গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কি কারও দান করা, না সরকারের খাসজমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে? প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পার হলেও সেই বিতর্কের অবসান হয়নি। বরং নানা সময়ে এ বিতর্ক দানা বেঁধে ওঠে। নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ দেশে উচ্চশিক্ষার প্রথম এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠায় ৬০০ একর জমি দান করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যদিও এর দালিলিক কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই।
জমিদান নিয়ে দুটি মত প্রচলিত আছে। প্রথমটি হলো নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর জমির ওপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। আর দ্বিতীয় মতটি হলো দান করার মতো উদ্বৃত্ত জমি তখন নওয়াব পরিবারের ছিল না। ঢাবি যে জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়, তার অধিকাংশই সরকারি খাসজমি।
নওয়াব সলিমুল্লাহ জমি দিয়েছিলেন কি না, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেও। সর্বশেষ গত ২৬ জুন ঢাবির সিনেট অধিবেশনে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়। ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ৬০০ একর জমিদানের মাধ্যমে সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছেন ঢাকার নবাব বাহাদুর স্যার খাজা সলিমুল্লাহ’ অধিবেশনে ঢাবি কোষাধ্যক্ষের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তা সংশোধনের প্রস্তাবনা করেন সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির। পরে আরেক সিনেট সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল বারী বক্তব্য দেওয়ার সময় নবাব সলিমুল্লাহর জমিদানের জনশ্রুতির পক্ষাবলম্বন করেন এবং অধ্যাপক বাছিরের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেন। পরে উপাচার্যের হস্তক্ষেপে বিষয়টির মীমাংসা হয় এবং এ বিষয়ে প্রকৃত সত্য উদঘাটনে একটি কমিটি গঠনের ঘোষণাও দেন।
অধ্যাপক বাছির বলেন, ‘নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ১৯১৫ সালে মারা যান এবং জমিদান করার মতো আর্থিক সংগতি তার ছিল না। তিনি ঋণগ্রস্ত ছিলেন, সুতরাং তার ৬০০ একর জমিদানের বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সত্য নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে আমার পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে। সেখান থেকে আমি এমন কোনো তথ্য পাইনি যে, নবাব সলিমুল্লাহ সরাসরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৬০০ একর জমি দান করেছিলেন। নবাব সলিমুল্লাহর যে অবদান, সেটাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই, সেই অবদানের জায়গা থেকে আমরা তাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু ইতিহাস হলো উৎসনির্ভর, উৎস না থাকলে আমরা গায়ের জোরে ইতিহাস লিখতে পারব না।’
অন্যদিকে অধ্যাপক বাছিরের বক্তব্যের সমালোচনা করে অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল বারী বলেন, ‘এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছু শুরু হওয়ার কথা ১৯১৫ সালে। শুধু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে আটকে গিয়েছে। নবাব সলিমুল্লাহসহ আরও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ১৯১২ সালেই ভার্সিটির জন্য হার্ডিঞ্জের কাছে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সেই নবাব সলিমুল্লাহর অবদানকে এভাবে অবমূল্যায়ন করা হলো। বিশেষত আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, যার দায়িত্ব ছিল এটি নিয়ে কাজ করার। তিনি (অধ্যাপক বাছির) কি দায়িত্বহীনভাবে কথা বলছেন, নাকি সত্যের ওপর দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, আমরা তা জানতে চাই। সলিমুল্লাহ এবং ৬০০ একর জমির ইস্যুতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক, আসল সত্যটি উদঘাটন হোক।’
তথ্য বলছে, ১৯২১ সালে দেশের প্রথম এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির জন্মের ৬ বছর আগে ১৯১৫ সালে মারা যান সলিমুল্লাহ। আর তার মৃত্যুর আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিয়েই অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আলোচনার সময় নওয়াব সলিমুল্লাহর ভূমিকার সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ মেলে। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারজয়ী লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ। ওই বইতে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের (বর্তমানে যার নাম সিনেট) প্রথম সভা হয় ১৯২১ সালের ১৭ আগস্ট। প্রথম সভায় ১৫৮ জন সদস্যের মধ্যে ১১৩ জন উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য লরেন্স জন লামলে ডানকাস। প্রথম সভাতেই ফজলুল হক এবং স্যার শামসুল হুদার প্রস্তাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নবাব সলিমুল্লাহর অবদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। বাঙালি মুসলমানের শিক্ষার উন্নতির জন্য নবাবের ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়। তারপর সভাপতি ডানকাস একটি প্রস্তাব পাঠ করেন। প্রস্তাব পাঠের সময় সব সদস্য নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
