আলোচিতসারাদেশ

আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো শুটারদের খুঁজছে পুলিশ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

ওই সময় শিক্ষার্থীদের ওপর শটগান, পিস্তল, রিভলভার, এমনকি শুটারগান দিয়ে গুলি চালাতে দেখা গেছে কয়েকজনকে। গুলিতে নিহত হন অন্তত সাতজন এবং আহত হন শতাধিক আন্দোলনকারী।

ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অস্ত্রধারীদের একজনকে নগরীর নিউমার্কেট এলাকার তিন পুলের মাথায় ৪ আগস্ট দুপুরের দিকে অত্যাধুনিক একে-৪৭ রাইফেলের এর মতো দেখতে একটি অস্ত্র দিয়ে ছাত্রদের ওপর গুলি চালাতে দেখা যায়।

৫ আগস্টের এক ছবিতে দেখা যায়, মাথায় হেলমেট, গলায় গামছা মোড়ানো, গায়ে একটি কালো টি-শার্ট ও নীল রঙের থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরা এক যুবক একে-৪৭-এর মতো অস্ত্র হাতে ছাত্রদের ওপর গুলি চালাচ্ছেন।

একেকে এই অস্ত্রধারী?

অস্ত্রধারীদের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন (সিএমপি) পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে তার পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে সংবাদ মাধ্যম। ওই অস্ত্রধারীর নাম মোহাম্মদ সোলাইমান ওরফে সোলাইমান বাদশা।

সোলাইমান ১৩ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ ওয়াসিমের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ডাকাতির বেশ কয়েকটি মামলাও আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

৪ আগস্ট সকাল থেকে নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা কাভার করেন ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন। সেদিনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে মিনহাজ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থান নেয়। দুপুর ১২টার দিকে সদরঘাট ও আলকরণ এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিশাল একটি মিছিল নিয়ে তাদের ধাওয়া দিলে শিক্ষার্থীরা আমতল ও তিন পুলের মাথা এলাকার দিকে এসে অবস্থান নেয়।’

তিনি বলেন, ‘দুপুর ১টার দিকে সরকারদলীয় কর্মীদের একটি বড় মিছিল এনায়েত বাজার এলাকা থেকে নিউ মার্কেটের দিকে এগোতে থাকে। মিছিলটি তিন পুলের মাথা এলাকার পৌঁছালে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা ইটপাটকেল ও লাঠি হাতে জবাব দিতে থাকলেও যুবলীগের কর্মীরা পিস্তল, রিভলভার ও শটগান দিয়ে তাদের ওপর গুলি চালাতে থাকলে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে রিয়াজুদ্দিন বাজারে ঢুকে পড়ে। তার কিছুক্ষণ পরে একটি সাদা রঙের এসইউভিতে করে সেখানে হাজির হন যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর।

‘তার কিছুক্ষন পর ওই এলাকায় গলায় গামছা ও মাথায় হেলমেট পরা এক যুবককে একে-৪৭-এর মতো একটি অস্ত্র হাতে গুলি করতে দেখি।’

অস্ত্রটি একে-৪৭-এর আপগ্রেডেড ভার্সন: পুলিশ

সোলাইমান বাদশার হাতে থাকা ‘অস্ত্রটি দেখতে একে-৪৭-এর মতো হলেও এটি একে-৪৭-এর একটি আপগ্রেডেড ভার্সন’ বলে মত দিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিএমপির এক কর্মকর্তা।

একে-৪৭ রাইফেল বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। বিশ্বের প্রায় ৫০টিরও বেশি দেশের সামরিক বাহিনীতে বিশেষায়িত এই অস্ত্র ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বেসামরিক বাহিনীতে এই অস্ত্রের ব্যবহার নেই বললেই চলে।

সিএমপির ওই কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সামরিক, আধাসামরিক ও পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী ছাড়া আর কারও কাছে এই অস্ত্র থাকার কথা না। যুবলীগ নেতা বাবরের বিরুদ্ধে অস্ত্রের জোগান দেওয়ার অভিযোগ

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীদের উওপর হওয়া সবকটি সশস্ত্র হামলায় অস্ত্র ও গুলির জোগান দিয়েছেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক উপ-অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর।

