আলোচিতজাতীয়সারাদেশ

লজ্জা ভেঙে টিসিবির লাইনে মধ্যবিত্তরাও

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বাজারে যে পণ্য কিনতে প্রায় এক হাজার টাকা লাগে, টিসিবির ট্রাক থেকে নিতে লাগে ৫৯০ টাকা। ফলে ৪০০ টাকার মতো সাশ্রয় হয়।

টিসিবির ট্রাক থেকে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি মসুর ডাল, পাঁচ কেজি চাল ও তিন কেজি আলু কিনতে পারছেন। বাজারে সম্প্রতি আলুর দাম আরও বেড়েছে। এজন্য আলু বিক্রি শুরু করেছে টিসিবি। এসব পণ্যের মধ্যে প্রতি লিটার ভোজ্যতেল ১০০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬০, চাল ৩০ টাকা ও আলু ৪০ টাকায় কেনা যায়। এই চার পণ্য কিনতে একজন গ্রাহককে দিতে হচ্ছে ৫৯০ টাকা। খুচরা বাজার থেকে এসব পণ্য কিনতে লাগে প্রায় ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনলে প্রায় ৪০০ টাকা সাশ্রয় হয়।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশনের পেছনে বৃহস্পতিবার দেখা গেল এই পণ্য কিনতে কয়েকশ’ মানুষ দাঁড়িয়েছেন। রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যাংক কর্মচারী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘জীবনে প্রথম দাঁড়াইছি। কাজ নেই। ভাবলাম দাঁড়িয়ে থাকি, যদি পাওয়া যায় তবে ভালো।”

একটু দূরে একজন মোটামুটি দামি পোশাক পরা এক নারী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার দৃষ্টিও টিসিবির ট্রাকের দিকে। এগিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “ছেলেকে দাঁড় করাইছি। লজ্জা লাগে, আর মেয়েদের মধ্যে যে ঠেলাঠেলি। মেয়েদের লাইনও বড়।” নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে তিনি জানান, তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এখন সংসার চালাতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই কিছু খরচ বাঁচাতে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে টিসিবির ট্রাকের সামনে এসেছেন।

তবে টিসিবির ট্রাকের পেছনে এখনো গৃহকর্মী, রিকশাচালক ও দিনমজুরদের উপস্থিতিই বেশি। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও লাইনে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে। এতদিন তারা এখান থেকে লজ্জায় পণ্য কেনেননি। অনেক জায়গায় টিসিবির লাইনে শিক্ষার্থীদেরও দেখা যাচ্ছে। যারা মেসে থাকেন, তারা এখান থেকে পণ্য নিচ্ছেন কিছুটা খরচ বাঁচানোর জন্য। অনেক চাকরিজীবীও লাইনে দাঁড়াচ্ছেন।

এই চিত্র শুধু রাজধানীর আগারগাঁওয়ে না, পুরো ঢাকার। একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা রুবিনা আক্তার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “বেঁচে থাকার জন্য তো খেতে হবে। মাংস খাওয়া তো বাদই দিয়েছি। সরকার তো কোনো কিছুই সামাল দিতে পারছে না। না আইন-শৃঙ্খলা, না দ্রব্যমূল্য। আসলে ছাগল দিয়ে যেমন হালচাষ হয় না, তেমনি যোগ্য লোকের হাতে দায়িত্ব না দিলে যা হয়। এই সরকারের যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, তাদের এই বিষয়ে কি কোনো জ্ঞান আছে? খালি সিন্ডিকেট-ফিন্ডিকেট বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা। মানুষ তো চরম বিরক্ত হচ্ছে। আসলে আমরা তো রাজনীতি করি না, কিন্তু আমাদের পক্ষে তো এখন চলাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

টিসিবির সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ৫০টি স্থানে এভাবে ফ্যামিলি কার্ড ছাড়া বিশেষ ট্রাকসেলে পণ্য বিক্রি করে টিসিবি। প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জনের জন্য পণ্য থাকে। তবে অধিকাংশ জায়গায়ই এর চেয়ে ১০০ থেকে ১৫০ জন বেশি মানুষ উপস্থিত থাকেন। যাদের পণ্য দেওয়া যায় না। তারা দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ফিরে যান।

দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে এবং দৈনন্দিন দরকারি পণ্যের দাম যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে সেজন্য বাজার তদারকি করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে সরকার। গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে কার্যকর হয়েছে। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নতুন উপদেষ্টা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি দ্রব্যমূল্য।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেগুলো ইতিবাচক। কিন্তু আমরা বাজারে এর সুফল পাচ্ছি না। সুফল পেতে সময় লাগবে। করোনা পরবর্তী সময় থেকেই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠে। সেটা আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বিশেষ করে টাকার অবমূল্যায়নে ডলারের দাম বেশি হওয়ায় আমদানি পণ্যের খরচ এমনিতেই বেড়ে গেছে। সরকারের উচিত হবে আমদানি করে কিছু পণ্যের মজুদ তৈরি করা। তাহলে সংকটের সময় বাজার নিয়ন্ত্রণে এটা কাজে আসবে। টিসিবির মাধ্যমে পণ্য দেওয়া হচ্ছে কিন্তু সেটা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। আবার সরকারের আয় না বাড়লেও এদিকে যতটুকু মনোযোগ দেওয়া দরকার, সেটা দিতে পারবে না। ফলে সরকারকে মানুষকে দ্রব্যমূল্যে স্বস্তি দিতে আরো বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।”

রাজধানীর শেওয়াপাড়ায় নিয়মিত বাজার করেন রুনা আক্তার। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, “কিছু পণ্যের দাম একটু কমেছে। কিন্তু যত বেড়েছিল, তার চেয়ে কমার পরিমান অনেক কম। যেমন ধরেন ডিমের ডজন এখন ১৫০ টাকা। এটা ১৮০ টাকায় উঠেছিল। কিন্তু এক ডজন ডিম ১৫০ টাকায় কেনা কতজনের পক্ষে সম্ভব? একইভাবে এখন শীতের মৌসুম শুরু হয়েছে। সবজির দাম এই সময় অন্যান্য বছর একটু কম থাকে। অথচ এবার একশ’ টাকার নিচে কোনো সবজির কেজি নেই। যে মূলা ৫-১০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়, এখন সেটাও ৫০ টাকা কেজি। এত দাম দিয়ে জিনিসপত্র কিনে আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা তো মুশকিল। সরকারের উপর মানুষ কিন্তু এই কারণে বিরক্ত হতে শুরু করেছে। যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে মানুষ এই সরকারের বিরুদ্ধেও কথা বলবে।”

শেওড়াপাড়ার সবজি বিক্রেতা আব্দুল কুদ্দুস সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমরা তো কারওয়ান বাজার থেকে সবজি এনে বিক্রি করি। কারওয়ান বাজারের আড়তদাররা আমাদের সবজির ট্রাকে কিছু চাঁদাবাজির কথাও বলছেন। ফলে আমরা তো বুঝতে পারি না, কেন দাম বাড়ছে। আমরা যে দামে কিনি, সেভাবেই বিক্রি করি।”

শুক্রবার মিরপুর-১ নম্বরের কাঁচাবাজারে বাজার মনিটরিংয়ে যায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক কাজী সুজনের নেতৃত্বে এই অভিযান চালানো হয়। অভিযান শেষে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আজ মুরগির বাজার, মাংসের বাজার ও ডিমের বাজারে অভিযান চালিয়েছি। এ সময় কয়েক জনকে জরিমানা করা হয়েছে। কয়েকটি মুরগির দোকানে বিএসটিআই অনুমোদিত ওয়েট মেশিন না থাকায় আমরা তাদের সতর্ক করে নতুন মেশিন আনার জন্য এক সপ্তাহ সময় দিয়েছি। আমরা আমাদের নিয়ম অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে যাবো। অভিযানে ফ্রেশ কাট চিকেন সার্ভিসকে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করায় এই জরিমানা করা হয়। কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রির অভিযোগে মুন্সিগঞ্জ চিকেন হাউজকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া ওজন কম দেওয়ার অভিযোগে শেখ সালমান ট্রেডার্সকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।”

 

সূত্র : ডয়েচে ভেলে

এরকম আরও খবর

Back to top button