গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : প্রতি বছর বাজেট ঘোষণার পরপর বেশ কিছু পণ্য ও সেবার দামের পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। মূলত অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাবনায় পরবর্তী অর্থ বছরের জন্য কিছু পণ্যের শুল্ক ও কর হারে পরিবর্তন আনেন বলে দামের ক্ষেত্রে এ ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়।
সাধারণত অর্থমন্ত্রী যেসব পণ্যের শুল্ক ও কর কমানো বা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন সেসব পণ্যের দাম কমে। আর বিপরীতে যেসব পণ্যে নতুন করে শুল্ক আরোপ বা আগের চেয়ে বাড়ানো হয় সেগুলোর দাম বেড়ে থাকে।
আর বাজেটে থাকা এ ধরনের প্রস্তাবগুলো নিয়মানুযায়ী তাৎক্ষণিকভাবেই কার্যকর হয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার (০৬ জুন) অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মোহাম্মদ আলী জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় আট লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটিই তার প্রথম বাজেট উপস্থাপন।
যেসব পণ্যের দাম বাড়ছে
মোবাইল কলরেট, সিম ও ইন্টারনেট
বাজেটে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী মোবাইল সিমের দাম বাড়বে। কারণ প্রতিটি সিম কার্ড কিংবা ই-সিমের বিপরীতে মূল্য সংযোজন কর দুশো টাকার পরিবর্তে তিনশ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আবার মোবাইল ফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে যেসব সেবা দেয়া হয় অর্থাৎ কথা বলা কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহার -এসব ক্ষেত্রেও মানুষের ব্যয় বাড়বে।
কারণ অর্থমন্ত্রী এ ধরনের সেবার বিপরীতে বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক পনের শতাংশ থেকে বাড়িয়ে বিশ শতাংশে নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন। এর ফলে বেড়ে যাবে টকটাইম ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ।
অর্থাৎ মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখন মানুষকে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। দেশে এখন প্রায় বিশ কোটি মোবাইল ফোন আছে। অনেকে একাধিক ফোন ব্যবহার করে থাকেন।
আমসত্ত্ব ও জুসের দাম
বাংলাদেশে আম থেকে তৈরি হওয়া আমসত্ত্ব বেশ জনপ্রিয়। একই সাথে আম, আনারসের জুসও অনেকের প্রিয়। হালে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পেয়ারা ও তেঁতুলের জুসও।
অর্থমন্ত্রী এবার উৎপাদন পর্যায়ে এসব পণ্যের মূল্য সংযোজন কর পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পনের শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন। ফলে আমসত্ত্বের পাশাপাশি এ চারটি জুসের দাম বেড়ে যাবে বাজারে।
সিগারেট ও বিড়ি
বাজেট আসলে সাধারণত দুয়েকদিন আগে থেকেই আলোচনায় থাকে সিগারেটের দাম। যথারীতি এবারেও তাই হয়েছে।
তবে আলোচনা পর্যালোচনার মধ্যেই অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী তার বাজেট প্রস্তাবনায় সিগারেট ও বিড়ি পেপারের স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর দ্বিগুণ বাড়িয়েছেন।
আগের সাড়ে সাত শতাংশ হারে করের বিপরীতে তিনি এবার পনের শতাংশ করের প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া বেড়েছে সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক।
অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাবনায় বলেছেন, “সিগারেট মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর একটি পণ্য। এ জাতীয় ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার কমানো ও রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সম্পূরক শুল্কের হার ৬৫ শতাংশের পরিবর্তে ৬৬ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করছি।”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে গ্রামীণ সমাজে ও স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে বিড়ি জনপ্রিয় আর তুলনামূলক সচ্ছল ব্যক্তিরা সিগারেট বেশি কিনে থাকেন।
এর আগে, গত বছরে বিড়ির দাম অপরিবর্তিত রাখা হলেও সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছিলো।
এলইডি ও এনার্জি সেভিংস লাইট
বাংলাদেশে গত প্রায় এক দশক ধরে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হিসেবে এলইডি এবং এনার্জি সেভিংস লাইটের ব্যবহার বাড়ছে। এবারের বাজেটে ১ থেকে ৫০ ওয়াটের বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাল্ব এর মূল্য সংযোজন কর পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পনের শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পাশাপাশি ১৮ ও ৩৬ ওয়াটের টিউবলাইট মূল্য সংযোজন করও পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে পনের শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আইসক্রিম ও কোমল পানীয়
বাংলাদেশে আইসক্রিম ও কোমল পানীয় ব্যাপক জনপ্রিয়। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে দামি ও ব্র্যান্ডের আইসক্রিম বিক্রির দোকান গত কয়েক বছরে বেশ বেড়েছে।
কিন্তু এখন থেকে আইসক্রিম ও কোমল পানীয়র জন্য মানুষকে আরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে।
কারণ অর্থমন্ত্রী সব ধরনের আইসক্রিমের ওপর বিদ্যমান শুল্ক হার পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দশ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন।
অন্যদিকে কোমল পানীয়র (কার্বনেটেড বেভারেজ) উপর থাকা সম্পূরক শুল্ক হার পঁচিশ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ত্রিশ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন।
একই সাথে বাংলাদেশের মান অনুযায়ী সংজ্ঞায়িত কার্বনেটেড বেভারেজের জন্য নির্ধারিত মাত্রার উপাদান অপেক্ষা ভিন্নতর মাত্রার উপাদান সম্বলিত পানীয়র ওপর বিদ্যমান ৩৫ শতাংশ সম্পূরক হার বাড়িয়ে চল্লিশ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন।
ফ্রিজ ও এসি
ফ্রিজ এখন দেশজুড়ে ঘরবাড়িতে নিয়মিত ব্যবহার্য্য পণ্যে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশে। পাশাপাশি বাড়ছে এসির ব্যবহারও। জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও অনেক বাড়ীতে এখন এসির দেখা মেলে।
তবে এখন ফ্রিজ ও এসি কিনতে আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে মানুষকে।
এসি উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে শূন্য শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে সাত শতাংশ এবং রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজের স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে পাঁচ শতাংশের পরিবর্তে সাড়ে সাত শতাংশ মূল্য সংযোজন কর প্রস্তাব করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ফ্রিজ বা এসির কম্প্রেসরের ওপরেও। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের বাজারে ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর যা বিক্রি হয় তার বেশিরভাগই দেশে উৎপাদিত।
এমিউজমেন্ট ও থিম পার্ক
বাংলাদেশে এখন বিনোদনের জন্য এমিউজমেন্ট ও থিম পার্কগুলো ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। বেড়ানো ছাড়াও পিকনিক বা বড় ধরনের গ্রুপের বিনোদনের জন্য এসব পার্কের সেবা নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে। বাজেটে এগুলো ব্যবহারের মূল্য সংযোজন কর দ্বিগুণ করা হয়েছে।
এছাড়াও আরও যেসব পণ্যের দাম এবারের বাজেটে শুল্ক ও কর বৃদ্ধির কারণে বাড়তে পারে তার মধ্যে আছে ইট, সিসি ক্যামেরা, মোটর সাইকেল, লাইট হোল্ডার, ফল, বিদেশী কাজুবাদাম, ম্যাকারেল মাছ, ফুল, এলপিজি সিলিন্ডার, সুইচ, সকেট, আয়রন, জেনারেটর ও ওয়াটার ফিল্টার।
যেসব পণ্যের দাম কমছে
ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিট
বাংলাদেশে কিডনি রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ডায়ালাইসিস সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি।
আবার যেসব জায়গায় সুবিধা আছে সেখানেও এটি ব্যয়বহুল ছিল ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিটের উচ্চমূল্যের কারণে।
এর আগেও বাজেটে এ সম্পর্কিত কিছু যন্ত্র বা উপকরণে কর ছাড় দেয়া হলেও এজন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয় রোগীদের।
এবারের বাজেটে ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিটের শুল্ক কমানো প্রস্তাব করার কারণে ডায়ালাইসিসের জন্য আগের চেয়ে কম অর্থ ব্যয় করতে হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন বাজেটে।
ডেঙ্গু কিট
দেশে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। প্রতিবছরেই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বহু মানুষ।
অর্থমন্ত্রী বাজেটে ডেঙ্গু কিট আমদানির ওপর রেয়াতি সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করেছেন।
এর ফলে এ কিট আমদানির খরচ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। “২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেটে রেয়াতি সুবিধায় ডেঙ্গু কিট আমদানির লক্ষ্যে একটি নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করার প্রস্তাব করছি,” বলেছেন অর্থমন্ত্রী।
গুঁড়া দুধ
অর্থমন্ত্রী বাজেটে প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের ওপর বিশ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন। এর ফলে বাজারে গুঁড়া দুধের দাম কমার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এর বাইরে শুল্ক কমানোর কারণে যেসব পণ্যের দাম কমতে পারে তার মধ্যে আছে চকলেট, বিদেশি পোশাক, এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন, ইলেকট্রিক মোটর, এয়ারক্রাফট প্রপেলার, মিথানল, স্পাইনাল নিডল, মাশরুম ও শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল ম্যাঙ্গানিজ।