গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ঈদুল আজহার ছুটিকে কেন্দ্র করে টানা পাঁচদিন বন্ধ থাকছে ব্যাংক। এর মধ্যেই দেশজুড়ে এটিএম বুথে নগদ টাকার সংকট শুরু হয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার বেশির ভাগ বুথে টাকা পাওয়া যায়নি। টাকা তুলতে না পারায় গ্রাহকদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
বুথে গিয়ে টাকা না পাওয়ার সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ক্ষেত্রে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকসহ বড় ও বিস্তৃত নেটওয়ার্কের ব্যাংকগুলোর অনেক এটিএম বুথে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। একই ধরনের অভিযোগ আসছে চতুর্থ প্রজন্মের নতুন ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও। বাড়তি চাপের কারণে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক নিজেদের গ্রাহক ছাড়া অন্য ব্যাংকের কার্ড দিয়ে টাকা উত্তোলন বন্ধ রেখেছে বলে জানা গেছে।
সোমবার দেশে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। ঈদ উপলক্ষে রোববার, সোমবার ও মঙ্গলবার সরকারি ছুটি। এর আগে শুক্র ও শনিবার হওয়ায় ব্যাংক বন্ধের সময় বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচদিনে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরের বিভিন্ন এটিএম বুথের পরিস্থিতি যাচাই করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তুলনামূলকভাবে রাজধানী ঢাকার এটিএম বুথগুলোয় টাকা বেশি পাওয়া যাচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে ঢাকার বেশির ভাগ গ্রাহক এখন গ্রামমুখী। এ কারণে জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোর এটিএম বুথের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেটসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের এটিএম বুথে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সবচেয়ে বেশি সংকট তৈরি হয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ রেমিট্যান্স সমৃদ্ধ জেলাগুলোয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোরবানির পশু ক্রয়সহ নানা কারণে ঈদুল আজহায় মানুষের নগদ টাকা বেশি প্রয়োজন হয়। সাপ্তাহিক ছুটির কারণে এবার ঈদুল আজহার ছুটি দুদিন আগেই শুরু হয়ে গেছে। ব্যাংক বন্ধ থাকায় এটিএম বুথের ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে। বুথে টাকা রাখার কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুনিরুল মওলা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘গ্রাহকদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে আমরা এটিএম বুথে পর্যাপ্ত টাকা রেখেছিলাম। কিন্তু নগদ টাকা উত্তোলনের চাপ বেশি হওয়ায় তা দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায়ই জরুরি ভিত্তিতে টাকা দেয়া হয়েছে। আশা করছি, আগামীকাল মানুষের টাকা উত্তোলনের চাহিদা কমে আসবে।’
রাজশাহীগামী ট্রেনে উঠতে শনিবার দুপুরে রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসেন বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন। স্টেশনের ভেতরে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। সংবাদ মাধ্যমকে আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমি পুরান ঢাকার লালবাগে থাকি। সেখানকার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের বুথসহ একাধিক ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো বুথেই টাকা পাওয়া যায়নি। মনে করেছিলাম, কমলাপুর স্টেশনের বুথে টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু এখানে এসেও পেলাম না। এখন খালি পকেটে রাজশাহীর ট্রেনে উঠতে হবে।’
ফেনী শহরের এক ডজনের বেশি ব্যাংকের বুথে টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন গ্রাহক নুরুল আবছার। তিনি বলেন, ‘কোরবানির জন্য কেনা গরুর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু শহরের কোনো বুথ থেকে টাকা তুলতে পারছি না। শুক্রবারও বেশির ভাগ বুথে টাকা ছিল না। শনিবারও একই পরিস্থিতি। বাধ্য হয়ে ব্যাংকের অ্যাপ ব্যবহার করে পরিচিত একটি বেসরকারি হাসপাতালের অ্যাকাউন্টে টাকা স্থানান্তর করেছি। হাসপাতালটির কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়ে গরু বিক্রেতাকে টাকা দিতে হয়েছে।’
