গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ‘নির্বাচন’। আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিক ভোট প্রদানের মাধ্যমে বেছে নেন পছন্দের নেতৃত্ব। কিন্তু নির্বাচন ব্যবস্থার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। নির্বাচন কেন, কীভাবে এলো, কোথায় এর সূচনা- এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত…
৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’- নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রচারিত এ স্লোগান মুখে মুখে ফেরে। নিজ নিজ এলাকার জনপ্রতিনিধি তথা দেশ পরিচালনার প্রধান মানুষ ও দলকে বেছে নিতে নির্বাচনের ভূমিকা অপরিসীম। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভোট হচ্ছে ব্যক্তিমানুষের মতপ্রকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। নির্বাচনের এ মৌসুমে ঘুরে আসা যাক অতীত থেকে। কীভাবে নির্বাচনব্যবস্থার যাত্রা হলো জেনে নেওয়া যাক।
প্রাচীন যুগে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করার পর দেখা দেয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা। আর সংগঠনকেন্দ্রিক জীবনযাপন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট থেকে সৃষ্টি হয়েছে নেতা নির্বাচনের ধারণা। এভাবে যদি ভাবা যায়, তাহলে বলতে হয় ‘নির্বাচন’ একটি সুপ্রাচীন প্রক্রিয়া। মানবসভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচনব্যবস্থার রীতিনীতিও ছিল ভিন্ন। নেতা নির্বাচনে বিভিন্ন পন্থা আবিষ্কার হলেও নির্বাচনের ধারণায় ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে সপ্তদশ শতক থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বে নির্বাচন বা ভোট অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। শুধু রাষ্ট্রই নয়, কোনো দেশের অঞ্চলসহ বিভিন্ন সংস্থায়ও এখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত করা হয় প্রতিনিধি।
ইতিহাস বলছে, শাসনকাঠামো পরিচালনায় গ্রিকরাই সর্বপ্রথম নির্বাচনব্যবস্থার প্রচলন করে। লটারির মাধ্যমে তারা তাদের শাসক বেছে নিত। আরও একটু সামনে এগিয়ে দেখতে পাই, প্রাচীন রোমেও নির্বাচনের ব্যবহার ছিল। সমগ্র মধ্যযুগে রোমান সম্রাট ও পোপ বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও নির্বাচনের ব্যবহার দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি আদিবাসী গোত্রের মধ্যেও নেতা নির্বাচনের প্রথা প্রচলিত ছিল বলে তথ্য পাওয়া যায়। তারা পাত্রে শস্যকণা নিক্ষেপের মাধ্যমে নেতা বাছাই করত। সুদূর অতীতে শাসনপ্রক্রিয়ায় প্রচলিত ছিল পরিবারতন্ত্র বা উত্তরাধিকার নীতি। এর বিপরীতে নির্বাচনব্যবস্থার পরিচিতি বা জনপ্রিয়তায় সময় লাগলেও বর্তমানে এ প্রক্রিয়াতেই চলছে গোটা বিশ্ব।
খ্রিস্টের জন্মের ৭৫৪ বছর আগে প্রাচীন গ্রিসের স্পার্টার মিশ্র সরকারের অধীনে ইফোর্স তথা রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে নীতিনির্ধারণী বোর্ডের পাঁচ সদস্য বাছাইয়ে জনগণের সম্পৃক্ততায় নির্বাচনের নজির পাওয়া যায়।
প্রাচীন ভারতেও ছিল নির্বাচন
ভারতীয় সমাজে বৈদিক যুগে নির্বাচনের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। বৈদিক যুগে ভারতের ‘গণ’ নামক সংগঠন রাজা নির্বাচন করত। যদিও রাজা সব সময় ক্ষত্রিয়দের মধ্য থেকেই হতো। তবু রাজা নির্বাচনে গণদের কথাই ছিল শেষ। এ ছাড়া বংশীয় ধারা রক্ষার প্রচলিত নিয়ম ভেঙে প্রাচীন ভারতে কখনও কখনও স্থানীয় প্রধান নির্বাচিত হতো।
মধ্যযুগে এক শতাব্দী ধরে চলা ‘মাৎস্যন্যায়’ অবসানের জন্য বাংলার সামন্তপ্রধানরা গোপাল নামে এক জনপ্রিয় সামন্ত নেতাকে বাংলার রাজপদে নির্বাচিত করেন। দশম শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতের চোল সাম্রাজ্যের উঠিরামেরু তথা বর্তমান তামিলনাড়ুতে পামগাছের পাতায় ভোটদানের মাধ্যমে গ্রাম পরিষদের সদস্য নির্বাচন করা হতো। মাটির তৈরি একটি পাত্রে প্রার্থীদের নাম লেখা পামপাতাগুলো রাখা হতো। কুডাভোলা নামক এ ব্যবস্থায় একজন বালককে গ্রাম পরিষদের যতজন সদস্য ততটি পাতা তুলতে বলার মধ্য দিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করা হতো। এ ব্যবস্থাকে বলা হতো কুডাভোলা। ভারতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পর উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালিত হলেও স্থানীয় শাসকের বিভিন্ন প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ছিল জনগণের।
আধুনিক বিশ্বে নির্বাচন
আধুনিক বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনব্যবস্থার যাত্রা হয় ত্রয়োদশ শতকে ইংল্যান্ডে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। এরপর ১৬৯৪ সালে ট্রিনিয়্যাল অ্যাক্ট ও ১৭১৬ সালের সেপ্টেনিয়্যাল অ্যাক্টের মাধ্যমে এ ব্যবস্থার স্থায়ী রূপ দেওয়া হয়। ১৮৭২ সালে গোপনে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট প্রদানের পদ্ধতি প্রণীত হয়। ১৯২৮ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকার নীতি গ্রহণ করা হয়।
নারীর ভোটাধিকার
গোপন ব্যালট পদ্ধতির নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলনের পর পুরুষই একমাত্র ভোট প্রদানের অধিকার রাখত। ১৮৯৩ সালে সর্বপ্রথম নারীর ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করে নিউজিল্যান্ড। এরপর ১৯১৭ সালে রাশিয়া, ১৯১৮ সালে ইংল্যান্ড ও জার্মানি, ১৯২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ১৯৪৪ সালে ফ্রান্স নারী ভোটাধিকার নিশ্চিত করে। এরপর ক্রমান্বয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশে নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত হলেও এ তালিকায় নাম লেখায়নি রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান কেন্দ্র ভ্যাটিকান সিটি। দেশটিতে নারীর ভোট দেওয়া নিষিদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোয় নারীর ভোটাধিকার ছিল না। পর্যায়ক্রমে ওমানে ১৯৯৭ সালে, কাতারে ১৯৯৯ সালে, বাহরাইনে ২০০২ সালে নারীর ভোটাধিকার দান করা হয়। সবশেষে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরবের নারীরা প্রথমবারের মতো পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান।
বাংলায় যেভাবে এলো নির্বাচন
উনিশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে বাংলায় স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত এ অঞ্চলে পঞ্চায়েতব্যবস্থার প্রচলন ছিল। পঞ্চায়েতরা মূলত গ্রামসরকারের কাজ করতেন। সাধারণ মানুষ এসব পঞ্চায়েত নির্বাচন করত। ঔপনিবেশিক শাসকরা গ্রামপ্রধান, পঞ্চায়েত, পাটোয়ারি, আমিন, মুনসেফ, থানাদার ও কাজির পদসমূহ বিলুপ্তির মাধ্যমে প্রাচীন নির্বাচনব্যবস্থার মূলোৎপাটন করে।
১৮৬৮ সালে পৌর আইন (৬ নম্বর আইন) প্রণয়নের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক-তৃতীয়াংশ মনোনীত সদস্যের সমন্বয়ে পাশ্চাত্য ধরনের পৌর কমিটি গঠনের বিধান প্রবর্তন করা হয়। শুধু পৌর করদাতাদেরই সদস্য নির্বাচিত করার অধিকার ছিল। ১৮৮৪ সালে প্রবর্তিত ৩ নম্বর আইনবলে ঢাকাসহ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ পৌরসভাগুলো নির্বাচনব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। পৌর ও গ্রাম এলাকায় এ সীমিত নির্বাচনব্যবস্থার মাধ্যমেই গ্রামপর্যায়ে ভোটাধিকার সম্প্রসারণের নতুন পর্বের সূচনা হয়। ১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় আইনসভায় নির্বাচনের বিধান প্রবর্তন করা হয়। ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ভোটাধিকার ও নির্বাচন সংস্থাকে সম্প্রসারিত করা হয়। ১৯০৯ সালে সম্প্রদায় ও পেশার ভিত্তিতে নির্বাচন শুরু হয়। ১৯২০ সাল থেকে অনিয়মিতভাবে হলেও পৃথক নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন তখনও সর্বজনীন না হলেও সেখানে ব্যাপকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক আইন পরিষদে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথক নির্বাচনব্যবস্থার ভিত্তিতে এটাই ছিল সর্বশেষ নির্বাচন।
ভোট ও ভোটাধিকার
নির্বাচনের ইতিহাসের অনেকটা জুড়েই রয়েছে ভোটাধিকারের প্রশ্নগুলো, বিশেষ করে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ভোটাধিকার। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সংস্কৃতিতে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছিল পুরুষরাই, নির্বাচকমণ্ডলীতেও এদেরই প্রাধান্য থাকত, অন্য বহু দেশেও একই ধারা চলে আসছিল। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেও শুরুর দিকের নির্বাচনগুলোয় জমিদার অথবা শাসক শ্রেণির পুরুষদের প্রাধান্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গরা ভোটাধিকার পায় দেশটির গৃহযুদ্ধের পর ১৮৬০ সালে ক্রীতদাস প্রথা সীমিত করার মধ্য দিযে। যদিও সম্পূর্ণভাবে তারা ভোটাধিকার লাভ করে ১৯৬০ সালে ‘ভোটিং রাইট অ্যাক্ট’ পাসের পর। ১৯২০ সাল পর্যন্ত অবশ্য পশ্চিম ইউরোপের সব দেশ এবং উত্তর আমেরিকার গণতন্ত্রে সর্বজনীনভাবেই পুরুষ ভোটাধিকার চালু ছিল এবং তার পরই বহু দেশ মহিলাদের ভোটাধিকার দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করে। পুরুষের সর্বজনীন ভোটাধিকারের কথা আইনগতভাবে সিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অনেক সময়ই অবাধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বাধা অন্তরায় সৃষ্টি করত; যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ ও সমাজে গড়ে ওঠে নাগরিক অধিকার আন্দোলন।
সূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