সরদার ফজলুল করিম রচিত ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : ‘অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা ও অন্যান্য’ শীর্ষক বইয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির মালিকানা নিয়েও আলাপচারিতা আছে। সরদার ফজলুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সলিমুল্লাহ হল নিয়ে জানতে চান জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের কাছে। এ প্রসঙ্গে বইটিতে এভাবে উল্লেখ আছে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘কোনো মুসলমান ধনীর কাছ থেকেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডাইরেক্টলি কোনো ফাইন্যান্সিয়াল কন্ট্রিবিউশন পায় নাই। সলিমুল্লাহ হল যে তৈরি হলো তা পুরোই সরকারের টাকায়। নওয়াব পরিবারের টাকায় নয়; জায়গাতেও নয়। রমনায় যে জায়গায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি, তা পুরোটাই খাসমহল এবং সরকারের জমি। সেটেলমেন্ট রিপোর্টে তাই আছে।’
এ বিতর্ক নিয়ে কাজ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ছিদ্দিকুর রহমান খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘বলা হয়ে থাকে, নবাব সলিমুল্লাহ ৬০০ একর জমি দিয়েছেন। আমি নিজেই এটা নিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। কেউ কেউ বলেছে, কলকাতা কমিশন রিপোর্টের মধ্যে এটি উল্লেখ আছে। আমি সেই রিপোর্টটিও আদ্যোপান্ত দেখেছি। কোথাও এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন প্রতিষ্ঠা হয়, তখন সলিমুল্লাহ বেঁচেই ছিলেন না। জমি দান করার বিষয়টা একটা গল্প।’
এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘বিতর্কটাও অহেতুক, কেননা যেখানে সাড়ে ৪০০ একর জমির ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই জমি দেওয়ার বিনিময়ে সরকার ৫৫ লাখ টাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে কেটে নিয়েছিল। যে জায়গার ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলো নবাবি স্টেটের ছিল। পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশ যখন হয়, সে সময় এখন যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত যে জায়গাগুলো আছে, এগুলো সরকার আগেই অধিগ্রহণ করে নিয়েছিল। সাধারণত অধিগ্রহণ করলে যাদের জমি তাদের টাকাপয়সা দিতে হয়। সেভাবেই সরকার এই জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছিল।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নবাব সলিমুল্লাহর বড় ভূমিকা রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ছিদ্দিকুর বলেন, জমি দেওয়া না দেওয়া নিয়ে তার অবদান ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
অবশ্য অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনের ‘ঢাকা সমগ্র’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে ভিন্ন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি লিখেন, ‘শাহবাগ তো নবাবের ছিলই, অনুমান করে নিচ্ছি রেসকোর্স ময়দানও নবাবেরই ছিল। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামকে আমি একবার বলতে শুনেছি তিনি নবাব পরিবারের দলিলপত্র ঘাঁটতে গিয়ে রেসকোর্স ময়দানকেও নবাবের সম্পত্তি হিসেবে পেয়েছিলেন, তাও তার (সলিমুল্লাহ) মৃত্যুর পর। অর্থাৎ নবাবের মৃত্যু ১৯১৫ সালে হয়েছে সে সময় রেসকোর্স ময়দানটিকে নবাব পরিবারের সম্পত্তি হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন। যেটি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জমির আওতাভুক্ত।’
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পার হলেও কাদের জমির ওপর এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত, সেটি নিয়ে অস্পষ্টতা দূর করতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। কোনো তথ্য নেই কোনো বিভাগে। নবাব সলিমুল্লাহর জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘বিষয়টি আরও বিস্তরভাবে দেখা উচিত। আমরা ছোটকাল থেকে যা জেনে এসেছি, তা আসলে সত্য কি না। ঐতিহাসিকভাবে নবাবের অবদান জমি দান করার বিষয়ে রয়েছে কি না, সেটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ বিষয়ে আরও উচ্চতর গবেষণা প্রয়োজন। আমরা শিগগিরই একটি কমিটি গঠন করে দেব।’
সূত্র : দেশ রূপান্তর