গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : প্রথম ধাপে ১৫০টি উপজেলায় ভোট আগামী ৮ মে। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন সোমবার প্রতিটি উপেজেলায় চেয়ারম্যানসহ তিনটি পদে মোট এক হাজার ৮৯১ জন মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন।
তার মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬৯৬, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭২৪ এবং নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪৭১ জন প্রার্থী হয়েছেন।
এবারের নির্বাচনে কোনো দলীয় প্রতীক থাকছে না। বিএনপি এই নির্বাচন দলীয়ভাবে বর্জন করছে। জামায়াতও অংশ নেবে না। তারপও ১৫০ উপজেলার মধ্যে ৩৫টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বিএনপির প্রার্থীরা মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। আর জামায়াতের ২৫ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।তারপরও নির্বাচন আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগই হচ্ছে। অধিকাংশ আসনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের তিন-চারজন করে প্রার্থী আছেন।
গ্রুপিং আর দ্বন্দ্বের শুরু:
আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক এবং মনোনয়ন দেয়া থেকে বিরত থাকলেও স্থানীয় পর্যায়ে সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতারা তাদের সমর্থিত প্রার্থী ঘোষণা করছেন। যা নিয়ে তৃণমূলে এরইমধ্যে বিভেদ ও গ্রুপিং তৈরি হয়েছে। এই গ্রুপিং সংঘাতে রুপ নিতে পারে। এবার যেন সবাই উপজেলা চেয়ারম্যান হতে চায়।
এই প্রবণতার কথা জানান সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মো. নুনু মিয়া। এইসব পরিস্থিতি দেখে নুনু মিয়া এবার উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হননি। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আওয়ামী লীগ থেকে যারা প্রার্থী হয়েছেন তারা সবাই চাইবেন দলের লোকজন যেন তার সঙ্গে থাকে। তারপরও এখানে তো জনপ্রিয়তার বিষয় আছে। আবার এখনও তো মনোনয়ন যাচাই বাছাইয়ের ব্যাপার আছে । সেটা শেষ হলে প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যাবে।” এই উপজেলায় মোট ১১ জন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। তারমধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আছেন ছয়জন। বিএপির চার এবং জামায়াতের একজন।
বাংলাদেশ আঞ্জুমান আল ইসলাহ নামের একটি দলের বিশ্বনাথ উপজেলার সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিবুর রহমান। তিনি ওই উপজেলা পরিষদের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান হলেও এবার নির্বাচনে প্রার্থী হননি। তার কথা, “সবাই মনে করছে এবার নির্বাচনে যেহেতু কোনো দলীয় প্রতীক ও মনোনয়ন নাই তাই নির্বাচন ফেয়ার হবে। সবাই তাই জনপ্রিয়তা যাচাই করতে নেমেছে। ” এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”আওয়ামী লীগ যেহেতু ক্ষমতায় তাই তাদের প্রার্থীরা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে। আর তাদের একাধিক প্রার্থী হওয়ায় দলের স্থানীয় পর্যায়ে গ্রপিং ও দ্বন্দ্ব চলছে নির্বাচনকে নিয়ে।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরাইল উপজেলায়ও চেয়ারম্যান পদে ১১ জন প্রার্থী। একটি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের আটজন। দুইজন বিএনপির এবং একজনের কোনো দলীয় পরিচয় নেই।
জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সরাইল উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মো আবু হানিফ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমাদের সরাইলে সব সময়ই দলের মধ্যে কোন্দল আছে। এই নির্বাচনে কোন্দল আরো বাড়বে। এটা একটা দলীয় কোন্দলের জায়গা। এই কোন্দলের কারণে বিএনপির প্রার্থীর প্রার্থী পাস করে যেতে পারে।”
তার কথা, “এরই মধ্যে আমাদের চারজন প্রার্থী নানা ধরনের গ্রুপিং শুরু করে দিয়েছেন। আমরাও তো আর বসে থাকতে পারব না।”
বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীরা যা বলছেন:
ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলায় যারা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল আলম। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”দলের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত থাকলেও আমি এবার নির্বাচন করছি। আমার ওপর স্থানীয় মানুষের চাপ আছে, তৃণমূলের চাপ আছে নির্বাচন করার। তারা চায় আমি যেন নির্বাচন করি। এবার আমি আর নির্বাচনের বাইরে থাকব না।”
