়ে গেছে।
ভয়াবহ এ আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে পানির সরবরাহ লাইন সংযোগ দেওয়ার সময় ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মী ট্রাক চাপায় নিহত হন।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা সময় ধরে জ্বলা এ আগুন লাগার পর তা দুর্ঘটনা না কি নাশকতা সেই আলোচনাও সামনে আসে। সরকারের উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকেও ষড়যন্ত্র ও নাশকতার বিষয়টি সামনে আনা হয়। তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আগুনের সূত্রপাত্র ‘বৈদ্যুতিক গোলযোগ’ হিসেবে উঠে এল।
ভয়াবহ এ আগুনে ৭ নম্বর ভবনে থাকা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজ এখন সচিবালয়ের বাইরে বিভিন্ন ভবনে চলছে। এ ভবন চালু হতে সময় লাগবে বলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের নেতৃত্বে আট সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার।
কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে বলা হয়, যে সময়সীমা শেষ হয় সোমবার। পরে প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় একদিন বাড়িয়ে নেয় কমিটি।
বিফ্রিংয়ে প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া তথ্যগুলো তুলে ধরেন বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী। তিনি বলেন, “প্রথম দিন থেকে আমরা যথেষ্ট সময় নিয়ে আন্তরিকভাবে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় আমরা সুনির্দিষ্ট একটি রিপোর্ট তৈরি করতে পেরেছি। যদিও সুনির্দিষ্ট বলছি, তারপরও এটিকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করার জন্য আরও বেশ কিছু টেস্ট দেশে-বিদেশে করাব।
”আমরা স্যাম্পল পাঠিয়েছি। সে রিপোর্টগুলো পেলে আমাদের রিপোর্ট আরও নিশ্চিত হবে। প্রাথমিকভাবে আমরা দেখেছি, ভিডিও পাওয়ার আগে এবং পরে মিলিয়ে দেখেছি, ফলাফল একই।”
আগুনের সূত্রপাতের সময় রাত ১টা ৩২ থেকে ১টা ৩৯ মিনিটের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “সূত্রপাত একটি নির্দিষ্ট সময়ে নয়, সাত মিনিট ধরে আস্তে আস্তে ‘স্পার্কের’ মাধ্যমে যে জায়গায় আগুন লেগেছে সেটি গরম হয়েছে, সেখান থেকে ম্যাটেরিয়াল খশে খশে পড়েছে। তারপর সেটা একসময় ইগনিশন টেম্পারেচারে গিয়েছে। তারপর আগুন ধরেছে। আগুন ধরার সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়া হয়েছে এবং আগুনের ফ্লেম তৈরি হয়েছে।”
বুয়েটের এই শিক্ষক বলেন, আগুন ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। ধোঁয়া সচিবালয়ের একটি টানেলের প্রভাবে পশ্চিম দিক দিয়ে পূর্ব দিকে বেরিয়ে গেছে। এতে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়েছে আগুন দুই জায়গায়। বাস্তবে আগুনের উৎস ছিল একটিই। কিন্তু বাতাসের গতি, ভবনের নকশার ভিন্নতার কারণে দুই দিকে প্রবাহিত হয়েছে।
”মোটামুটি ১২-১৪ মিনিটে যে আগুন উৎপাদিত হয়েছে সেটি ছড়িয়ে চূড়ান্ত আগুনে রূপায়িত হয়েছে। ভার্টিকালি উপরে উঠে যাওয়ায় এটি নেভানো অত্যন্ত কঠিন পর্যায়ে চলে গেছে।”
২৫ ডিসেম্বর রাতের এ আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের ১০ ঘণ্টা সময় লাগে।
দশ তলা ওই ভবনেই অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ; শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ; পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ; ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দপ্তর রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম তলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অষ্টম ও নবম তলায় ক্ষতি হয়েছে বেশি, সেখানকার অধিকাংশ নথি পুড়ে গেছে।
ভবনের প্রকৃতির কারণে আগুন নেভানো কষ্টসাধ্য ছিল বর্ণনা করে অধ্যাপক হেলালী বলেন, ছয়তলার আগুন যখন ছড়িয়ে গেছে সেটি না নিভিয়ে সাততলায় যাওয়ার সুযোগ ছিল না। যার জন্য ফায়ার ব্রিগেডকে ছয়তলা শেষ করে সাততলায় উঠতে হয়েছে। নিরুপায় হয়ে, জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার ভয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তাদের এই কাজ করতে হয়েছে।
এ কারণে বাড়তি কিছু সময় লেগেছে বলে তিনি মনে করেন।
অধ্যাপক হেলালী বলেন, “ফায়ার অ্যানালাইসিস থেকে প্রাথমিক একটি প্রতিবেদন তৈরি করে পরবর্তী পর্যায়ে পুলিশের সিআইডি থেকে পাওয়া ভিডিওর সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি, আমাদের অঙ্ক করা জিনিস আর ভিডিও এভিডেন্স ৯৯ ভাগ মিলে গেছে। আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছি আগুন এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। এভাবেই প্রবাহিত হয়েছে।
”আগুন প্রাথমিকভাবে সচিবালয়ের উত্তর দিক থেকে দেখা গেছে, দক্ষিণ দিকে দেখা যায়নি। যেটা বাইরে থেকে সচিবালয় দেখি। বাইরে থেকে যখন দেখা গেছে তখন দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পরে। ততক্ষণে আগুন সচিবালয়ের দুইটা পয়েন্টে মনে হয়েছে। একটা ছয়তলা একটা আটতলার কোনায়। বাইরে থেকে মনে হয়েছে, দুই জায়গায় অনেক দূরে। কিন্তু আসলে ভেতরে এটা ইন্টারন্যালি কানেকটেড ছিল। এটা বাইরে থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়েছে।”
ফ্লোরে ‘মেলেনি বিস্ফোরক ‘
বিফ্রিংয়ে অগ্নিকাণ্ডে কারও অবহেলা আছে কি না এমন প্রশ্নে অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী বলেন, “আমাদের আইনে আছে প্রতিবছর বৈদ্যুতিক লাইনগুলো পরীক্ষা করা। কিন্তু সেটা ১০ বছরেও করি না। এটা ভুল।”
সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার আলামত সেনাবাহিনীর আইডি ফিউশন সেন্টারে পরীক্ষা করা হয়েছে জানিয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুব হাসান বলেন, পুড়ে যাওয়া ফ্লোরগুলোতে কোনো ধরনের বিস্ফোরক পাওয়া যায়নি। ডগ স্কোয়াড দিয়ে সার্চ করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস থেকে যে নমুনা পাওয়া গেছে তাতেও কোনো ধরনের বিস্ফোরক পাওয়া যায়নি।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, করিডরে আগুন থাকায় নেভাতে দেরি হয়েছে, কলাপসিবল গেইট থাকায় তা কেটে ভিতরে ঢুকতে হয়েছে। ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কারণে আগুন বেশি ছড়িয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এক ঘণ্টা ধরে প্রতিবেদনটি শুনেছেন। পরে তিনি তদন্ত কমিটির কাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশ চেয়েছেন যাতে সচিবালয়ে এরকম অগ্নিকাণ্ড না ঘটে।
ভবিষ্যতের জন্য তদন্ত কমিটির সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক হেলালী বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন আগামী ১০ দিনের মধ্যে স্বল্প ও দীর্ঘস্থায়ী সুপারিশ দেওয়ার জন্য। আশাকরি আমরা সেটা করতে পারব। আমাদের সুপারিশ থাকবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের নিয়মমাফিক মেইটেইন করা হোক। কিন্তু করবে কি না, সেটা প্রশাসনের ব্যাপার।“
ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি মেরামতযোগ্য কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যতটুকু নষ্ট হয়েছে তা মেরামতযোগ্য।
পুড়ে যাওয়া নথির ফিরে পাওয়া সম্ভব কি না এমন প্রশ্নে কমিটির প্রধান স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গণি বলেন, “আমি পুরো ভবনটি দেখেছি। কয়েকটা রুম পুড়েছে। কিন্তু নথি যেখানে থাকে। সেখানে কিছু পুড়েনি। কিন্তু তারপরও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো কাল বা পরশু নিজেরা অডিট করা শুরু করবে।”
ফায়ার সার্ভিসের কারণেই নথিগুলো রক্ষা পেয়েছে, মন্তব্য করেন অধ্যাপক হেলালী।
‘লুজ কানেকশান’ থেকে আগুনের সূত্রপাত হলেও কী কারণে আলামত পরীক্ষায় বিদেশে পাঠানো হচ্ছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, “একটা কথা উঠতে পারে। কেউ দূর থেকে করলো কি না? সেটার পরীক্ষা করা প্রয়োজন, যা আমাদের দেশে হয় না। আলামত পরীক্ষার বিষয়ে বুয়েট ও ফায়ার সার্ভিস কিছু পরামর্শ দিয়েছে। কিছু পরীক্ষা আর্মি ল্যাবে চলছে। আর কিছু আমরা সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়াতে পাঠবো। যাতে প্রযুক্তিগুলো আমরা রপ্ত করতে পারি।”