গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত রয়েছে—এমন সংসদ সদস্যদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সংসদীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ কমিটির সভাপতিও হয়েছেন। এছাড়া যারা বিদায়ী সরকারের মন্ত্রী ছিলেন, এমন ডজন খানেক সংসদ সদস্য ওই মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হয়েছেন। এসব কমিটি গঠনে কার্যপ্রণালি বিধির নির্দেশনায় ব্যত্যয় ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে। এভাবে কমিটি হলে সংসদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
অবশ্য জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে সদ্য সাবেক মন্ত্রীদের কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। আর যে কেউ ব্যবসা করতে পারেন, তবে দেখতে হবে ব্যবসাটি সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরুর পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সবগুলো গঠন করা হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে গত ৩০ জানুয়ারি। এরপর সংসদের দ্বিতীয় বৈঠক ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী চার কার্যদিবসের মধ্যে ৫০টি সংসদীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। ৩৯টি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির মধ্যে ১৩টির সভাপতি হয়েছেন সদ্য বিদায়ী সরকারের মন্ত্রীরা। এর মধ্যে ১২ জনই নিজ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কমিটির সভাপতি হয়েছেন।
জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে বলা আছে, এমন কোনও সদস্য সংসদীয় কমিটিতে নিযুক্ত হবেন না—যার ব্যক্তিগত, আর্থিক ও প্রত্যক্ষ স্বার্থ কমিটিতে বিবেচিত হতে পারে, এমন বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে। সংসদীয় কমিটির কাজ হলো—বিল পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়া এবং কমিটির আওতাধীন মন্ত্রণালয়ের কাজ পর্যালোচনা, অনিয়ম ও গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করা।
সংসদ সদস্যদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কমিটিতে থাকা গুরুতর উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রবণতার কারণে দেশের যে দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট এবং স্বার্থপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত, পরবর্তীকালে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখা এ জন্যই হচ্ছে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হয়েছেন বিদায়ী সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি পোশাক খাতসহ অন্যান্য ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কমিটির অন্য সদস্যদের মধ্যে আকিজ গ্রুপের শেখ আফিল উদ্দিন ও তার পরিবার ডজন খানেক ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। কমিটির সদস্য সুলতানা নাদিরা টাইলস ও ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি হয়েছেন নোয়াখালী-১ আসনের সরকার দলের এমপি এইচএম ইব্রাহীম। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ব্লমিংডেল লিমিটেড ও রয়েল ড্রেসেস ইন্টারন্যাশনাল। এছাড়া তিনি বিদ্যুৎ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং শিপিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই কমিটির সদস্য শামীম ওসমানের তৈরি পোশাক শিল্প ব্যবসা (উইসডম নিটিং মিলস) রয়েছে। সদস্য এস এম আল মামুনের রয়েছে শিপ ব্রেকিং ব্যবসা।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু নৌযান ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঢাকা-বরিশাল রুটে তার একাধিক লঞ্চ চলাচল করে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী জনশক্তি রফতানি ব্যবসায় যুক্ত আছেন বলে জানা গেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুর রউফের পেট্রোল পাম্পের ব্যবসা আছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী ঠিকাদারি ব্যবসা করেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ৩৯টি স্থায়ী কমিটির মধ্যে ১২টি কমিটিতে সভাপতির পদ পেয়েছেন সাবেক ১২ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ কে আব্দুল মোমেন, অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি টিপু মুনশি, কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শ ম রেজাউল করিম, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি গোলাম দস্তগীর গাজী, ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাইফুজ্জামান চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি বীর বাহাদুর উশৈসিং, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শরীফ আহমেদ এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সাবেক মন্ত্রীদের সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটিতে সভাপতি বা সদস্য হিসেবে না রাখার কথা বলে আসছি। সাবেক মন্ত্রীদের কমিটিতে কোনও পদেই না রাখা উচিত ছিল। আরেকটি কাজ করতে পারতো, যাদের যে খাতে ব্যবসা আছে, তাদের সেই খাত সংশ্লিষ্ট কমিটিতে না রাখা। এবারের কিছু সংসদীয় কমিটিতে স্বার্থের দ্বন্দ্বের মাপকাঠিতে দুই ক্ষেত্রে ব্যাপক মাত্রায় হয়েছে।’
জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সদ্য সাবেক মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয়ে কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তারা অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সংসদীয় কমিটিকে গতিশীল করতে পারবেন। ব্যবসা অনেকের আছে, যে কেউ ব্যবসা করতে পারেন। দেখতে হবে তারা সরকারের সঙ্গে ব্যবসা করছেন কিনা।’
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন