কালিয়াকৈরে প্রায় ৫০ একর কৃষি জমিতে শিল্পকারখানা নির্মাণের প্রস্তুতি
গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সবুজ ফসলের মাঠে বাতাসের তোড়ে দুলে দুলে উঠছে বোরো ধান। সরকারি খাসজমিও রয়েছে এখানে। কিন্তু মাঠের মাঝখানে সশব্দে চলছে ভারী ভেকু মেশিন। টানা প্রায় ৫০ একর ফসলি জমি ঘিরে ফেলা হয়েছে ইস্পাত ও রঙিন টিনের সীমানা প্রাচীর দিয়ে। কৃষিজমির মাটি কেটে সেখানে শিল্পকারখানার বহুতল ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। ফসলি জমি নষ্টের পাশাপাশি সরকারি খাসজমি দখলে নেওয়ার এই তৎপরতা চলছে কালিয়াকৈর উপজেলার মাঝুখান এলাকায়।
কালিয়াকৈর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কাউছার আহম্মেদ অবশ্য সংবাদ মাধ্যমকে জানান, সরকারি জমি ঘিরে তোলা টিনের দেয়াল সরিয়ে নেওয়ার জন্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানটিকে অনেক আগেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, চাইনিজ প্রতিষ্ঠান এলডিসি গ্রুপ সেখানে পান্ডা স্যু ইন্ডাস্ট্রিজের ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্যে মাঝুখান পূর্বপাড়া এলাকার মাঝুখান-মুরাদপুর আঞ্চলিক সড়কের পাশে বেশ কয়েক একর ফসলি জমি কিনে আরও অনেকের জমিকে ঘিরে তোলা হয়েছে সীমানা প্রাচীর। ভেকু মেশিন দিয়ে ফসলি জমির মাটি কেটে ভবন তৈরির ভূমি তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ পরিস্থিতিতে কৃষকরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। তারা সংবাদ মাধ্যমকে বলছেন, পান্ডা ইন্ডাস্ট্রি ৫০ একরের মতো ফসলি জমি ঘিরে তাদের কারখানা ও কার্যক্রম গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে, তাতে কৃষিজমি আরও কমে আসবে এবং চাষাবাদের পরিবেশও নষ্ট হবে। আশপাশের পরিবেশের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
উল্লেখ্য, পান্ডা কারখানা এর আগেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষকদের কাছ থেকে নৌবাইঘা বিলের কয়েক একর ফসলি জমি কিনে সেখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে। এর ফলে সেখানকার কৃষি পরিবেশও বিপণ্ন হয়ে পড়েছে।
প্রাচীর তোলায় ক্ষেতে যেতে পারছেন না কৃষকরা
এ প্রসঙ্গে এম সওকত হোসেন নামের এক ভুক্তভোগী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘মাঝুখান পূর্বপাড়া বিলে আমার ১০৮ শতাংশ কৃষিজমি রয়েছে। কিন্তু পান্ডা কোম্পানি আমার জমির আশপাশের সব জমি কিনে ফেলে শিল্পকারখানা তৈরির ভূমি প্রস্তুত করছে। প্রথমে তারা আমার জমিটুকু কেনার জন্যে এলাকার কয়েকডজন প্রভাবশালী ব্যক্তি দিয়ে আমাকে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আমি তাতে রাজি না হওয়ায় তারা তাদের কেনা জমিতে সীমানা বাউন্ডারি দেওয়ার নামে আমার ক্ষেতটাকেও প্রাচীরের মধ্যে ঘিরে ফেলেছে। এখন আমার জমিতে যাওয়ার মতো কোনো রাস্তাই নেই।’
স্থানীয় কৃষক ঠান্ডু মিয়া সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘আমার বাবা মৃত বাবর আলী আর এস ১২০৫, এসএ ৫০০ নং দাগে ৯০ শতাংশ ডিসি খাসজমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে আসছিল। বাবার মৃত্যুর পর আমি সেই জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করছি। সম্প্রতি পান্ডা কোম্পানি সাবেক মেম্বার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে রঙিন টিনের প্রাচীর দিয়ে আমার সেই জমি দখলে নিয়েছে। আমাকে ক্ষেত ছেড়ে দিচ্ছে না, জমির মূল্যও দিচ্ছে না।’ তিনি জানান, ‘সমস্যা সমাধানের জন্য বেশ কয়েক বার সফিপুর ভূমি অফিস ও ইউএনও’র কাছে গেছি। সবাই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু পান্ডা আমার জমি এখনও জোর করে দখলে রেখেছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক কৃষক সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘বাপ-দাদার আমল থেকেই মাঝুখান পূর্বপাড়ার এই জমিতে আমরা কৃষিকাজ করে আসছি। বর্ষার মৌসুমে একই জমির পানিতে আমরা মাছ ধরে সংসার চালাতাম। আমাদের জমি অন্যদের জমির মাঝখানে ছিল। জমি না বেচলে আশপাশের জমি কিনে আমাদেরটাও দখলে নিয়ে যাবে, এই ভয়ে বাধ্য হয়েই পান্ডার কাছে তা বেচে দিয়েছি।’
কৃষক লোকমান হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘আমরা মাঝুখান পূর্বপাড়া বিলে আমাদের ৫০ শতাংশ জমিতে সব সময়ই কৃষিকাজ করে আসছি। পান্ডা আমাদের সেই জমি কেনার জন্যে সাবেক মেম্বার মোশাররফ হোসেনসহ স্থানীয় অনেক লোকজনের মাধ্যমে আমাকে চাপ দিয়ে আসছে। পান্ডা তাদের কেনা জমিতে কারখানা নির্মাণের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ শুরু করেছে। তাদের কাজের ফলে আমাদের জমিতে পানি জমতে শুরু করেছে। এভাবে পানি জমতে থাকলে ভবিষ্যতে আর আমরা কৃষিকাজ করতে পারব না।’
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
এ প্রসঙ্গে এলডিসি গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মোরশেদ আলম লিটন সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘কোম্পানির টাকা আছে, জমি কিনতেছে। আমরা কোনো ফসলি জমি নষ্ট করছি না। আর ঠান্ডুর লিজ নেওয়া সরকারি জমি আমার জানা মতে আমরা দখলে নেইনি। আমাদের কেনা জমিতে আমরা কাজ করছি। সেখানে কারখানা হবে, নাকি কৃষিকাজ হবে, সেটা পরের বিষয়।’
কালিয়াকৈর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কাউছার আহম্মেদ সংবাদ মাধ্যমকে জানান, ‘কৃষিজমি নষ্ট করে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ নেই। পান্ডা গ্রুপ সরকারি যে জমিটুকু দখলে নিয়েছে, সেই জমি থেকে তাদের টিনের দেয়াল সরিয়ে নেওয়ার জন্যে আগেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এ ব্যাপারে সাবেক মেম্বার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি অভিযোগ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সূত্র : প্রতিদিনের বাংলাদেশ