গাজীপুর কণ্ঠ ডেস্ক : শরীরের শতকরা ৮০ ভাগ পোড়া অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসার পর গত ১০ই এপ্রিল মৃত্যু হয় ফেনীর আলোচিত মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহানের।
এর আগে মার্চের ২৭ তারিখে ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে এক মামলা করেছিল নিহত নুসরাতের পরিবার। সেদিনই অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এই ঘটনারই জের ধরে ৬ই এপ্রিল মাদ্রাসার ভেতরের পরীক্ষার হল থেকে ডেকে ছাদে নিয়ে গিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় কয়েকজন।
দেশজুড়ে আলোচিত এ ঘটনা তদন্তের পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই বলছে, পুরো ঘটনা উদঘাটন করেছেন তারা।
পিবিআই উপ-মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার মঙ্গলাবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলছেন, “মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজদ্দৌলা মূল আসামী। তিনি সহ মোট ১৬ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে ৭২২ পৃষ্ঠার চার্জশিট বুধবার আদালতে দেয়া হবে।”
তিনি বলেন, “নুসরাত হত্যার পুরো দায় ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজদ্দৌলার, যিনি নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলায় আগেই কারাগারে ছিলেন।”
“তার নির্দেশেই সব হয়েছে এবং ১৬ জন এ ঘটনায় জড়িত। এর মধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে ১২ জন আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে।”
নুসরাতের অবস্থার করুণ বর্ণনা
শরীরে আগুন লাগিয়ে দেয়ার পর নুসরাত জাহান উদ্ধারের আগ পর্যন্ত অবস্থার করুণ ও বীভৎস অবস্থা উঠে এসেছে পিবিআইয়ের তদন্তে।
মিস্টার মজুমদার বলছেন, “ওইদিন পরীক্ষা ছিল, লোকজন সেভাবে ছিল না। মেইন গেটে দারোয়ান ও পুলিশ ছিলো। যে সাইক্লোন সেন্টারের ঘটনা তার গেইট আবার মাঠের মধ্যে উল্টো দিকে।”
অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় অনেকে নুসরাতকে চিৎকার করতে দেখেছে বলে পুলিশ জানায়।
পরে আয়া, বাংলা শিক্ষক, দারোয়ান ও পুলিশ কনস্টেবল সোহেল এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
“যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের তিন জন পরীক্ষার্থী ছিল ও তারা পরীক্ষা দিতে চলে গেছে। আমরা বুঝতেও পারিনি যে ঘটনা ঘটিয়ে তারা পরীক্ষা দিতে গেছে।”
তিনি বলেন, ১১ই এপ্রিল কাউন্সিলর মাকসুদ আলমকে গ্রেফতারের পর ১৩ তারিখেই তারা জানিয়েছিলেন যে এটি ছিল একটি খুন। ১৬ জনকেই বিভিন্ন দফায় রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বেশি তিন দফায় রিমান্ডে ছিল শাহাদত হোসেন শামীম।
মিস্টার মজুমদার বলেন, এ ঘটনায় পাঁচটি বোরকা ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর মধ্যে তিনটি উদ্ধার করা গেছে।
“আরও অনেক আলামত সংগ্রহ করেছি। এছাড়া আর কেমিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী দাহ্য পদার্থ ছিল কেরোসিন জাতীয় পদার্থ এবং সেটা কোথা থেকে কেনা হয়েছে সেটাও আমরা পেয়েছি।”
তিনি বলেন, “এই ১৬ জনের মধ্যে ১২ জন তার ভূমিকা ও সহযোগীদের ভূমিকা ছিল – তা বলে তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এর মধ্যে সিরাজদ্দৌলা ঘটনার সময় যিনি যৌন হয়রানির মামলায় জেলে ছিলেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি নুসরাত রাফির গায়ে হাত দিয়েছেন।”
“তিনি (অধ্যক্ষ) বলেছেন যে প্রথমে রাফিকে চাপ দিবা, না হলে খুন করবা। খুনের পদ্ধতিও বলে দিছেন যে আগুন দিয়ে খুন করবা এবং আত্মহত্যা বলে চালাবা।”
“এ নির্দেশের পর বাকী ১৫ জন সবাই তার ১৬৪ প্রমাণ করেছে। তিনি জেলখানায় যা বলেছেন তা স্বীকার করেছেন পুলিশ ও আদালতের কাছে।”
ছাদে নিয়ে নুসরাতকে চাপ দেয়া হয় একটি সাদা কাগজ দিয়ে বলা হয় – “এখানে স্বাক্ষর করো”।
পুলিশের বর্ণনায় যেভাবে নুসরাতকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়
পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে যে ৬ই এপ্রিল সকালে শাহাদত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদের মাদ্রাসায় আসেন এবং পরিকল্পনা মত যার যার অবস্থানে যায়।
