গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : অস্ত্রসহ আটকের পর মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পেয়ে পুলিশের তিন সদস্যের র্যাঙ্ক ব্যাজ কর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের এডিসির নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি এ সুপারিশ করেছে। এতে পরিদর্শক (ওসি) আবদুল কাইউমের র্যাঙ্ক ব্যাজ অবনমন করে এসআই করার সুপারিশ করেছে। একইভাবে এসআই মেহেদী হাসান ও কনস্টেবল নজরুলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে কমিটির প্রতিবেদনে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র সংবাদ মাধ্যমকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
আবদুল কাইউম বর্তমানে ডিএমপির গোয়েন্দা ইউনিটের মতিঝিল বিভাগে কর্মরত। ১৯৯৮ ব্যাচের এ কর্মকর্তা আগে রাজধানীর চকবাজার ও কাফরুল থানার ওসি ছিলেন, আর মেহেদী গুলশান থানায়।
গত বছর ৬ জুলাই এক আদেশে কাইউমকে রাজধানীর বাড্ডা থানার ওসি হিসেবে বদলি করেন ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। তিনি ওই বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাড্ডার ওসি ছিলেন।
সূত্র জানায়, অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাইফুল ইসলাম সুমীত চাঁদা দাবি করে আসছিল– এমন অভিযোগে তাকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু থানায় নিয়ে কোনো মামলা না দিয়েই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড় অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে ওসি কাইউম তাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রযুক্তিনির্ভর তদন্ত ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এমন অভিযোগের সত্যতা পেয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে ডিএমপি। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের এডিসি (ডিসি হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে এ তদন্ত হয়।
একাধিক সূত্র জানায়, এলাকায় আধিপত্য নিয়ে বাড্ডার পাখির গলির বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম সুমীতের সঙ্গে একই এলাকার খায়রুল ইসলামের বিরোধ চলে আসছিল। গত বছর ২০ আগস্ট বালু চুরির অভিযোগ এনে খায়রুলের এক স্টাফকে রাস্তায় পিস্তল ঠেকিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয় সুমীত। পরে অস্ত্র ঠেকানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় খায়রুলের লোকজন। এর পর ওই বছরের ২২ আগস্ট রাতে ওসি কাইউমের নির্দেশে বাসা থেকে সুমীতকে আটক করে বাড্ডা থানায় নিয়ে আসেন এসআই মেহেদী, কনস্টেবল নজরুলসহ একটি টিম। থানার তিনতলায় অস্ত্রাগারের পাশের একটি কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রাত দেড়টার দিকে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে সুমীতকে বাসায় পৌঁছে দেন এসআই মেহেদী ও কনস্টেবল নজরুল। ওই রাত তার বাসায় কাটান পুলিশের দুই সদস্য। রাতের খাবার এমনকি পরদিন সুমীতের সঙ্গে নাশতাও করেন তারা। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হলে পরদিন সকালে সুমীতকে সরাসরি গুলশানে ডিসির কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ‘খেলনা পিস্তল’ দেখিয়ে সাজানো জিডি করে ছেড়ে দেওয়ার আয়োজন সম্পন্ন করেছিল পুলিশ। সুমীতকে আটক, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাসায় পৌঁছে দেওয়া এবং জিডির অধীনে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়গুলো গুলশান বিভাগের বাড্ডা থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী পুলিশ কমিশনার ও অতিরিক্ত উপকমিশনারের কাছে পুরোপুরি চেপে যান আবদুল কাইউম।
ওই সূত্রের দাবি, এয়ারগানকে খেলনা পিস্তল দেখিয়ে মামলা না করেই জিডির ভিত্তিতে অভিযুক্তকে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনায় ২২ লাখ টাকা লেনদেন হয়। সুমীতের ব্যাংক হিসাব ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক আত্মীয়ের কাছ থেকে এ টাকা নেওয়া হয়। এ ব্যাপারে আবদুল কাইউম সমকালকে বলেন, ‘আমার ব্যাপারে নেগেটিভ কিছু পাওয়া যায়নি। এসব নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।’
এসআই মেহেদী হাসান বলেন, ‘বাড্ডায় থাকতে এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলাম– মনে পড়ছে না।’ বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরলে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে আর কে কে আছেন? ওসি স্যার আছে নাকি?’
ডিএমপির ডিসি (ডিসিপ্লিন অ্যান্ড প্রফেশনাল স্ট্যান্ডার্ড) আলমগীর হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, পুলিশ সদস্যদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর কোনো অভিযোগ পেলে সব সময় গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হয়। বাড্ডার ঘটনায় তিনজনের সংশ্লিষ্টতা প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত। তাদের একটি করে র্যাঙ্ক অবনমনের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এর পর অভিযুক্তদের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বাহিনীর সদস্য হিসেবে কেউ অন্যায় কাজে জড়ালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে শৃঙ্খলা বজায় থাকে। সাধারণ মানুষও বেশি সেবা পাবে।
আরেকটি সূত্র জানায়, সুমীতের কাছে থাকা এয়ারগানের সূত্রও পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় পল্টনের একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তদন্ত কমিটি। এ ছাড়া এক কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ সহযোগীর ওপর নজর রাখছে পুলিশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চকবাজার থানার ওসি থাকাকালে কাইউমের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে গাড়ি ব্যবসায়ী মোক্তার হোসেন পুলিশ সদরদপ্তরে অভিযোগ দেন, তার কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া করে বিভিন্ন জেলায় নিষিদ্ধ পলিথিন বহন করত মুরাদ নামে এক ব্যক্তি। জানতে পেরে গাড়ি দেওয়া বন্ধ করলে ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করে মুরাদ। ওই মামলায় মোক্তারকে থানায় নিয়ে নির্যাতন ও ৫০ লাখ টাকা দাবি করেন কাইউম। টাকা না দিলে অস্ত্র মামলায় ফাঁসানোর হুমকিও দেন। পরে ভয়ভীতি দেখিয়ে তিনি মোক্তারের স্ত্রীর কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা আদায় করেন।
পিআরবি (পুলিশ আইন) অনুযায়ী, পুলিশ সদস্যদের অপরাধমূলক কাজে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান রয়েছে। গুরুদণ্ডের আওতায় বরখাস্ত, পদাবনতি; পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধি স্থগিত এবং চাকরিকালীন সুযোগ-সুবিধা বাতিল করা হয়। অপরাধ প্রমাণিত হলে বরখাস্ত করা হয়। গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। আর ছোটখাটো অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইন্স বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিসিএস ক্যাডারের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ (শৃঙ্খলা ও আপিল) অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
২০২২ সালে ১৮ হাজার ৬১৮ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ আসে। তদন্ত শেষে শাস্তি হয় ১৭ হাজার ৫১৮ জনের। ২০২৩ সালে ১৯ হাজার ১৮ জনের ব্যাপারে অভিযোগে ওঠে, যার মধ্যে ১৮ হাজার ৫২৮ জন শাস্তি পেয়েছেন। পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, অপেশাদার কর্মকাণ্ডে জড়ানোর অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।
সূত্র: সমকাল