দুদকের জালে স্বরাষ্ট্র ও পুলিশের ৯৬ কর্মকর্তা, আছে জিএমপি কমিশনার মাহবুব আলমও
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের অন্তত ৯৬ জন সাবেক এবং বর্তমান কর্মকর্তা এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে। ইতোমধ্যে কয়েক সহযোগীসহ সাব্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ, ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন (সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার গোয়েন্দা-ডিবি) হারুন অর রশীদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে টিম গঠন করেছে দুদক। দুদকের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন দপ্তর থেকে প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে একটি তালিকা তৈরির কাজও চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের তালিকায় পুলিশের ৮৬ জন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ মন্ত্রণালয়ের ১০ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দুদকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের একটি অসাধু সিন্ডিকেটের নানা অনিয়ম নিয়ে দুদকে বহু অভিযোগ এসেছে। সেগুলো আমলে নিয়ে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এই তালিকায় সাবেক একাধিক আইজিপিও রয়েছেন। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নে অনিয়ম, ব্ল্যাকমেইলিং, কেনাকাটায় অনিয়ম ও গ্রেপ্তার বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। পিআরবিসহ প্রচলিত যাবতীয় বিধি লঙ্ঘন করে তারা ‘বিশেষ গোষ্ঠীর’ হয়ে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
দুর্নীতির তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন, ১৯৮৯ সালে পুলিশে নিয়োগ পাওয়া ৮ম ব্যাচের চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সদ্য সাবেক এই কর্মকর্তা আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর দুই দফায় চুক্তিভিত্তিক আইজিপি হিসেবেও নিয়োগ পান। তার বিরুদ্ধে পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় এক ডজন মামলা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট জনরোষ থেকে বাঁচতে তিনি সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে চলে যান। দুদকের তালিকায় রয়েছেন, ১৯৯১ সালে নিয়োগ পাওয়া বিসিএস পুলিশ প্রশাসনের ১২তম ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত আইজি কামরুল আহসান, আতিকুল ইসলাম ও পিবিআইর সদ্য সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদারের নাম।
১৯৯৫ সালে নিয়োগ পাওয়া বিসিএস পুলিশ প্রশাসনের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন এসবির সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা ও সাবেক এসবি প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজি ওয়াইএম বেলালুর রহমান, শিল্প পুলিশের প্রধান মাহবুবুর রহমান, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ, সিআইডির সদ্য ওএসডি হওয়া প্রধান অতিরিক্ত আইজি মোহাম্মদ আলী মিয়া, অতিরিক্ত আইজি দেব দাস ভট্টাচার্য্য, খন্দকার লুৎফুল কবীর, চট্টগাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় ও ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজি মীর রেজাউল আলম।
১৯৯৮ সালে নিয়োগ পাওয়া ১৭ ব্যাচের ডিএমপির সাবেক কমিশনার ও বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া হাবিবুর রহমান, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন (অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত), ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার (অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত), ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন (অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত), রংপুর রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি ও বাধ্যতামূলক অবসর পাওয়া আবুদল বাতেন, চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির ও সিআইডির শেখ নাজমুল আলম।
১৯৯৯ সালে নিয়োগ পাওয়া ১৮তম ব্যাচের কর্মকর্তা ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন কমিশনার মো. মাহবুব আলম, রংপুর মেট্রোপলিটনের সাবেক কমিশনার ও চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মো. মনিরুজ্জামান, পুলিশ সদর দপ্তরের জয়দেব কুমার ভদ্র, সিআইডিতে থাকা ও ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার ইমাম হোসেন ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান।
২০০১ সালে নিয়োগ পাওয়া ২০ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন, শাহ মিজান শফিউর রহমান, মো. আনিসুর রহমান, মোল্যা নজরুল ইসলাম, এসএম মোস্তাক আহমেদ, জিহাদুল কবীর, মো. ইলিয়াস শরীফ, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি নূরে আলম মিনা, শাহ আবিদ হোসেন, মো. জামিল হাসান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম, রাজশাহী রেঞ্জের বিপ্লব বিজয় তালুকদার, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার বহুল আলোচিত মো. হারুন অর রশীদ, এসবির মোহা. মনিরুজ্জামান, শ্যামল কুমার নাথ, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. আলমগীর কবির, মো হামিদুল আলম, ড. শামসুন্নাহার, শেখ রফিকুল ইসলাম, ড. একেএম ইকবাল হোসেন ও মো. মাসরুকুর রহমান খালেদ।
২০০৩ সালের মে মাসে নিয়োগ পাওয়া ২১তম ব্যাচের ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মো. মারুফ হোসেন সরদার, বিজয় বসাক ও সুব্রত কুমার হালদার, শ্যামল কুমার মুখার্জী, মো সাজ্জাদুর রহমান, প্রবীর কুমার রায়, আ স ম মাহতাব উদ্দিন, মোহা আহমারুজ্জামান, সুভাষ চন্দ্র সাহা, মো. মোকতার হোসেন ও পংকজ চন্দ্র রায়।
২০০৩ সালের ডিসেম্বরে নিয়োগ পাওয়া ২২তম ব্যাচের ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নূরুন্নবী, এসএম মেহেদী হাসান, একই ব্যাচের নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল ইসলাম ও সঞ্জিত কুমার রায়। যায়েদুল আলম ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের ক্যাশিয়ার হিসেবে পুলিশে পরিচিত।
২০০৫ সালে নিয়োগ পাওয়া ২৪ বাচের মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান, ডিবির সাবেক উপকমিশনার মশিউর রহমান (সদ্য সিএমপিতে বদলি), সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, যশোরের পুলিশ সুপার ও পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রলয় কুমার জোয়ারদার, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ, মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন কক্সবাজারের সাবেক এসপি এবিএম মাসুদ হোসেন, মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান, সরকার মোহাম্মদ কায়সার, আসমা সিদ্দীকা মিলি, কাজী আশরাফুল আজিম, মিলন মাহমুদ, হায়াতুল ইসলাম খান, জসিম উদ্দিন মোল্লা, মোহাম্মদ মইনুল হাসান ও মোহাম্মদ আনিসুর রহমান।
২০০৬ সালে নিয়োগ পাওয়া ২৫ ব্যাচের ঢাকার এসপি ও পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের এসপি ও পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা রাসেল, পাবনার এসপি মো. আব্দুল আহাদ, ডিএমপির মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, রাজিব আল মাসুদ ও মো. শাহ জাহান। ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে সাতক্ষীরার এসপি আতাউর রহমান সিদ্দিকীর নামও তালিকায় রয়েছে।
সাবেক আইজিপিদের মধ্যে জাবেদ পাটোয়ারী ও বেনজির আহমেদের নাম রয়েছে দুদকের তালিকায়। এ ছাড়া ডিএমপির সাবেক কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, খন্দকার গোলাম ফারুক ও মো. শফিকুল ইসলামের নামও অনুসন্ধানের তালিকায় রাখা হয়েছে।
এদিকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও তার ঘুষ বাণিজ্য সিন্ডিকেটের কয়েক সহযোগীর দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্তের জন্য গত ১৫ আগস্ট ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করে দুদক। তদন্ত দলের প্রধান করা হয়েছে কমিশনের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমকে। এর আগে গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘুষ বাণিজ্য সিন্ডিকেটে রয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব হারুন অর রশীদ বিশ্বাস, বর্তমান যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন, যুগ্ম সচিব আবুল ফজল মীর ওরফে বাদল, যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ হোসেন, উপসচিব মাহবুবুর রহমান শেখ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব ফারজানা জেসমিন। এসব কর্মকর্তা দীর্ঘদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থেকে পুলিশ অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, কারা অধিদপ্তর, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বিজিবিসহ বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ পদোন্নতি বদলি পদায়নে ব্যাপক জালিয়াতি করেন।
গত ১৩ আগস্ট আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও তার স্ত্রী সন্তানদের ব্যক্তিগত ও তাদের মালিকানাধীন সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে বিএফআইইউ। তাদের হিসাবে সব ধরনের লেনদেন স্থগিত করে ব্যাংক লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। আসাদুজ্জামান খান ছাড়াও তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান, ছেলে সাফি মুদ্দাসির খান ওরফে জ্যোতি এবং মেয়ে সাফিয়া তাসনিম খানের সকল হিসাবও জব্দ করা হয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক আখতারুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে জানান, বেনজির আহমেদ, আসাদুজ্জামান মিয়াসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আগে থেকেই অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। রবিবার ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুদকের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে পর্যায়ক্রমে সবাইকে অনুসন্ধানের আওতায় আনা হবে।
হারুন ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ
বহুল আলোচিত ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ ও তার স্ত্রী শিরিন আক্তারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
রোববার আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাটির পক্ষ থেকে দেশের সবকটি ব্যাংককে চিঠি দিয়ে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
বিএফআইইউর চিঠিতে বলা হয়েছে, হারুন অর রশীদ ও তার স্ত্রী শিরিন আক্তার এবং তাদের ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো ব্যাংক হিসাব থাকলে সেটিও স্থগিত করতে হবে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এক মাসের জন্য অ্যাকাউন্ট স্থগিতের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া হারুন, তার স্ত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের (মা, বাবা, ভাই ও বোন) নামে পরিচালিত সব ধরনের হিসাব সংক্রান্ত তথ্য বা দলিলাদি (হিসাব খোলার ফরম, কেওয়াইসি দালিলাদি, লেনদেন বিবরণী প্রভৃতি) এবং চিঠি ইস্যুর তারিখ থেকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছে।