আলোচিত

নিরাপত্তা, দারিদ্র্যের কারণে বেড়েই চলেছে বাল্যবিবাহ

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সি শিশুদের বিয়ে ৫০ শতাংশ বেড়েছে৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা, দারিদ্র্য ও সচেতনার অভাবে বাল্যবিয়ে কমানো যাচ্ছে না৷ বরং প্রতিবছরই বাড়ছে৷ সরকারি নানা পদক্ষেপ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোগও কাজে আসছে না৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক সংকটের কারণে মূলত নিম্নবিত্ত মানুষ কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন৷

‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২২’ শিরোনামের চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি গত বুধবার প্রকাশ করেছে বিবিএস৷ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে ১৫ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ের ঘটনা বেড়ে ৪০ দশমিক ৮৫ শতাংশে পৌঁছেছে৷ আগের বছর যা ছিল ৩২ দশমিক ৩৬ শতাংশ৷ অন্যদিকে, ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ের ঘটনা আগের বছরের চেয়ে ২০২২ সালে প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে৷ এ ধরনের বিয়ের ঘটনা বেড়ে হয়েছে ছয় ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল চার দশমিক ৭২ শতাংশ৷

বিবিএসের এসডিজি প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘যে লক্ষ্যে জরিপ, সে সংক্রান্ত তথ্যই সাধারণত আমরা সংগ্রহ করে থাকি৷ তাই জরিপ থেকে বাল্যবিয়ের কারণ খোঁজা হয়নি৷ তবে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে আমরা যেসব কারণ জানতে পেরেছি তার মধ্যে অন্যতম হলো, বাবা-মায়ের চোখে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, দারিদ্র্য ও সচেতনতার অভাব৷ বয়স লুকিয়ে আদালতের মাধ্যমে বিয়ের ঘটনাও বাড়ছে৷ বিয়ে অনুষ্ঠানের ব্যয় এবং ঝামেলা এড়াতে বাবা-মা এতে সহযোগিতা করছেন৷ তবে আমাদের কাছে মেয়েদের বয়সের তথ্য থাকায় আমরা বিষয়টি শনাক্ত করতে পেরেছি৷ এ ছাড়া করোনা অতিমারির অভিঘাতও বাল্যবিয়ের কারণ হতে পারে৷ ওই সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল৷ ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ছিল বাবা-মায়ের মধ্যে৷”

গত ডিসেম্বরে ‘কনে হওয়ার জন্যই জন্ম’ এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্র্যাকের সোশ্যাল এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড লিগ্যাল প্রোটেকশন (সেলপ) কর্মসূচি৷ বাল্যবিবাহের প্রবণতা ও কারণ জানতে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন ও আইনি সুরক্ষা কর্মসূচি ২৭টি জেলায় এই জরিপ চালিয়েছে৷ জরিপের তথ্য বলছে, এসব জেলায় ৪৪ দশমিক সাত শতাংশ মেয়ে ১৮ বছরের আগেই বাল্যবিবাহের শিকার হয়৷

৬০ শতাংশেরও বেশি পরিবারে বাল্যবিয়ে

ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা যায়, বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েদের ছয় দশমিক নয় শতাংশের বয়স ১৫ বছরের নিচে৷ এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে পিরোজপুর, সেখানে বাল্যবিয়ের হার ৭২ দশমিক ছয় শতাংশ৷ এই হার সবচেয়ে কম নেত্রকোনায় ২৪ দশমিক এক শতাংশ৷ শীর্ষে থাকা অন্য জেলাগুলোর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাল্যবিয়ের হার ৬৫ দশমিক দুই শতাংশ, নওগাঁয় ৬৫ দশমিক দুই শতাংশ, ঠাকুরগাঁওয়ে ৬২ দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং জয়পুরহাটে ৬১ দশমিক চার শতাংশ৷ এছাড়া যোগ্যপাত্র পাওয়ার কারণে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন ৪৪ শতাংশ অভিভাবক৷

কারণগুলোর মধ্যে ১৮ শতাংশ দারিদ্র্য, ১০ শতাংশ বরপক্ষ যৌতুক কম বা না চাওয়া, সাত শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, মেয়ে পড়ালেখায় ভালো না হওয়াকে ৬ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণের কথা বলেছেন আরও ১৫ শতাংশ অভিভাবক৷

ব্র্যাকের গবেষণা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি পরিবারে বাল্যবিবাহের চর্চা হচ্ছে৷ গত পাঁচ বছরে এসব পরিবারে যেসব মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা পুত্রবধূ হিসেবে যারা এসেছে তাদের বয়স বিয়ের সময় ১৮ বছরের কম ছিল৷ এছাড়া ৫৬ শতাংশ বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের মাধ্যমিক পাশ করার আগেই বিয়ে হয়ে গেছে বলে ব্র্যাকের এই গবেষণায় উঠে এসেছে৷

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বাল্যবিয়ের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে জলবায়ুর প্রভাব৷ অনেক এলাকার মানুষকে প্রতিনিয়তই বাড়িঘর ছাড়তে হচ্ছে৷ ফলে যে কোন বিপর্যয়ের আগে অভিভাবক মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন৷ কারণ তাদেরই গন্তব্যের ঠিক নেই, মেয়ে সঙ্গে রাখাকে তারা বাড়তি ঝামেলা মনে করছেন৷ পাশাপাশি করোনা পরবর্তী সময়ে আর্থিক সমস্যাও একটা কারণ৷ সামাজিক নিরাপত্তার কারণে অনেক অভিভাবক মেয়েকে নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন৷ সবকিছু মিলিয়েই বাল্যবিয়ে কমানো যাচ্ছে না৷”

বাল্যবিয়েতে এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষে

বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি-২০২৩ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাল্যবিবাহের হারের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম এবং এশিয়ায় প্রথম৷ বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ে বা বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ৷ জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করার দ্বারপ্রান্তে চলে আসা মেয়েরা সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে৷ ১৬-১৭ বছর বয়সি মেয়েদের বিয়ের হার ৬৩ শতাংশের বেশি৷ স্কুল থেকে ঝরে পড়া মেয়েদের চেয়ে পড়াশোনায় থাকা অবস্থায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হয়েছে৷ এ হার ৫৬ শতাংশ৷ বাকি ৪৪ শতাংশ বাল্যবিবাহ হওয়া মেয়েদের কেউ ছয় মাস, কেউ এক থেকে সাত বছরের বেশি সময় স্কুলে পড়েছে, আবার কেউ কখনোই স্কুলে যায়নি৷

এত উদ্যোগের পরও কেন থামানো যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে? জানতে চাইলে ফাউন্ডেশন ফর ল’ এন্ড ডেভেলপমেন্টের চেয়ারপার্সন সিনিয়র আইনজীবী ফৌজিয়া ফিরোজ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “সামাজিক একটা চাপ তো থাকেই৷ আর এখন দেখছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ হয়ে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশে এই ধরনের সংকট এখন অনেক বেড়ে গেছে৷ এখন তো সামাজিক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব অনেক বেড়ে গেছে৷ একজন রাজনৈতিক কর্মী নিজেকে সবার উপরে মনে করে৷ ফলে সে যা খুশি তাই করতে পারে৷ আবার দেখেন ফ্রি এডুকেশনের কথা আমরা বলছি৷ আসলে কি ফ্রি? অনেক কিছুই কিনতে হচ্ছে৷ সরকারের দেওয়া বইও কোথাও কোথাও কিনতে হয়৷ এই খরচটা অনেক অভিভাবক সামলাতে পারছেন না৷ আবার মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতার কারণে অনেক ছেলে-মেয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ অনেক সময় বিয়ে ছাড়া সমাধান হয় না৷”

সবচেয়ে বেশি রাজশাহীতে

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন অনুযায়ী, নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮৷ এ বয়সের আগে বিয়ের ঘটনাকে মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন বিবেচনা করা হয়৷ কারণ, বাল্যবিয়ের কারণে অপরিণত বয়সে অনেক মেয়ে মা হন৷ এতে তার যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়, তেমনি শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার সুযোগও কমে যায়৷

স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্সকে বিবিএস-এর মৌলিক জরিপগুলোর অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ এতে জনমিতির ১৩৮টি সূচকের তথ্য-উপাত্ত রয়েছে৷ এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ২৭ সূচক এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ১৭টি সূচকের তথ্য-উপাত্ত রয়েছে সেখানে৷ সারাদেশের ২ হাজার ১২টি নমুনা এলাকার প্রায় ১৩ লাখ মানুষের কাছ থেকে জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে৷

বিবিএসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাল্যবিয়ের ঘটনার দিক থেকে সারাদেশের মধ্যে রাজশাহী বিভাগের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক৷ এ বিভাগে বাল্যবিয়ের ঘটনা সারাদেশের মোট বাল্যবিয়ের গড়ের দ্বিগুণ৷ ১৫ বছরের আগে বাল্যবিয়ের ঘটনা রাজশাহীতে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ৷ দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা খুলনা বিভাগের এ হার ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ৷

বাল্যবিয়ের ঘটনা কমে আসার দিক থেকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে সিলেট বিভাগ৷ এ বিভাগে এ ধরনের ঘটনা এক দশমিক ০৪ শতাংশ৷ অন্যদিকে, ১৫ বছরের বেশি কিন্তু ১৮ বছরের কম বয়সসীমার বাল্যবিয়ের ঘটনাও রাজশাহী বিভাগেই বেশি৷ রাজশাহীতে এ বয়সসীমার মেয়েদের বিয়ের ঘটনা ৫২ দশমিক ২১ শতাংশ৷ এ হারের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বরিশাল৷ সেখানে এ বয়সি মেয়েদের বিয়ের হার ৪৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ৷ এ ক্ষেত্রেও সারাদেশের মধ্যে সিলেটের অবস্থান ভালো৷ সিলেটে এ ধরনের বিয়ের ঘটনা মাত্র ১৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ৷

‘আইন দিয়ে বন্ধ করা যাবে না’

বিবিএস বলছে, দেশের সম্পদশালী পরিবারের মধ্যেও বাল্যবিয়ের প্রবণতা বাড়ছে৷ এ শ্রেণির ১৫ বছরের কম বয়সি মেয়েদের বিয়ের গড় হার দুই দশমিক ৯০ শতাংশ৷ ১৫ বছরের বেশি ১৮ বছরের কম বয়সসীমার মেয়েদের বিয়ের হার ২৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ৷ তবে অতিদরিদ্র্য পরিবারে বাল্যবিয়ের ঘটনা তুলনায় বেশি৷ অতিদরিদ্র পরিবারে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের গড় হার ৮ দশমিক ০১ শতাংশ৷ অন্যদিকে, ১৮ বছরের মধ্যে থাকা বয়সিদের অতিদরিদ্র পরিবারে এই হার ৪৯ দশমিক ৪২ শতাংশ৷

জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে এম নুরুন্নবী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “বাল্যবিয়ে বাড়ার আকস্মিক এ প্রবণতা কোনোভাবেই কাম্য নয়৷ বাল্যবিয়ের ঘটনা আর্থসামাজিক অনেক সমস্যা তৈরি করে৷ এ ধরনের প্রবণতায় দেশ পিছিয়ে পড়ে৷ ১৮ বছর বয়সের আগে কোনো মেয়ের প্রজনন স্বাস্থ্য পরিপুষ্ট হয় না৷ এ কারণে আইন করে বিয়ের ন্যূনতম বয়সসীমা ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে৷ অপরিণত বয়সে বিয়ের পর একটি মেয়েকে সামাজিকভাবে অনেক পরিণত দায়িত্ব নিতে হয়৷ বিয়ের এক বছরের মাথায় সন্তান জন্ম দিয়ে তাকে প্রমাণ দিতে হয়, সে বন্ধ্যা নয়৷ এতে মেয়েটার জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে৷ মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর অন্যতম বড় কারণও বাল্যবিয়ে৷ সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে বাল্যবিয়ের ঘটনা বাড়ছে৷ শুধু আইন দিয়ে এ ধরনের প্রবণতা রোধ করা যাবে না৷”

মহিলা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমাদের এসডিজির প্রধান অন্তরায় বাল্যবিবাহ৷ বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য সরকার বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে, যেন বাল্যবিবাহটা না হয়৷ যে ঘরে কিশোরী মেয়ে আছে, আমরা সেই কিশোরীর মাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি, তাকে চাল দেওয়া হয় এই শর্তে যে, তাদের খাদ্যের নিরাপত্তা আছে, মেয়েটারও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে৷ আমাদের কিশোর কিশোরী ক্লাব আছে, এছাড়া আরো নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে৷ তারপরও কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে৷

 

সূত্র: ডয়চে ভেলে

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button