১৬ জুলাই মুরাদপুরের সংঘর্ষে যেসব অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়েছে, সেগুলোর কয়েকটি একটি সাদা রঙের প্রাইভেটকারে করে সরবরাহ করা হয়। চট্ট মেট্রো-গ ১৪-৩২২১ নিবন্ধন নম্বরের ওই প্রাইভেট কারের মালিক হেলাল বাবরের ঘনিষ্ঠ জাফর উল্লাহ নামে এক ব্যক্তির। সেদিন ওই গাড়িতে করে এসে বাবর মিছিলে নেতৃত্ব দেন।

এছাড়াও ঘটনাস্থলে মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রণিকেও দেখা যায়।

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত বাবর চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় ২০১৩ সালের ২৪ জুন সংঘটিত ডাবল মার্ডার মামলার আসামি ছিলেন।

গত ১৫ বছর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সব টেন্ডার, ট্রেনের ক্যাটারিং সার্ভিস এমনকি কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও পদোন্নতি পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে বাবরের বিরুদ্ধে।

১৮ জুলাই নিহত হন ৩ শিক্ষার্থী, আহত হন শতাধিক

১৮ জুলাই দুপুর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বহদ্দারহাট মোড়ে চলা সংঘর্ষে ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন চার অস্ত্রধারী। হামলাকারীরা সরকারদলীয় স্লোগান দিয়েছেন। কালো টি-শার্ট ও নীল জার্সি পরা দুজনকে একটি শটগান দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে। বহদ্দারহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে একটি গ্রুপ থেকে ওই দুজন গুলি ছোড়েন। আরও দুজন রিভলবার দিয়ে গুলি করেন। এদিন তাদের ছোড়া গুলিতে দুইজন নিহত ও অন্তত ৫০ জন আহত হন।

বেশ কয়েকটি ছবি যাচাই করে এবং পুলিশ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে আক্রমণকারীদের একজন চান্দগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মহিউদ্দিন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। হেলমেট ও সাদা পোলো শার্ট পরে রিভলবার দিয়ে গুলি করেন তিনি।

আরও যেসব অস্ত্রধারীর পরিচয় জানা গেছে

ছাত্র আন্দোন চলাকালে ১৬ জুলাই মুরাদপুরে চলা সংঘর্ষে গুলি চালানো তিন অস্ত্রধারীর ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছাপা হয় পরদিন।

এই অস্ত্রধারীদের মধ্যে একজন মাথায় হেলমেট, গায়ে হালকা ছাই রঙের পোলো শার্ট ছিল। তাকে মো. ফিরোজ বলে শনাক্ত করা গেছে। তিনি মহানগর যুবলীগের কর্মী। গাঢ় নীল রঙের পোলো শার্ট ও জিন্স পরা আরেক অস্ত্রধারী মো. দেলোয়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সংগঠক। ফিরোজ রিভলবার নিয়ে এবং দেলোয়ার শটগান নিয়ে গুলি করেন। পিস্তল দিয়ে গুলি করা তৃতীয় শুটারের নাম টুটুল বলে জানা গেছে।

এদের মধ্যে দেলোয়ার ও টুটুল নন্দন বাবরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ফিরোজ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

অস্ত্রধারীদের খুঁজছে পুলিশ

৫ আগস্ট সরকার পতনের আগপর্যন্ত এসব অস্তধারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর মামলা হয়েছে এদের বিরুদ্ধে। যদিও সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে আছেন অভিযুক্তরা।

বাবরসহ কয়েকজন অস্ত্রধারীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা চালায় সংবাদ মাধ্যম। তবে কাউকেই নিজ ঠিকানায় পাওয়া যায়নি। মোবাইলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।

অস্ত্রধারীদের বিষয়ে জানতে চাইলে, সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল মান্নান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে সিএমপির একাধিক টিম। বেশ কয়েকজনের পরিচয় আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে তদন্তের স্বার্থে তাদের বিস্তারিত তথ্য এখন প্রকাশ করা সম্ভব হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘কারা এসব অস্ত্রের জোগান দিয়েছে, কারা তাদের গুলি চালাতে নির্দেশ দিয়েছে, সবকিছুই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে থানায় মামলা হয়েছে। তাদের শীঘ্রই আইনের আওতায় আনা হবে।’

 

সূত্র : দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

এরকম আরও খবর

Back to top button