অর্থনীতিআলোচিতজাতীয়

আয় কর দেয় না ৮৭ ভাগ ধনী!

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : ধনী এবং উচ্চ মধ্যবিত্তদের শতকরা ৮৭ ভাগ আয় কর দেন না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি৷

তারা বলছে,“ কর প্রশাসনের অদক্ষতা এবং কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা এই কর ফাঁকি দিচ্ছেন৷ এই কারণে কখনোই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর) কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনা৷”

এবং কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা এই কর ফাঁকি দিচ্ছেন৷ এই কারণে কখনোই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড(এনবিআর) কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না৷”

এনবিআরের সঙ্গে রোববার প্রাক-বাজেট বৈঠকে অর্থনীতি সমিতি জানায়,”এদেশে ১৮ লাখ মানুষ কর দেন৷ তাদের মধ্যে ১০ লাখ সরকারি চাকরিজীবী এবং অন্যান্য চাকরিতে নিয়োজিত আছেন৷ আমাদের হিসাবে, দেশে ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যে আয়কর দেয়া লোকের সংখ্যা ৯-১০ লাখ হবে৷ এই সংখ্যা হওয়ার কথা ৭৮ লাখ ৩২ হাজার৷ এর মানে, ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্তদের ৮৭ শতাংশ কোনো ধরনের আয়কর দেন না৷”

অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”আমরা গবেষণায় ওই তথ্য পেয়েছি৷ এদেশে এমনিতেই মানুষের মধ্যে আয়কর দেয়ার প্রবণতা কম৷ আর উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের মধ্যে এটা আরো কম৷ যারা দেয় না সেই ৮৭ ভাগের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে পারলে রাজস্ব ঘাটতি থাকতো না৷”

এনবিআর কখনোই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না৷ আইএমফের ঋণের শর্তের মধ্যে অন্যতম হলো রাজস্ব আদায় বাড়ানো এবং কর প্রশাসনের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি৷

কিন্তু চলতি অর্থবছরেও এনবিআর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা৷ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা৷ লক্ষ্যমাত্রা কমানোয় এখন তা দাঁড়ালো চার লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা৷

অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি হয়েছে ২৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকা৷ এই প্রেক্ষাপটে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হলেও তাও অর্জন করা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হবে না বলে মনে কছেন বিশ্লেষকেরা৷

বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ কর মোট করের শতকরা ৩০ ভাগ৷ আর বাকি ৭০ ভাগ পরোক্ষ কর৷ এই পরোক্ষ করের চাপ সবচেয়ে বেশি দেশের সাধারণ মানুষের ওপর৷ কিন্তু অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, প্রত্যক্ষ কর সবার শীর্ষে থাকা উচিত৷ সেটা হলো আয়কর৷ যেটা ব্যক্তির আয়ের ওপর নির্ভর করে৷ কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো ঘটনা ঘটছে৷ আর এখানে কর জিডিপি অনুপাত এখনো ১০ শতাংশের ঘরে- যা এশিয়ায় সর্বনিম্ন৷

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”এর আগে অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত বলেছিলেন মানুষ সিন্দুকে কোটি কোটি টাকা রেখে দিয়েছে৷ পরে অভিযান চালিয়ে তার প্রমাণ পায়া যায়৷ এনু-রুপনের বাড়ি থেকে সিন্দুক ভর্তি টাকা উদ্ধার করা হয়৷ এবার অর্থনীতি সমিতি বলছে ৮৭ ভাগ ধনী এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত আয়কর দেয় না৷ সংখ্যাটা কত ভাগ হবে সেই জরিপ আমি করিনি৷ তবে আমার অভিজ্ঞতা হলো অধিকাংশই দেয় না৷”

অধ্যাপক মো. আইনুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”ধনী যারা আয়কর ফাঁকি দেন তাদের ব্যাংক হিসাবে অর্থ থাকলেও তা দেখান না৷ আর এজন্য ব্যাংক এবং এনবিআরের একশ্রেণির কর্মকর্তা সুবিধার বিনিময়ে তাদের সহায়তা করেন৷ আর তাদের আয়ের একটি অংশ তাারা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে রেখে দেশের বাইরে পাচার করেন৷ কিন্তু এটা চিহ্নিত করা কোনো কঠিন কাজ না৷ নানা টুলস আছে সেগুলো ব্যবহার করলেই চিহ্নিত করা যায়৷ এখানে এনবিআর আগ্রহ দেখায় না৷ আবার যারা ফাঁকি দেয় তারা নানাভাবে প্রভাশালী৷”

তার কথা,”দেশে যাদের টিআইএন নাম্বার আছে তাদের সবার কাছ থেকে কর আদায় করতে পারলেও ঘাটতি থাকে না৷ সেটা না করে এনবিআর পরোক্ষ কর বাড়ায়৷ নিত্য ব্যবহারের পণ্যের ওপর এই কর দেশের সাধারণ মানুষকে দিতে হয়৷ আর যারা ধনী তারা রেহাই পেয়ে যান৷”

এজন্য অর্থনীতি সমিতি দেশে ট্যাক্স কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে৷ যেখানে কর যারা বোঝেন সেরকম বিশেজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিরা থাকবেন৷ আর লেনদেন যত দ্রুত সম্ভব ডিজিটাল করার পরামর্শ দিয়েছেন তার৷ আর ওই পদ্ধতির সঙ্গে এনবিআর যুক্ত থাকলে সবার আয় ব্যয়ের খবর তারা পাবেন৷ চিহ্নিত করতে পারবেন৷

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ( সিপিডি) ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশে বছরে কোটি টাকা আয় করেন এরকম জনগোষ্ঠীর ৬৭ শতাংশ কর আওতার বাইরে আছে৷ এরা যে লার্জ ট্যাক্সপেয়ার ইউনিটের মধ্যে তা নয়৷ এরা সারাদেশেই ছড়িয়ে আছেন৷ কিন্তু এদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না৷

বদিউর রহমান বলেন,”রাষ্ট্রযন্ত্র ফেয়ার না হলে ধনীদের কাছ থেকে আয়কর আদায় সম্ভব নয়৷ কারণ তারা প্রভাশালী, তারা রাষ্ট্র যন্ত্রেও সঙ্গে যুক্ত৷ তাদেরকে ছাড় দেয়া হয়৷ দেশে গ্রাম পর্যন্ত এখন বহু লোক গাড়ি-বাড়ি হাঁকায়, কিন্তু তারা আয়কর দেয় না৷”

তিনি জানান,”আমি যখন এনবিআরের চেয়ারম্যান তখন ওয়ান ইলেভেন সরকার৷ তখন একবার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে দেয়া হয়নি৷ আমি গুলশান-বনানী-ধানমন্ডি এলাকায় ট্যাক্স বুথ বসিয়ে আয়কর আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছিলাম৷ পদ্ধতিটি ছিল, এনবিআর, পুলিশ ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সমন্বয়ে টিম করে বাড়ি বাড়ি যাওয়া৷ কত বাসা ভাড়া দেন তা জানা৷ তো এখন থেকে ১৭ বছর আগে যদি কেউ ২০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিয়ে থাকেন তাহলে তার আয় কত তা বুঝতে অসুবিধা ছিল না৷ আমি চেয়েছিলাম তাৎক্ষণিক টিআইএন নাম্বার দিতে৷ কিন্তু আমাকে থামিয়ে দেয়া হয়৷”

এভাবে যতি সারাদেশে জরিপ করা হয় তাহলে যারা আয় কর ফাঁকি দেয় তাদের চিহ্নিত করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন৷
তার কথা,”ওই সময়ে নির্দলীয় সরকার ছিলো তারপরও আমাকে করতে দেয়া হয়নি৷ আর এখন তো দলীয় সরকার৷ তাহলে সেটা কীভাবে সম্ভব?”

এই দুই জন বলেন, আয়কর ঠিকমতো আদায় হলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি কর আদায় হতো৷ সেটা না করে যারা কর দেন তাদের উল্টো নানা রকম হয়রানি করা হয়৷ আর গরিব মানুষের ওপর করের বোঝা চাপানো হয়৷ এদেশে যাদের সম্পদ বেশি তারা কম কর দেয়৷ যাদের নেই তারা বেশি কর দেয়৷

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশ ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন,”প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) বাড়ানো গেলে আমাদের এখন যে কর জিডিপি অনুপাত ৮.৫ শতাংশ আছে তা বেড়ে যাবে৷ তাই অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন ও বাজেট ঘাটতি কমাতে যারা আয়কর দেয়ার যোগ্য হওয়ার পরও আয়কর দেন না তাদের কর আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে৷ যারা কর ফাঁকি দেন তাদের কর দিতে বাধ্য করতে হবে৷ এজন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে৷ আইন প্রয়োগ করতে হবে৷ শাস্তি ও প্রণোদনা দুটোই দিতে হবে৷ প্রত্যক্ষ করই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে৷ এটাই সবচয়ে বেশি হওয়া উচিত৷”

তার কথা,”পরোক্ষ করের চাপ সাধারণ মানুষের ওপর বেশি পড়ে৷ তাদের আয় কম৷ ফলে চাপ বাড়ে৷ তাই এনবিআরের প্রত্যক্ষ কর আদায়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত৷”

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button