গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সরকার পতনের পর দেশের থানা ও মহানগর এলাকায় পুলিশ সদস্যদের এখনও পুরো মাত্রায় সক্রিয় করা যায়নি৷ এমনকি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাঠের পুলিশ সদস্যরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমান্ডও মানছেন না বলে জানা গেছে৷
আন্দোলনের সময় থানায় হামলা, আগুন, পুলিশ হত্যা ও অস্ত্র লুটের কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে আরো অনেক সময় লাগবে বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকেরা৷
কিন্তু এই সময়ে সাধারণ মানুষ নানা ফৌজদারি ও অপরাধমূলক সমস্যার প্রতিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন৷ এমনকি অনেক মামলার নথি পুড়ে যাওয়ায় সেই নথি আবার আদালত ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করাও সময় সাপেক্ষ হয়ে পড়ছে৷
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওই সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশে ৪৫০টি থানা আক্রান্ত হয়েছে৷ সারাদেশে মোট থানার সংখ্যা ৬৫০টির মতো৷ ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে বেশিরভাগই আক্রান্ত হয়েছে৷
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য মতে, ওই সময়ে সারাদেশে ৪৬ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন৷
১৮৭ পুলিশ সদস্য কাজে যোগ দেননি
পুলিশ সদরদপ্তর জানিয়েছে, সারাদেশে এখনও কাজে যোগ দেননি পুলিশের ১৮৭ সদস্য৷ তাদের মধ্যে ডিআইজি একজন, অতিরিক্ত ডিআইজি সাতজন, পুলিশ সুপার দুই জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একজন, সহকারী পুলিশ সুপার পাঁচ জন, পুলিশ পরিদর্শক পাঁচ জন, এসআই ও সার্জেন্ট ১৪ জন, এএসআই ৯ জন, নায়েক সাত জন এবং কনস্টেবল ১৩৬ জন৷ তাদেরকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে৷ তাদের আর কাজে যোগ দেয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷
অস্ত্র উদ্ধারের সংখ্যা
অন্যদিকে লুট হওয়া পাঁচ হাজার ৮২৯টি আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে তিন হাজার ৮৬৩টি৷ এখনো উদ্ধার হয়নি দুই হাজার ৬৬টি৷ এসব অস্ত্রের মধ্যে আছে এলএমজি, এসএমজি, রাইফেল, শটগান, পিস্তল রয়েছে৷
গুলি লুট হয়েছে ছয় লাখ ছয় হাজার ৭৪২টি৷ উদ্ধার হয়েছে দুই লাখ ৮৬ হাজার ৮২ রাউন্ড৷ এখনো উদ্ধার হয়নি তিন লাখ ২০ হাজার ৬৬০টি৷ এছাড়া সাউন্ড গ্রেনেড, গ্যাস গ্রেনেড, টিয়ারগ্যাস সেলও লুট হয়েছে৷ তার অর্ধেকও এখনো উদ্ধার হয়নি৷
তবে ৫ আগস্টের পর থেকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অবস্থান নেয়া একজন সাব-ইন্সপেক্টর সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘পুলিশ সদরদপ্তর যে হিসাব দিচ্ছে সেটা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে৷ আশা করি ধীরে ধীরে নিহত ও অনুপস্থিত পুলিশ সদস্যদের তালিকা আরো স্পষ্ট হবে৷”
তার কথা, ‘‘পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ দিলেও তাদের মনোবল ফিরে আসতে অনেক সময় লাগবে৷ আমাদের কর্মস্থলই এখনো কাজের জন্য পুরোপুরি উপযুক্ত হয়নি৷ এর বাইরে আমাদের বাসাও নিরাপদ নয়৷ বাসা পরিবর্তন করেও কোনো লাভ নাই৷ কারণ পুলিশের পোশাক দেখলেই মানুষ নানা মন্তব্য করে৷”
তিনি বলেন, ‘‘এখন আমাদের পুলিশ সদস্যরা মিছিল সমাবেশ হলে দায়িত্ব পালন করেন৷ কিন্তু সবসময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ মানেন না৷ তারা আর মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা করতে চায় না৷ অতীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ পালন করেই আমরা আজ এই সমস্যায় পড়েছি৷”
পুলিশ সদস্যরা তাদের নানা দাবি-দাওয়ার কথা বলছেন৷ তবে তারা এখন আর সেটা প্রকাশ্যে বলছেন না৷ কারণ সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলতে গিয়ে দুই পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন৷ পুলিশ সদরদপ্তর অবশ্য বলছে তারা পুলিশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন৷
এখনও সংস্কার চলছে
ঢাকার সেসব থানা আন্দোলনের সময় হামলা ও আগুনের শিকার হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো পল্টন থানা৷ ওই থানার সংস্কার কাজ এখনো শেষ হয়নি৷ পুলিশ সদস্যরা এখনো ঠিকমতো বসতে পারেন না৷ সবার অফিস কক্ষ নেই৷ ভবনে পুলিশ সদস্যদের থাকার যে জায়গা ছিলো তাও পুড়ে গেছে৷ তাদের এখনো বাইরে থাকতে হচ্ছে৷ থানার জরুরি নাম্বারগুলো এখনো সচল হয়নি৷ একই অবস্থা ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে কমপক্ষে ২২টি থানার৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘‘ঢাকার ২২টি থানা হামলা ও আগুনে সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ এখনো সংস্কারের কাজ চলছে৷ সংস্কার শেষ হলে থানাগুলোতে আর সমস্যা হবে না৷ পুরোদমে কাজ হবে৷”
