গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দল কে হচ্ছে তা নিয়ে চলছে আলোচনা৷ দু-একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এ নিয়ে কথা বললেও আইন কী বলে? বাকী প্রার্থীরাই বা কী বলছেন?
দুই-একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য বিচ্ছিন্নভাবে এই বিষয়ে কথা বলছেন৷ কিন্তু এটা নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি৷ হয়নি কোনো বৈঠক৷ সরকারের সঙ্গেও তারা এ নিয়ে কোনো যোগাযোগ করেননি বলে জানা গেছে৷
এদিকে, নিজেদেরকে বিরোধী দল বলে দাবি করছে জাতীয় পার্টি৷ যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সংসদের স্পিকারের মতামতের অপেক্ষায় তারা৷
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘আমরাই বিরোধী দল৷ বাকিটা এখন স্পিকারের এখতিয়ার৷’’
৩০ জানুয়ারি বসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন৷
বিরোধী দল নিয়ে আলোচনায় দুই স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য
মূলত দুইজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন৷ তাদের কথাই ঘুরে ফিরে আলোচনায় আছে৷
ফরিদপুর-৩ আসন থেকে বিজয়ী স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য একে আজাদ নির্বাচিত হওয়ার পর সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘যেহেতু জাতীয় পার্টি মাত্র ১১টি সিট পেয়েছে আর স্বতন্ত্র পেয়েছে ৬২টি, যদি নেত্রী (শেখ হাসিনা) মনে করেন, আমাদের বিরোধী দল গঠন করা উচিত৷’’
আর ফরিদপুর ৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘‘এখনো বিরোধী দল গঠন হয়নি৷ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব৷ আমরা অবশ্যই জোট গঠন করব৷’’
নিক্সন চৌধুরী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং এ কে আজাদ ফরিপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা৷ ওই দুজনের সঙ্গে সংবাদ মাধ্যমের পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করেও রোববার তাদের পাওয়া যায়নি৷
এবারের সংসদে মোট স্বতন্ত্র সদস্য ৬২ জন৷ এর মধ্যে তিন জন সদস্য ছাড়া বাকি সবাই আওয়ামী লীগের৷ আওয়ামী লীগের ৫৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র দুই জনের দলীয় পদ নেই৷ বাকি সবাই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে রয়েছেন৷
জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতার কারণে গাইবান্ধা-১ আসনের নৌকার প্রার্থী আফরোজা বারী প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় তার মেয়ে আবদুল্লাহ নাহিদ নিগার স্বতন্ত্র প্রার্থী হন৷ আফরোজা বারী সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি৷ নাহিদ নিগারের দলীয় পদ নেই৷
পিরোজপুর-৩ আসনে জয়ী শামীম শাহনেওয়াজেরও আওয়ামী লীগে পদ নেই৷ তার ভাই মঠবাড়িয়া উপজেলার সাধারণ সম্পাদক আশরাফুর রহমান মনোনয়ন পেয়েছিলেন৷ জাতীয় পার্টিকে আসন ছাড়ায় নৌকা হারান৷ শামীম শাহনেওয়াজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এমপি হয়েছেন৷
আওয়ামী লীগের বাইরে তিন স্বতন্ত্র হলেন হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সৈয়দ এ কে এম একরামুজ্জামান সুখন৷ তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ছিলেন৷ নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তাকে বহিস্কার করা হয়৷
কে সরকারি কে বিরোধী?
সিলেট-৫ আসনের মাওলানা মোহাম্মদ হুছামুদ্দিন চৌধুরী ফুলতলি৷ তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন৷ আর লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত৷ তিনি টাঙ্গাইল-৪ আসনে বিজয়ী হয়েছেন৷
যা বলছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্ররা
নওগাঁ-৬ থেকে বিজয়ী স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে জয়ী অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ বিষয়ক সম্পাদক৷ সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘‘আমাকে নেত্রী নৌকা প্রতীক দিতে পারেননি৷ কিন্তু তিনি তো আমাকে নির্বাচনে দাঁড়ানোর অনুমতি দিয়েছেন৷ আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক৷ শেখ হাসিনা আমার নেতা৷ তাকে সহযোগিতা করাই আমার কাজ৷ সরকারি দল বা বিরোধী দল ওসব কিছু না৷ নেত্রী যা বলবেন আমি তাই করব৷ আর এর পরেরবার আমি তো নৌকা প্রতীক পাবো নিশ্চিত৷’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি তো আওয়ামী লীগের পদ ছাড়ব না৷ তাহলে বিরোধী দল হবো কীভাবে!’’
