গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ৪৫ হাজার পুলিশের চেয়ার বদল— সমকাল পত্রিকার প্রধান শিরোনাম। এতে বলা হয়েছে, হাসিনা সরকারের পতনের পর এখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি পুলিশ। নানা সংকট কাটিয়ে নতুন রূপে ফেরার চেষ্টায় আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটি।
একদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে দ্রুত বাহিনীর গতি ফেরানো, অন্যদিকে, জনআস্থা অর্জন – এই দুই চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে চলছে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার।
গত পাঁচই অগাস্টের পর প্রতিদিন পুলিশের বিভিন্ন পদে আসছে নতুন মুখ।
গত তিন মাসে দুই লাখ দুই হাজার পুলিশের বিপরীতে রদবদল করা হয়েছে ৪৫ হাজার ৪২ সদস্যকে। সে হিসাবে প্রায় ২৫ শতাংশ পুলিশের চেয়ার বদলে গেছে।
অল্প সময়ে এত সংখ্যক পুলিশ সদস্যের কর্মস্থল বদলের ঘটনা নজিরবিহীন। দেশের সব জেলার পুলিশ, সব রেঞ্জ ডিআইজি, মহানগর কমিশনার এবং সব থানার ওসি পদে এসেছে নতুন মুখ।
পুলিশে এককভাবে সবচেয়ে বড় ইউনিট হলো ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এখানে অন্তত ৩২ হাজার সদস্য এখানে কাজ করেন। এ পর্যন্ত এখানকার ১৮ হাজার সদস্যকে বদলি করা হয়েছে।যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে ডিএমপির মতো গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে ঢুকছেন, তাদের দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ ও উদ্দীপনা। রাজধানীর মতো জায়গায় নতুন পরিবেশে কাজের ধরন নিয়ে সম্যক ধারণা দিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ প্রশাসন। নীতিনির্ধারকরা বলছেন, কাজে গতি আনতে এই বদলি। গেল দেড় দশকে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ায় পুলিশ। গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও দেখা গেছে। পুলিশ এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার চেষ্টায় আছে।
তবে কারও কারও মত, নতুনভাবে যারা পদায়ন পাচ্ছেন, তাদের নিজ নিজ এলাকার অপরাধীদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানতে কিছুটা সময় লাগছে। অপরাধীরা এর সুযোগ নিতে পারে। কিছুদিন গেলে রদবদলের প্রভাব দৃশ্যমান হবে। কারণ, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ঘটনাপ্রবাহ এবং অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ পুলিশের সামনে আসছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের একটি দায়িত্বশীল সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৫ আগস্টের পর ১৮ অতিরিক্ত আইজিপির চেয়ার বদল করা হয়েছে। রদবদলের তালিকায় আছেন ডিআইজি ১২৪, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৬১, পুলিশ সুপার ২৪৪, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ৪০০, সহকারী পুলিশ সুপার ২২৭ জন। এ ছাড়া নন-ক্যাডার পদে রদবদল হয়েছে পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ২ হাজার ১১২, পরিদর্শক (সশস্ত্র) ৪৩, পরিদর্শক (শহর ও যানবাহন) ২৯৪, উপপরিদর্শক (এসআই) ৪ হাজার ১১৬, সার্জেন্ট ১৮৮, টিএসআই ২৭, এসআই (নিরস্ত্র) ৭৮, এএসআই ৪ হাজার ৬৬৮, এটিএসআই ৫৭, এএসআই (সশস্ত্র) ২৪৫ এবং নায়েক ৬১৫। আর তিন মাসে কনস্টেবল রদবদল হয়েছে ৩১ হাজার ৪২৪ জন।
পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে পুলিশে কর্মরত সদস্য ২ লাখ ১৩ হাজার। এর মধ্যে সিভিল সদস্য প্রায় ১১ হাজার। আর পোশাকধারী পুলিশ সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ২ হাজার। তাদের মধ্যে ক্যাডার পদের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার; বাকিরা নন-ক্যাডার। পুলিশ সদস্যের মধ্যে কনস্টেবল প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার। পুলিশ বাহিনীর ক্যাডার সদস্যদের মধ্যে অতিরিক্ত আইজিপির পদ ২২টি। ডিআইজি পদ ৮৭টি। পুলিশ সুপার ৫৮৬ জন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদরদপ্তর ও ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, সরকার পতনের পর ৬ আগস্ট পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে পরিবর্তন আসে। নিয়োগ দেওয়া হয় ময়নুল ইসলামকে। এরপর পুলিশের বিভিন্ন পদে একে একে বদল আসতে থাকে। অনেককে চাকরি থেকে বিদায় দেওয়া হয়। কাউকে কাউকে বিভিন্ন ইউনিটে সংযুক্ত করা হয়। পদোন্নতি পেয়ে অনেকে আসেন নতুন নতুন দায়িত্বে। গত সাড়ে ১৫ বছর যারা গুরুত্বহীন পদে ছিলেন, তারা সামনের সারিতে আসতে থাকেন। ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তারা অনেকে হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী।
পুলিশের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ডিএমপি। প্রায় ৩২ হাজার সদস্য নিয়ে এই ইউনিট। গত সাড়ে ১৫ বছর ডিএমপির ৫০ থানার ওসিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ঘুরেফিরে ছিল একই মুখ। অনেক সৎ, দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তা এতে বঞ্চিত হন। ডিএমপির ওই বলয় ভাঙা ছিল বেশ কঠিন। গুলশান বিভাগে একজন কর্মকর্তা ছিলেন, যিনি এক যুগের বেশি একই ইউনিটে চাকরি করেন। ওসি, সহকারী পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিভাগে টানা চাকরি করে গেছেন তিনি।
দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ডিএমপিতে দক্ষ, নিরপেক্ষ, যোগ্য কর্মকর্তার পাশাপাশি অনেক কর্মকর্তা স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বছরের পর বছর চাকরি করেছেন। আবার কিছু বিভাগে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করেছেন কেউ কেউ। রদবদলের ডামাডোলে তাদের অনেকে পড়েছেন বিপাকে। ডিএমপির ৫০ থানায় ওসির পাশাপাশি সব ক্রাইম বিভাগে এসেছে রদবদল।
ওসি নিয়োগের নীতিমালা অনুযায়ী এই পদে পদায়নের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫৪ বছর। তবে অনেক থানায় ৫৪ বছরের বেশি বয়সী পুলিশ পরিদর্শক ওসি পদে পদায়ন পাচ্ছেন। কোনো কোনো থানায় তিন মাসের মধ্যে একাধিকবার ওসি বদল করতে হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) ফারুক আহমেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বদলির বিকল্প ছিল না। সবাই অন্যায় করেছে, তা নয়। থানা ও ফাঁড়িতে স্থানীয় লোকজন পুরোনো পুলিশ সদস্যকে মেনে নিতে পারছিল না। পুলিশকে কমিউনিটির সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হয়। তাই রদবদল করতে হয়েছে।
অনেক বয়স্ক সদস্য ওসি হচ্ছেন– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ডিএমপিতে আমরা কম বয়সের পুলিশ সদস্য নেওয়ার চেষ্টা করছি। তবে ওসির ক্ষেত্রে অনেক সময় অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা দেখা হয়। সবার প্রশিক্ষণ আছে; কারও যোগ্যতা কম নয়। ডিএমপিতে যারা নতুন আসছে, নানা ধরনের প্রশিক্ষণ, মোটিভেশনাল ট্রেনিং এবং ওরিয়েন্টেশন কর্মসূচির আওতায় এনে ঢাকায় কাজের ধরনের বিষয়ে বিশদ ধারণা দেওয়া হচ্ছে।
বিশেষায়িত ইউনিট সদস্যদের ব্যাপকভাবে রদবদল করলে কাজের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিশেষায়িত ইউনিটের সদস্যদের একযোগে বদলি করা হচ্ছে না। সাইবার থেকে কাউকে সরালে আরেক ইউনিটের সাইবার নিয়ে কাজ করেছে, এমন কাউকে আনা হচ্ছে।
অল্প সময়ে এত সংখ্যক পুলিশের রদবদলে বাহিনীর ভেতরে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে– এ প্রশ্নে ফারুক আহমেদ বলেন, কারোরই এক ইউনিটে বেশিদিন থাকা উচিত নয়। এতে কাজে জড়তা চলে আসে; নতুন কিছু করার উদ্যম হারিয়ে ফেলে।
পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, পুলিশকে গতিশীল করতে এই রদবদল। তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছে। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বদলি ও পদায়ন করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বদলির বিষয়টি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। যেহেতু দেশে পরিবর্তন এসেছে, তাই পুলিশেও বড় ধরনের রদবদল হয়েছে। এর ফল কী হবে– এটা বুঝতে আরও সময় লাগবে। যাদের বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই, পারফরম্যান্স ও নথিপত্রের রেকর্ড ভালো, তাদেরই ভালো জায়গায় পদায়ন করা জরুরি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ সদস্যদের পদোন্নতি, পদায়ন ও প্রশিক্ষণের একটি নীতিমালা থাকা জরুরি। সেটি ঠিকঠাক অনুসরণ করতে হবে। তাহলে পদোন্নতি বা পদায়ন নিয়ে কারও সংক্ষুব্ধ হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সাত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের ভেতর থেকে বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর দাবি ওঠে। পুলিশকে রাজনীতিমুক্ত করাসহ ১১ দফা দাবিতে আন্দোলন করেন পুলিশ সদস্যরা। এরই মধ্যে পুলিশ বাহিনী সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে সরকার। তারা কাজও করে যাচ্ছে। আবার পুলিশের ভেতর থেকে বেশ কয়েকটি কমিটি করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তাদের কারও কারও ভাষ্য, অতীতে যারা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে, তাদের শনাক্ত করার পাশাপাশি সৎ ও দক্ষ কেউ যাতে গণবদলি বা শাস্তির তালিকায় ঢুকে না যায়, সেটি নিশ্চিত করা দরকার। পেশাদার কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পেলে মনোবল ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে বাহিনী দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে।
পুলিশের তিন কনস্টেবল ও একজন সার্জেন্ট জানান, বদলির তালিকায় তাদের নাম রয়েছে। এর মধ্যে একজনের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। একজনের ছেলে ঢাকায় পড়েন। হঠাৎ বদলি হওয়ায় বেশ বিড়ম্বনায় পড়েছেন তারা। এ ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসন বলছে, কারোর কোনো ধরনের মানবিক বিষয় থাকলে সেটি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ফারুক বলেন, নানা মানবিক কারণে ডিএমপির ১ হাজার ১০০ সদস্যের বদলি বাতিল করা হয়।
সম্প্রতি খুলনায় পুলিশের বদলি পদায়নে অভিনব পদ্ধতি অনুসরণ করতে দেখা গেছে। প্রকাশ্যে লটারির মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের পদায়ন করা হয়েছে। এতে দীর্ঘদিনের পোস্টিং বাণিজ্যের অবসান ঘটেছে বলে দাবি করেন পুলিশ সদস্যরা।
এদিকে ৩১ আগস্ট পুলিশ সদরদপ্তর এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, একটি চক্র পুলিশ সদস্যদের বিভিন্ন ইউনিটে বদলির ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করছে। এ ধরনের প্রতারক চক্র থেকে সতর্ক থাকার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।
সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট ঘিরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একটু উন্নতি হলেও সন্তোষজনক নয়। আপনারা জানেন, ঢাকার প্রায় সব পুলিশকে আমরা চেঞ্জ করছি। তাদের অলিগলি চিনতেও সময় লাগবে। তাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক স্থাপন করতে সময় লাগবে। তবে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। সামনে আরও উন্নতি হবে।
সূত্র : সমকাল