গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : নাথান লনচেও বম। এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাথান বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সদর্প অংশগ্রহণ ছিল মিছিল-মিটিংয়ে। ১৯৯৬ সালে চারুকলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। হতে চেয়েছিলেন পুরোপুরি রাজনীতিবিদ। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) ছাত্র সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) ঢাকা মহানগর শাখা ও কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। খাগড়াছড়ির চেঙ্গী স্কয়ারের পাশে সন্তু লারমার ভাস্কর্যটির অন্যতম কারিগরও তিনি। প্রকাশ্য রাজনীতির জগৎ ত্যাগ করে নাথান বম এখন হয়ে উঠেছেন পাহাড়ের ত্রাস।
এক বছর ধরে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা নাথানের পারিবারিক, রাজনৈতিক কর্মকান্ডসহ খুঁটিনাটি বহু তথ্য সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদন থেকে তার বিষয়ে বিস্তারিত জানা গেছে।
ওই প্রতিবেদন থেকেই জানা যায়, একটা সময় আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে নাথান বমের। বেশিরভাগ সময় থাকতেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। মাঝেমধ্যে চলে যেতেন ভারতের আসাম ও মিয়ানমারে। এভাবে নানা দিকে আনাগোনার একপর্যায়ে গঠন করেন কুকি-চিন জাতীয় ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (কেএনডিও)। তিনি এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কয়েক বছর পর এ সংগঠনটি ভেঙে গড়ে তোলেন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)।
জানা গেছে, লাথান বম কুকি-চিনভুক্ত জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ‘দ্য বমজৌ’সহ ছয়টি বই প্রকাশ করেছেন। বম সম্প্রদায় থেকে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থীও হয়েছিলেন। সন্তু লারমাকে টেক্কা দিতেই মূলত নাথান বাম সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। অথচ সন্তুর লারমার একটি ভাস্কর্য তৈরি করেছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাথান বম দেশের বাইরে থেকে নিয়মিত অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তার গ্রুপে বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের মতো। তারা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। জড়িয়ে পড়েছে প্রকাশ্য অপরাধে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যেও একের পর এক অপরাধ কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে। ২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ট্রাই-জংশনের কাছাকাছি সীমান্ত লাগোয় ভারতের মিজোরাম রাজ্যের লংতলাই জেলার পারভা থেকে কেএনএফের ছয়জনকে আটক করে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। এরপরই কেএনএফ আলোচনায় আসে। আটকের পর আসামিদের কাছে থাকা একটি চিঠিতে কেএনএফের সামরিক শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সভাপতি ও চিফ অব স্টাফের সিলমোহরসহ কিছু সরঞ্জাম উদ্ধারের কথা জানায় বিএসএফের ১৯৯ নম্বর পারভা ব্যাটালিয়ন। আটককৃতদের কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের তথ্যও জানা যায়। ওই বছরের ১২ এপ্রিল পারভা ১১৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ সশস্ত্র সরঞ্জামসহ কেএনএফের চার সদস্যকে আটক করে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলা নিয়ে কেএনএফের কল্পিত কুকি-চিন রাজ্য গঠিত। বম, পাঙ্খুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো, খিয়াং নামের ছয় জাতিগোষ্ঠীর কিছু লোকজন নিয়ে কেএনএফ গঠিত হয়। তারা নিজেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাসিন্দা মনে করে। একই সঙ্গে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকে বার্মিজ ও ভারতীয় জাতিভুক্ত এবং বহিরাগত মনে করে। আর এ কারণে জেএসএস ও ইউপিডিএফের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি তাদের মধ্যে বৈরী মনোভাব রয়েছে।
লাথান সম্পর্কে গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত বছর ২৪ জুলাই কেএনএফের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার যোগাযোগের নতুন তথ্য সামনে আনে র্যাব। সংগঠনটির কথিত আমির মো. আনিসুর রহমান মাহমুদকে গ্রেপ্তারের পর নাথান বমের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ থাকার বিষয়টি জানা যায়। তাছাড়া নাথান যখন চারুকলার ছাত্র, জামা’আতুল আনসারের নেতা শামিন মাহফুজ তখন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। ওই সময় তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। ২০২০ সালের শুরুর দিকে নাথানসহ কেএনএফের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আসলাম নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে গহিন পাহাড়ে প্রশিক্ষণ নিতে যান আনিসুর রহমান মাহমুদ। সেখানে আসলামের তত্ত্বাবাবধানে তিনি প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি কুমিল্লায় এসে নিজের সম্পত্তি ৫০ লাখ টাকার বেশি দামে বিক্রি করে দেন। এরপর নাইক্ষ্যংছড়িতে তিন বিঘা জায়গা কিনে পরিবারসহ থাকতে শুরু করেন। তিন বিঘা জমির দাম দিয়ে বাকি টাকা তিনি নতুন জঙ্গি সংগঠনকে দেন। ২০২১ সালে নাথানের সঙ্গে জামা’আতুল আনসারের আমিরের একটি সমঝোতা হয়। পার্বত্য অঞ্চলে কেএনএফের ছত্রছায়ায় জামা’আতুল আনসার সদস্যদের ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে চুক্তিও হয়। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি মাসে ৩ লাখ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি জামা’আতুল আনসার কেএনএফ সদস্যদের খাবার খরচ বহন করে আসছিল।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, বান্দরবানের রুমা সদর ইউনিয়নের ইডেনপাড়ার বাসিন্দা মৃত জাওতন লনচেওর ছেলে নাথান লনচেও বম। তার বাবা ছিলেন পেশায় জুমচাষি। মায়ের নাম রৌকিল বম। তিনিও মারা গেছেন। ছিলেন গৃহিণী। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে লাথান ছোট। অভাবের সংসারে বড় হন লাথান। পরিবারের সদস্যদের আহার জোগাতে নাথান বমকেও মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছিল। স্থানীয় সেনা ক্যাম্প, জোন ও ব্রিগেডে সাহায্যের জন্যও যেতেন। একসময় জেএসএসের সন্তু গ্রুপের পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে (পিসিপি) যোগ দেওয়ার কারণে নাথান বমের পড়াশোনার দায়িত্ব নেন সন্তু লারমা। এরপর তার জীবন ও পরিবারের জীবনধারা পাল্টে যায়। পরিবারের অনেক সদস্য সরকারি চাকরি পান। নিজের স্ত্রী লাল সমকিম বম রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স হিসেবে যোগ দেন। তাদের দুটি সন্তান আছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সন্তু লারমার সঙ্গে তার বিরোধ দেখা দেয়। পরে তিনি দল ছেড়ে চলে যান।
কেএনএফ রাঙ্গামাটির সাজেক উপত্যকা বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বান্দরবান উপকণ্ঠ থেকে চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো অঞ্চল হয়ে রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি, লামা ও আলীকদম এ নয়টি উপজেলা নিয়ে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত একটি পৃথক রাজ্য তৈরির লক্ষ্যে কর্মকান্ড শুরু করে। খ্রিস্টানদের ওপর সংখ্যাগুরুদের ধর্মীয় আগ্রাসন ও বিমাতাসুলভ আচরণের জন্যই মূলত কেএনএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে পৃথক পূর্ণ-স্বায়ত্তশাসন দাবি করছে। ২০১৬ সালে কেএনএফের সশস্ত্র শাখা কেএনএ গঠিত হয়। প্রথমদিকে তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পরিচালনা করে এবং ভারতের মণিপুর ও বার্মার চিন রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। প্রথম ব্যাচে শতাধিক সদস্যকে মণিপুরে প্রশিক্ষণে পাঠায়। এরপর ১০০ সদস্যকে ভারতের মণিপুর, বার্মার কারেন ও কাচিন রাজ্যে গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। ২০১৯ সালে ইনফেন্ট্রি ও কমান্ডো প্রশিক্ষণের পর তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ফিরে আসে। শুরুতে তারা নিশ্চুপ থাকে কিছুদিন, এরপর সক্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমানে তাদের সশস্ত্র শাখার সদস্য সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, কেএনএফ পার্বত্য চট্টগ্রাম ও মিজোরামে সক্রিয় রয়েছে। সশস্ত্র সদস্যদের প্রশিক্ষণের মেয়াদ থাকে তিন মাস। তার মধ্যে এক মাস মিজোরামে তাত্ত্বিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং বাকি দুই মাস মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রতিটি সদস্য সামরিক কৌশলে উচ্চতর দক্ষতাসম্পন্ন ও যুদ্ধংদেহী। তাদের কাছে থাকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। কেএনএফ বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের নানা ছবি ও ভিডিও আপলোড করে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, পাহাড়ের বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো ও খিয়াং এ ছয়টি সম্প্রদায়কে অনগ্রসর ও শান্ত স্বভাবের সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য করা হতো। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে দখলদাররা অনুপ্রবেশ করে এবং তাদের ভূমি দখল করে নেয়। ফলে কেএনএফের মতে তারা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। ৪৭-এর উপমহাদেশের বিভক্তি ও ৭১-পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রাম জেএসএসের সশস্ত্র আন্দোলনের ফলে পার্বত্য জেলা ছেড়ে ভারতের মিজোরামের লংতলাই, লুংলেই ও মামিট জেলায় দেশান্তরিত হয় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এই সম্প্রদায়ের অনেকে। তাদের অনেকে এখন আর্থিক সহায়তা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই কুকি-চিন রাজ্য প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র আন্দোলনে জড়িত হওয়ার পরিকল্পনা করছে বলে জানা যায়।
কেএনএফের অভিযোগ, বিভিন্ন মহল তাদের ভূমিতে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। জেএসএসসহ অন্য সংগঠনগুলো কুকি-চিন জনগোষ্ঠীদের ভূমি ব্যবহার করে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করে চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুমসহ নিরীহ মানুষদের ভীতির মধ্যে রেখেছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন করে। পার্বত্য তিন জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে জেএসএস (মূল), ইউপিডিএফ (মূল), জেএসএস (সংস্কার) এবং ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও মগ পার্টি নামে পাঁচটি সংগঠনের বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে পাহাড়ে সংঘাতপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছে। কেএনএফ যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে পাহাড়ে আরও সংঘাত বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।