আলোচিত

তফসিল মঙ্গলবার, নির্বাচন ৩ জানুয়ারি

গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের ৩ জানুয়ারি, বুধবার অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। তার আগে আগামী মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) ঘোষণা করা হতে পারে তফসিল। সেই লক্ষ্যে ওইদিন সন্ধ্যায় টেলিভিশন ও বেতারে জাতির উদ্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভাষণ প্রচারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

রেওয়াজ অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের প্রস্তুতি তুলে ধরবে নির্বাচন কমিশন। পাশাপাশি সার্বিক বিষয়ে রাষ্ট্রপতির পরামর্শও চাওয়া হবে। রাষ্ট্রপ্রধানের দিক থেকে নতুন কোনো নির্দেশনা না থাকলে নিজেদের ঠিক করা সূচি অনুযায়ী অগ্রসর হবে ইসি। বঙ্গভবনে বৈঠকের পর কমিশন সভা করে আনুষ্ঠানিকভাবে তফসিল অনুমোদন করা হবে। আপাতত আগামী মঙ্গলবার তফসিল ঘোষণার চিন্তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা দু-এক দিন পেছাতে পারে বলে জানা গেছে।

বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে সরকারবিরোধী বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল ও জোটের বিপরীতমুখী এমন অবস্থানের মধ্যেই নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। এখন শুধু তফসিল ঘোষণা এবং সে অনুযায়ী সব কাজ সম্পন্ন করার অপেক্ষা।

নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে ইসি বদ্ধপরিকর। নির্বাচনের সব প্রস্তুতি এরই মধ্যে গুছিয়ে আনা হয়েছে। নির্বাচনী সরঞ্জামও ধাপে ধাপে জেলাগুলোয় পাঠানো হচ্ছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরিবেশও রয়েছে। আগামী সপ্তাহেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হবে।’

তিনি বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। রেওয়াজ অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার আগে কমিশন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার সাক্ষাতের সূচি রয়েছে। সিইসি ও অন্য কমিশনাররা রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচনের প্রস্তুতি সংক্রান্ত সব রকম অগ্রগতি অবহিত করবেন। এসব বিষয়ে রাষ্ট্রপতির দিক থেকে কোনো পরামর্শ বা নির্দেশনা থাকলে কমিশন তা গ্রহণ করবে।’

ইসির একাধিক সূত্র জানায়, আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্য নিয়ে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। তখন থেকে ভোটের দিন হিসেবে ৪ জানুয়ারিকে সামনে রেখেই সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। আর তপশিল ঘোষণার কথা ছিল নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেই লক্ষ্যেই অটল ছিল কমিশন। তবে গত অক্টোবর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা বদলে যাওয়ায় কমিশনকেও নতুন করে ভাবতে হয়েছে। নানা দিক বিবেচনায় তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নেওয়া হয়েছে। তবে ভোট গ্রহণের তারিখ এক দিন এগিয়ে আনার পেছনে বিবেচনায় এসেছে ভিন্ন বিষয়। ৪ জানুয়ারি একটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ কারণে ওই দিন ভোট গ্রহণ না করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে কমিশন। সেক্ষেত্রে ভোট পরবর্তী নানা আনুষ্ঠানিকতা ও সম্ভাব্য আইনি প্রক্রিয়া বিবেচনায় সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ কারণে পূর্বনির্ধারিত তারিখের এক দিন আগে ৩ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সংবাদ মাধ্যমকে বলছেন, প্রথা অনুযায়ী ভোট গ্রহণের আগে ৪০ থেকে ৪৫ দিন সময় রেখে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এ ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্র জমা, বাছাই, প্রত্যাহার এবং প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারের জন্য যৌক্তিক সময় রাখতে হয়। প্রচারের জন্য সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহ, মনোনয়নপত্র জমায় ১০ থেকে ১৫ দিন, বাছাইয়ের জন্য চার দিন, আপিল নিষ্পত্তি করতে চার থেকে সাত দিন এবং মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের জন্য সাত দিনের মতো সময় দেওয়া হয়।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এর আগে ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর মনোনয়নপত্র জমা থেকে ভোটের তারিখ পর্যন্ত সর্বনিম্ন ৪২ দিন এবং সর্বোচ্চ ৭৮ দিন সময় রেখে তফসিল ঘোষণার নজির রয়েছে। এবার নির্বাচনের আগে ৪৯ দিনের মতো সময় রেখে তফসিল ঘোষণা করা হচ্ছে।

ইসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। ১ নভেম্বর থেকে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনাও শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার জন্য ইসির হাতে খুব বেশি সময় বাকি নেই। এ অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে এখনো কোনো ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনা দেখা না গেলেও শেষ পর্যন্ত সংবিধানে দেখানো পথেই হাঁটবে আউয়াল কমিশন। সেক্ষেত্রে কোনো দল নির্বাচনে না এলেও তাদের কোনো কিছু করার থাকবে না।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালসহ অন্য কমিশনাররা এরই মধ্যে তাদের সাংবিধানিক দায়িত্বের কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। সর্বশেষ শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বর্তমান পরিস্থিতি নির্বাচনের সম্পূর্ণ অনুকূল না হলেও কিছু করার নেই বলে মন্তব্য করেন সিইসি নিজেই। চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের সামর্থ্য ও ম্যান্ডেট কোনোটাই কমিশনের নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘দলগুলোকেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সংকটের সমাধান করে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’

সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের পরিস্থিতি সব সময় শতভাগ অনুকূলে থাকে না। তবুও সাংবিধানিক দায়িত্ব ও শপথের কারণে নির্বাচন কমিশনকে ভোট আয়োজন করতে হবে।’

এর আগে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের জানুয়ারির ২৯ তারিখের মধ্যে যেভাবেই হোক না কেন নির্বাচন হতে হবে। কারণ তা না হলে একটি সাংবিধানিক গ্যাপ (শূন্যতা) তৈরি হবে। সেই গ্যাপ তৈরি হলে দেশে একটা অরাজকতা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। সেটি তো নির্বাচন কমিশন হতে দিতে পারে না।’ ইসি ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী, ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে ইতিমধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আইনি কাঠামোতে বেশ কিছু সংস্কার করা হয়েছে। সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাসের কাজ শেষ হয়েছে। নতুন দলের নিবন্ধনের কাজও শেষ হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এতে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ১০৩টি। আর ভোটকক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৬১ হাজার ৯১৪টিতে দাঁড়িয়েছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। ভোট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ আরও কিছু কাজ চলমান। তপশিল ঘোষণার পর ভোটকেন্দ্রের চূড়ান্ত তালিকা, আসনওয়ারি ভোটার তালিকার সিডি প্রস্তুত ও ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ঠিক করার কাজ চলছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পর্যবেক্ষক নিবন্ধন প্রাথমিক ধাপ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও কিছু পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। চূড়ান্ত হয়েছে বিদেশি পর্যবেক্ষক নীতিমালাও। সংবাদ সংগ্রহে মোটরসাইকেলের অনুমতি দিয়ে সাংবাদিক নীতিমালাও সংশোধন করা হয়েছে।

ইসি সূত্র জানায়, এবার নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন ৯ লাখের বেশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা। নির্বাচনী সরঞ্জাম কেনাকাটা, নির্বাচনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের ভাতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভাতা মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা খরচ হবে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে। এর বাইরে নির্বাচনী প্রশিক্ষণে খরচ হবে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি।

সূত্র জানায়, গত একাদশ সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন মোট ৬ লাখ ৮ হাজার সদস্য। নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে ভোটকেন্দ্রে থাকেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। ভোটকেন্দ্রের বাইরে থাকে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ডের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স। তবে এবার সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হবে কি না—এখনো সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।

প্রার্থীদের মনোয়নপত্র দাখিলে যে কোনো জটিলতা এড়াতে এবারের নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। সেইসঙ্গে ই-ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনলাইনে জামানতের টাকাও পরিশোধের সুযোগও থাকছে। অন্যদিকে ভোট কেন্দ্রের নাম ও ভোটার নম্বর খুঁজে পাওয়ার ভোগান্তি কমাতে ‘বাংলাদেশ ইলেকশন অ্যাপ’ নামে একটি অ্যাপ তৈরি করছে কমিশন। এই অ্যাপে ভোটারের তথ্যের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের জন্য রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার (এসপি) এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) নির্বাচনী কাজে নিয়োজিত গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের পরিচয় ও ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

 

সূত্র: কালবেলা

এরকম আরও খবর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button