আদাবর থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘‘আসলে আমরা এখন রুটিন ওয়ার্ক করছি৷ মামলার তদন্ত এবং অপারেশনে তেমন যাচ্ছি না৷ আর মামলাও কম হচ্ছে৷ বেশিরভাগই হচ্ছে জিডি৷”
পুলিশকে এখন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে মিছিল সমাবেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় বেশি কাজ করতে হচ্ছে৷ কারণ এখন মানুষ নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নামছেন৷ তারা ওইসব এলাকায় নিয়োজিত থাকলেও আগের মতো মিছিল সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে তাদের তৎপর দেখা যায় না৷
রোববার ঢাকার কাকরাইলে অডিট ভবনের সামনের সড়ক বন্ধ করে দাবি-দাওয়ার এক সমাবেশে পুলিশ অনেকটাই নিস্ক্রিয় ছিলো৷ তারা সমাবেশ রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য কমান্ডিং অফিসারদের নির্দেশও মানেনি বলে অভিযোগ উঠেছে৷
এদিকে, মব জাস্টিসও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে৷ এখানেও পুলিশের নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ আছে৷
‘পুলিশকে সহায়তা করতে হবে’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘আসলে পুলিশকে এর আগে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে৷ তারা জনবিরোধী ভূমিকা পালন করে গণরোষের শিকার হয়েছে৷ এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা মানসিক এবং নৈতিকভাবে দুর্বল আছে৷ এখন তাদের উদ্বুদ্ধ করা দরকার৷ সেজন্য তাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, তারা আইনগত দায়িত্ব পালনে বাধ্য এবং সেটা করলে তারা কোনো ক্ষতির মুখে পড়বেন না৷ আর সাধারণ মানুষেরও দায়িত্ব আছে৷ তাদেরও উচিত এখন পুলিশকে তাদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা৷”
‘‘এবার পুলিশ সদস্যরা যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দ্রুত দেয়া উচিত৷ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া তাদের পরিবারকে দ্রুত বুঝিয়ে দেয়া উচিত৷ আহতদের চিকিৎসা ব্যয় এবং ক্ষতিপূরণ দেয়া দরকার,” বলেন তিনি৷
মাঠে সেনাবাহিনী থাকা এবং তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়া প্রসঙ্গে নূর খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘পুলিশের কাজ সেনাবাহিনী দিয়ে হয় না৷ কারণ সাধারণ মানুষ পুলিশের কাছেই যেতে চায়৷ তারা সেনাবাহিনীর কাছে যেতে চায় না৷ আর সেনাবাহিনীরও এই পরিস্থিতিতে ভয় আছে৷”
মনোবল বাড়ানোর উদ্যোগ
ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে পুলিশের মনোবল বাড়াতে আমরা নানা উদ্যোগ নিচ্ছি৷ তাদের জন্য ফুটবল টুর্নামেন্টসহ নানা খেলাধুলাসহ আরো কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে৷ আর তাদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার দিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে৷ তারা যাতে নতুন করে কোনো সংকটে না পড়ে সেদিকে আমাদের নজর আছে৷”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আহত ও নিহত পুলিশ সদস্য ও তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের বিষয় যার যার বিভাগ দেখছে৷”
পুলিশের সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘আসলে পুলিশকেও বুঝতে হবে তারা অতীতে কী ভূমিকা পালন করেছে৷ আর সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে তাদের রাজনৈতিক নেতারা ব্যবহার করেছে৷”
তার কথা, ‘‘পুলিশকে যে-কোনো পরিস্থিতিতে আইনসম্মতভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে৷ রাস্তা বন্ধ করে কেউ তো সমাবেশ করতে পারে না৷ কাকরাইলে অডিট ভবনের সামনে রাস্তা অবরোধ করা বেআইনি৷ তাদের সরিয়ে দেয়া তো পুলিশের কাজ৷ সেটা তাদের করতে হবে৷ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তাদের ফোর্সদের বোঝাতে হবে যে, আইনগত দায়িত্ব পালনে তারা বাধ্য৷ তাদের এখনকার নিস্ক্রিয়তার ভিতরে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা তাও দেখতে হবে৷”
পুলিশের সাবেক আইজি নুরুল হুদা বলেন, ‘‘নাগরিকদেরও বুঝতে হবে কোনটা আইনসম্মত আর কোনটা বেআইনি কাজ৷”
‘‘আরেকটি বিষয়৷ আপনি পুলিশের সহায়তা ছাড়া চলতে পারবেন না৷ আবার পুলিশকে অপমান অপদস্থ করবেন এই মানসিকতা থেকেও বের হয়ে আসতে হবে,” যোগ করেন তিনি৷
তার কথা, ‘‘পুলিশকেই এখন তার ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে হবে৷ সেটা তাদের নিস্ক্রিয়তার মধ্য দিয়ে সম্ভব নয়৷ সাধারণ মানুষের পাশে থাকলেই সেটা সম্ভব৷”
সূত্র : ডয়েচে ভেলে