দল যদি এই কারণে বহিষ্কার করে তাহলে কী করবেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমি আসলে জনগণের চাওয়ার প্রতি সম্মান জানিয়ে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।এই নিয়ে আর কিছু বলার নেই। তবে নির্বাচনে কোনো দলীয় প্রতীক থাকছে না। যদি ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ পায় এবং নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় তাহলে যারা জনপ্রিয় প্রার্থী তারা জয়ী হবেন। জনতার জয় হবে।”
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “দীর্ঘদিন বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যে হতাশ তা বলব না। তবে এই নির্বাচনে অংশ নিলে একটা গতি আসত। তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের কাছে একটা নির্বাচনী বার্তা যেত বলে বলে মনে করি।”
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা চেয়াম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির যুব সংগঠন যুবদলের উপজেলা যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদুর রহমান তুষার। তিনি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমি ২০ বছর ধরে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছিলাম । গত নির্বাচনে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ষড়যন্ত্র করে আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। তাই আমি এবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। তবে জনগণও আমাকে চায়। তাদের চাওয়া পুরণ করতেই আমি প্রার্থী হয়েছি।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দল (বিএনপি) আমাকে অনুমতি দেয়নি। আর অনুমতির জন্য আমি কারুর কাছে যাইনি। আমি এই জীবনে বিএনপিতে আছি সব সময় বিএনপির চিন্তা করব এবং বিএনপিইতেই থাকব। দল যদি আমাকে বলে দাঁড়ানো যাবে না তখন আমি চিন্তা করব। এখন পর্যন্ত আমি প্রার্থী আছি।”
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় জামায়াতের উপজেলা কর্মপরিষদ সদস্য হাবিবুর রহমান সাতা প্রার্থী হয়েছেন। তিনি এর আগে ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”শুধু আমি না আমাদের আরো কিছু নেতা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন। তবে এটা এখনো চূড়ান্ত কিছু না। দল শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয় তার উপরে নির্ভর করছে শেষ পর্যন্ত আমি প্রার্থী থাকব কী না।”
আর পাবনার সাথিয়া উপজেলা জাময়াতের আমির মোখলেছুর রহমানও এবার ওই উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রাথী হয়েছেন। তিনি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানও। তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমরা প্রথমে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দলীয়ভাবে। তবে দল এখন বলছে প্রার্থী হওয়া যাবে না। সেটা হলে আমি আমার মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করে নেব।”
কেন্দ্র যা বলছে:
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”এবার দলীয়ভাবে উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে কোনো প্রার্থীও দেয়নি। তবে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো এমপি বা নেতা যে কাউকে সমর্থন দিতে পারেন। এটা তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। আমরা চাই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর হোক। ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যাক।”
“যদি দলের কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন তাহলে দল তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কেউ সংঘাত সংঘর্ষে জড়ালে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে,” বলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা চাই বিএনপি এই নির্বাচনে আসুক। তারা আসলে আমরা খুশি। আর জামায়াতের তো সেই সুযোগ নাই। তারা ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে।”
এদিকে বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বর্জনের নিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, “সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।” বিবৃতিতে বলা হয়, “বিএনপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এবং প্রশাসন ও পুলিশের একপেশে ভূমিকার জন্য এর আগেও জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করেছে। এখনো সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি।”
দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স সংবাদ মাধ্যমকে জানান, “বিএনপির যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের এরইমধ্যে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিতে বলা হয়েছে। যারা প্রত্যাহার করবেন না তাদের বিরুদ্ধে দল কঠোর সিদ্ধান্ত নেবে।”
এদিকে জামায়াতে ইসলামীও উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানা গেছে। তবে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছু জানায়নি।
সূত্র: ডয়চে ভেলে