শাহাদত হোসেন পলিথিনে করে আনা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে আনা গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়।
কামরুন্নাহার মনির কেনা দুটি ও বাড়ি থেকে আনা একটিসহ মোট তিনটি বোরকা ও চার জোড়া হাত মোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখে। শাহাদত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে নয়টার দিকে বোরকা ও হাত মোজা পরিধান করে সেখানে অবস্থান নেয়।
নুসরাত পরীক্ষা দিতে আসলে পরিকল্পনা মতো উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে তার বান্ধবীকে মারধরের কথা বলেন। নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে। দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে পপি নুসরাতকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায়।
নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে ছাদে উঠলে কামরুন্নাহার মনি, শাহাদত হোসেন শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পিছনে ছাদে যায়। সেখানে তারা নুসরাতকে একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বললে নুসরাত অস্বীকৃতি জানায়।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাহাদত হোসেন শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে ও পপিকে বলে নুসরাতের বোরকার মধ্য থেকে ওড়না নেয়ার জন্য।
পপি ওড়না নিয়ে জুবায়েরকে দেয়। জুবায়ের এক অংশ দিয়ে পা বাঁধে ও পপি হাত পেছনে বেঁধে ফেলে।
এরপর পপি, মনি ও শাহাদাত তাকে শুইয়ে ফেলে।
পরে তাকে মুখ চেপে ধরে গিট দেয়া হয়।
আর জাভেদ কালো পলিথিনে এক লিটার তেল ছিল। মাদ্রাসার গ্লাস দিয়ে কেরোসিন ঢালে নুসরাতের শরীরে।
শামীমের ইঙ্গিতে জুবায়ের তার কাছে থাকা ম্যাচ থেকে আগুন ধরিয়ে সবাই নির্দ্বিধায় বেরিয়ে যায়।
শামীম জবানবন্দীতে বলে নুসরাতের মুখ সে চেপে ধরায় মুখে কেরোসিন দেয়া যায়নি।
পপি ও জুবায়ের পা চেপে ধরায় কেরোসিন দেয়া যায়নি।
পুড়ে নুসরাতের হাত ও পা খোলার পরেই তার মাথায় এসেছে যে তার বাঁচতে হবে।
‘আত্মহত্যার প্রচারণার ফাঁদে অনেকে পা দিয়েছিল’
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, প্রতিটি লোকের প্রতিটি দায় এ ঘটনায় কী ছিল তারা সেটা বের করেছেন।
“এদের ফাঁদে বহুজন পা দিয়েছিল যে আত্মহত্যা বলে চালানোর। এটি অনেকেই বিশ্বাস করে ফেলেছিল।”
তিনি বলেন, “পরে যা বের হলো তাতে তারা যারা তদন্ত টিমে বা বাইরে ছিলাম তারা থ মেরে গেছেন – যে এমন ঘটনাও হতে পারে।”
নুসরাত আগুন দিয়ে অভিযুক্তরা সরে পড়লো কিভাবে
মিস্টার মজুমদার জানান, আগুন ধরানোর পর ৫ জন – দুটি মেয়ে শম্পা ও মনি- তারা সামনের থেকে বের হয়ে পরীক্ষার হলে বসে পরীক্ষায় বসে।
আরেকজন পরীক্ষার্থী জাবেদও পরীক্ষার হলে যায়।
শাহাদত হোসেন শামীমকে বোরকা দিয়ে যায়।
সে মূল গেট দিয়ে বের না হয়ে পেছন দিক দিয়ে বের হয়ে বাড়িঘরে ঢুকে যায়।
খুনিদের তিনজন পরীক্ষায় ও একজন বোরকা পুকুরে ফেলে বাড়িঘরে ঢুকে যায়।
আর জুবায়ের বোরকা পরে ঘুরে মেইন গেট দিয়ে বের হয়ে পাশে কৃষি ব্যাংকের সিঁড়িতে ওঠে বোরকা পলিথিনে নিয়ে বের হয়ে আসে।
“আমরা নিজেরাই হতবাক হয়ে গেছি এদের (জড়িতদের) মানসিক শক্তি দেখে।”।
‘৪টা গ্রুপ ঘটনা ঘটিয়েছে’
বনজ কুমার মজুমদার জানান, এখানে চারটা গ্রুপ ঘটনা ঘটিয়েছে- শিক্ষক, একজন নির্দেশ আরেকজন হত্যায় সহযোগিতা করেছে।
আরেক গ্রুপ মেইন গেট পাহারা দিয়েছে। আর দুজন সাইক্লোন সেন্টার গেইট পাহাড়া দিয়েছে।
আর চারদিক থেকে সহযোগিতা করেছে আর দুজন গভর্নিং বডির ভাইস প্রেসিডেন্ট রুহুল আমিন ও কমিটি মেম্বার কাউন্সিলর মাকসুদ আলম।
এদের একেক জনের এক একটি দায়িত্ব ছিল।
এটি “মিলিটারি প্ল্যান” এর মতো নিখুঁত, তারা ঘটনাটা ঘটিয়ে জনতার সাথে মিশে গেছে।
কেন তারা করেছে এটি?
এ হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে পিবিআই কর্মকর্তা বলেন, অনেকেই বলেছে এ ঘটনার কারণ হলো -“আলেমদের অপমান আর প্রেমের ব্যর্থতা”।
“কিন্তু তদন্তে আমরা সেটি পাইনি। আমরা যা পেয়েছি তা হলো ওই মাদ্রাসার সকলের স্বার্থে মেয়েটি ঘাঁ দিয়েছিলো।”
সূত্র: বিবিসি