গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির সংঘর্ষের জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতভর জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে সদরসহ পুরো জেলায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাতের গোলাগুলি ও বিকেলের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)।
বৃহস্পতিবার রাতে (আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টা) জেলা শহরের নারানখখাইয়া, স্বনির্ভর এলাকায় ব্যাপক গুলির শব্দ শোনা যায়। পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গভীর রাত পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া যায়।
এর মধ্যে ধনঞ্জয় চাকমা দীঘিনালায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সংঘর্ষে মারা যান। অপর দুজনকে আহত অবস্থায় রাতে খাগড়াছড়ি সদর থেকে হাসপাতালে আনা হয়।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, রাতে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ১৬ জনকে আনা হয়। তাঁরা বেশির ভাগই সদর উপজেলা থেকে রাতে এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা যান। নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্ত শেষে বলা যাবে। বর্তমানে হাসপাতালে আরও ৯ জন চিকিৎসাধীন।
রিপল বাপ্পি চাকমা আরও জানান, রাতেই চারজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে একজন বাঙালি রয়েছেন। আহত বাকি ৯ পাহাড়িকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব বলে তিনি জানান।
তিনজনের মরদেহ সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন সোহেল চাকমা, মানব ত্রিপুরা, বিজয় চাকমা ও নলেজ চাকমা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রশাসন সূত্র সংবাদ মাধ্যমকে জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে দীঘিনালা লারমা স্কয়ার এলাকায় পাহাড়ি–বাঙালি সংঘর্ষ বাধে। বুধবার মোহাম্মদ মামুন (৩০) নামের এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগ মারধরের ঘটনার জের ধরে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে। আহত মামুন বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার বাসিন্দা।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় পাহাড়িরা মিছিলে বাধা দেন বলে অভিযোগ। তখন সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে পাহাড়িদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পাহাড়িরা ঘরবাড়ি ছেড়ে গহিন পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান।
বোয়ালখালী বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. লোকমান হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, মামুন হত্যার বিচারের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে তাঁরা মিছিল বের করেছিলেন। পরে পাহাড়িরা এসে বাধা দিয়েছেন। এ জন্য ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে। লোকমান বলেন, ‘এভাবে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হবে, এটা ভাবিনি।’
লারমা স্কয়ার এলাকার বাসিন্দা রিপন চাকমা বলেন, মিছিলে পাহাড়িরা কেউ বাধা দেননি। মিছিল থেকেই অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়েছে।
এ ঘটনার পর খাগড়াছড়ি শহরে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এর জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতে শহরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। রাতভর সেখানে আতঙ্ক বিরাজ করে। সীমিত করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট সেবা। সদরের বাসিন্দারা অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘রাতে গোলাগুলি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনজনের লাশ পাওয়া গেছে। মরদেহ হাসপাতালে রয়েছে। আহত হয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা পুলিশ সুপারসহ ঘটনাস্থল দীঘিনালায় যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করব। একটা থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।’
মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায়ের ৭৮টি ও বাঙালির সম্প্রদায়ের ২৪টি দোকান রয়েছে। ভাঙচুর হয় চারটি দোকান। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন। প্রশাসন নিরাপত্তা জোরদার করেছে।
সূত্র : প্রথম আলো