বড় একটি বেসরকারি ব্যাংকের ফেনী শাখার ব্যবস্থাপক সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘নগদ টাকা তোলার চাপ বেশি থাকায় বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবসের দিনও গ্রাহকরা চাহিদা অনুযায়ী সব ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারেননি। এর প্রভাব এটিএম বুথের ওপর পড়েছে। কোনো ব্যাংক বুথে টাকা ঢোকানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় এটিএম বুথ থেকেও টাকা তোলা যাচ্ছে না। টাকা তোলার জন্য গ্রাহকদের নিজ ব্যাংকের বুথে ব্যর্থ হয়ে অন্য ব্যাংকের বুথে ঘুরতে দেখা গেছে। শনিবার কাজির দেউড়ি এলাকার এবি ব্যাংকের বুথে কোনো টাকা তুলতে পারেননি গ্রাহকরা। তৈয়বুল ইসলাম নামের চট্টগ্রামের ওয়ান ব্যাংকের একজন গ্রাহক সকালে এবি ব্যাংকের বুথ থেকে এনপিএসবির মাধ্যমে টাকা তুলতে চাইলেও পারেননি। পরে চিটাগং ক্লাবের অভ্যন্তরে থাকা ওয়ান ব্যাংকের নিজস্ব বুথ থেকে তিনি টাকা উত্তোলন করেন।
ভিআইপি টাওয়ারের নিচে এবি ব্যাংকের বুথে দায়িত্বরত সিকিউরিটি গার্ড সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সকালের দিকে গ্রাহকরা বুথ থেকে টাকা তুললেও ১১টার দিকে বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারেননি নেটওয়ার্কের কারণে। তবে দুপুরের দিকে টাকা উত্তোলনের সমস্যাটি অনেকটা স্বাভাবিক হয়।’ ব্যাংকের নিজস্ব কার্ডের গ্রাহকদের টাকা উত্তোলনে তেমন একটা সমস্যা না হলেও অন্য ব্যাংকের গ্রাহকরা টাকা উত্তোলন করতে পারছিলেন না বলে জানিয়েছেন তিনি।
মিজানুর রহমান নামের ঢাকা ব্যাংকের এক গ্রাহক ডেবিট কার্ড দিয়ে হালিশহর এলাকার পোর্ট কানেক্টিং রোডের ব্রাঞ্চের নিচে থাকা বুথে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গিয়ে টাকা না পেয়ে ফিরে আসেন। পরে তিনি জরুরি প্রয়োজন মেটাতে কাজির দেউড়ি এলাকার অন্য একটি ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তুলতে সমর্থ হন।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকা বুথসহ কিছুটা অপ্রচলিত স্থানে থাকা বুথগুলো থেকে টাকা উত্তোলনে সমস্যায় পড়েছেন বলে জানিয়েছেন গ্রাহকরা। চট্টগ্রামের কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকার বিভিন্ন ব্যাংকের বুথে শুক্রবার সন্ধ্যা ও শনিবার সকাল থেকে বিভিন্ন শিল্প-কারখানার শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের টাকা উত্তোলন করতে এলেও অপর্যাপ্ত টাকার কারণে অনেকেই ফেরত চলে যান বলে বুথের দায়িত্বপ্রাপ্ত নিরাপত্তাকর্মীরা জানিয়েছেন।
শনিবার দিনভর রাজশাহী মহানগরীর সাহেববাজার, লক্ষ্মীপুর, কোর্ট স্টেশন ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ব্যাংকের বুথ থেকে গ্রাহকরা টাকা তুলতে পারেননি বলে জানা গেছে। সাহেববাজারের বুথগুলোর নিরাপত্তাকর্মীরা সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ঈদের ছুটির কারণে বুথে টাকা নেই। এ কারণে তারা বুথের দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। দুদিন ধরে এ পরিস্থিতি চলছে বলে তারা জানিয়েছেন।
নগরীর কোর্ট স্টেশন এলাকার বাসিন্দা মাহাফুজুল হক সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘কোর্ট স্টেশন এলাকার আশপাশের কোনো বুথেই টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল শুধু যমুনা ব্যাংকের বুথ থেকে এক বেলা টাকা পাওয়া গেছে। কিন্তু আজ সেটিও ফাঁকা। সাহেববাজারে গিয়েও দেখি একই অবস্থা। অধিকাংশ বুথের দরজাই বন্ধ। কয়েকটি খোলা থাকলেও সেখানে টাকা নেই।’
ঈদ উপলক্ষে এটিএম বুথে পর্যাপ্ত টাকা রাখার নির্দেশনা দিয়ে ১১ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ঈদের ছুটিতে সার্বক্ষণিক এটিএম সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এটিএমে কোনো কারিগরি ত্রুটি দেখা দিলে সেটিও দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বিষয়ে চেষ্টা করেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের একজন কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘ঈদসহ যেকোনো লম্বা ছুটির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রজ্ঞাপন দিয়ে এটিএম বুথসহ অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করতে বলা হয়। কিন্তু নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, সেটি কখনো পর্যবেক্ষণ করা হয় না। এটি অনেকটা কাগুজে নির্দেশনা হয়ে গেছে। আমি নিজেও এটিএম বুথে গিয়ে টাকা পাইনি।’
গ্রাহকদের ভোগান্তির বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের বুথগুলোয় পর্যাপ্ত টাকা রাখার চেষ্টা করেছি। তার পরও কোনো বুথে টাকার সংকট হয়েছে কিনা, সেটি দেখতে হবে। যেসব ব্যাংক তারল্য সংকটে আছে, তাদের এটিএম বুথে টাকা কম থাকতে পারে। সাধারণ মানুষ এমনিতেই ব্যাংক খাত নিয়ে আস্থার সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় প্রয়োজনের সময় টাকা না পেলে সংকট আরো বাড়বে।’
সূত্র : বণিক বার্তা