পিরোজপুর-৩ আসনের শামীম শাহনেওয়াজেরও কথার সুর একই৷ তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘আমরা ৬২ জন প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের৷ তারপরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দেন ওটার দিকে আমরা তাকিয়ে আছি৷ দেখা যাক৷ আমরা আবার নিজেদের মতোও থাকতে পারি৷ প্রধানমন্ত্রী কী সিদ্ধান্ত দেন দেখি৷’’
তিনি জানান, ‘‘আমরা যারা স্বতন্ত্র নির্বাাচত হয়েছি তারা এখনো একসঙ্গে বসতে পারিনি৷ নিজেরা কথা বলতে পারিনি৷ বসার কোনো তারিখ এখনো ঠিক হয়নি৷’’
বরগুনা-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু৷ তার কথা, ‘‘আমি বিরোধী দলে যাবো কীভাবে? আমি তো একটা দল করি৷ আমি তো জেলা আওয়ামী লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারি৷ আমি আওয়ামী লীগেই আছি৷ আমি স্বতন্ত্রই থাকব৷’’
তিনি সংবাদ মাধ্যমকে আরো বলেন, ‘‘স্বতন্ত্র হলেও আমি আওয়ামী লীগেরই এমপি৷ এলাকার মানুষের কাছে আমার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি আছে৷ সেগুলো বাস্তবায়ন করব৷’’
‘‘আর স্বতন্ত্ররা বিরোধী দল হবে এটা নিয়ে আমার সঙ্গে কোনো পর্যায় থেকে কেউ কথা বলেননি,’’ জানান তিনি
স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগের যারা জয়ী হয়েছেন তারা মনে করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হলেও তারা আওয়ামী লীগ নেতা৷ তাই তারা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের মতই ক্ষমতা এবং সুযোগ সুবিধা পাবেন৷ এলাকার উন্নয়নেও তারা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের মতই ভূমিকা রাখতে পারবেন৷ এলাকায় প্রভাব প্রতিপত্তি সবই থাকবে৷ দলের নেতা-কর্মীরাও তাদের সঙ্গে থাকবেন৷ আর পরের সংসদ নির্বাচনে তারা সহজেই নৌকা প্রতীক পাবেন৷ বিরোধী দলে গেলে এসব হবে না৷ আর বিরোধী দলে গেলে যদি দলীয় পদ ছাড়তে হয় তাহলে এলাকায় তারা নেতৃত্ব হারাবেন৷ সেটা তারা চান না৷
জাতীয় পার্টি যা বলছে
এবার জাতীয় পার্টি ১১ আসন পেলেও দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘আমরাই তো বিরোধী দল৷ তারা যারা স্বতন্ত্র সবাই আওয়ামী লীগের৷ এখন সংসদে যারা বিরোধী তাদের মধ্যে যে দল বা অধিসঙ্গকে স্পিকারের কাছে বড় মনে হবে তাদেরকে তিনি স্বীকৃতি দিতে পারেন বিরোধী দল হিসেবে৷ স্বতন্ত্রদের বিরোধী দল হতে হলে তাদের জোট বা দল গঠন করতে হবে৷ কিন্তু তারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে আছেন৷ ওই পদ ছেড়ে তারা নতুন দল বা জোট গঠন করতে পারবে বলে আমার কাছে মনে হয় না৷’’
তার কথা, ‘‘তারপরও তারা যদি বিরোধী দলের স্বীকৃতি পায় তাহলেও প্রকৃত বিরোধী দল থাকব আমরাই৷ আমরা হয়তো বিরোধী দলের সুযোগ সুবিধা পাব না৷’’
তিনি জানান, সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর আগেই বিরোধী দল কারা তার সিদ্ধান্ত হয়৷
আইন কী বলে?
সংসদে বিরোধী দল কিংবা বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট কিছু বলা নেই৷ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা স্পিকারের৷ সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ২(১) (ট) ধারায় বলা হয়েছে, বিরোধীদলীয় নেতা অর্থ হল, ‘‘স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমতে দল বা অধিসঙ্গের নেতা৷’’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘স্বতন্ত্রদের বিরোধী দল হতে সংবিধান বা আইনে কোনো বাধা নেই৷ তাদের দেখাতে হবে তাদের যে দল বা অধিসঙ্গ তা এখন যে বিরোধী দল আছে (জাতীয় পার্টি) তাদের ১১ জনের চেয়ে স্বতন্ত্রদের সংখ্যা বেশি৷’’
‘‘তবে কার্যপ্রণালী বিধিতে শর্ত আছে৷ বিরোধী দলীয় নেতাকে তার দল নিয়ে সরকারের বিরোধিতা করতে হবে৷ এখন কেউ যদি বলে সে সরকারি দলের কমিটিতে থেকে সরকারি দলের বিরোধিতা করবে এটা তো কন্ট্রাডিকটরি হয়৷ তারা দলীয় পদ বহাল রেখে সম্ভবত বিরোধী দল হতে পারবেনা,’’ বলেন এই আইনজীবী৷
তবে তিনি একটি ক্ষীণ সম্ভাবনার কথা বলেন৷ তিনি মনে করেন, ‘‘যদি স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা দলীয় পদ স্থগিত করে বিরোধী দল হন তাহলে হয়তো হতে পারে৷ তবে আমার মনে হয় প্রাকটিক্যালি এটা হওয়ার সম্ভাবনা কম৷’’
এদিকে, বিষয়টি যেহেতু স্পিকারের এখতিয়ারে, তাই এটা নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারনী জায়গা থেকে প্রকাশ্যে কিছু বলা হচ্ছে না৷ তবে একজন আওয়ামী লীগ নেতা সংবাদ মাধ্যমকে জানান, স্বতন্ত্ররা এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এখনো যোগাযোগ করেননি৷
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী ১৬ স্বতন্ত্র এমপি হাজী সেলিমের নেতৃত্বে জোট করেছিল৷ তারা আওয়ামী লীগের পদে থাকলেও দলটির সংসদীয় দলে যোগ দিতে পারেননি৷
সূত্র: ডয়চে ভেলে