ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে চার কারণে হামলা চালিয়েছে হামাস
গাজীপুর কণ্ঠ, আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গাজার জনগণের বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদার ইসরাইলের অব্যাহত আগ্রাসনের জবাবে হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেডের যোদ্ধারা ৭ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে দুঃসাহসিক অভিযান চালায় যেটাকে ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরাজয়ের ঘটনা হিসাবে দেখা হচ্ছে। এমনকি ইসরাইলের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, এটি ছিল তাদের জন্য ঐতিহাসিক অপমান। এরপর তারা গাজার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে এবং এতে হাজার হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনি শহীদ এবং আহত হয়েছে আরো অসংখ্য মানুষ।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে হামাস কেন ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে গেল?
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত ১২টি হাসপাতাল এবং ৩২টি চিকিৎসাকেন্দ্র পরিষেবা দিতে পারছে না এবং আমরা ইসরাইলের অব্যাহত আক্রমণ ও জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে আরও হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে চিন্তিত। ইসরাইলের এই ধ্বংসযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে এখন কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের ‘আল-আকসা তুফান’ অভিযান শুরুর মূল কারণগুলো কী ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে, নিম্নলিখিত কারণগুলো চিহ্নিত করেছেন বিশ্লেষকরা।
প্রথমত : ইসরাইলে হামাসের সামরিক অভিযানের প্রথম কারণ হচ্ছে, গাজার জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলের অব্যাহত আগ্রাসন ও জুলুম নির্যাতন। ২০০৭ সাল থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকার ওপর সর্বাত্মক অবরোধ দিয়ে রেখে গাজাকে বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করেছে এবং এই উপত্যকার মানুষগুলোকে গত ১৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এছাড়াও, ইসরাইলি সেনারা এ সময়ের মধ্যে ছয় হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে বন্দী করেছে, যার মধ্যে কয়েকশ মহিলা ও শিশু রয়েছে এবং এদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাত অবসানের জন্য যতই শান্তি পরিকল্পনার কথা বলা হোক না কেন, এসব উপেক্ষা করে ইসরাইল অবৈধ ইহুদিবসতী নির্মাণ কাজ অব্যাহত রেখেছে এবং ফিলিস্তিনিদের এলাকা দখল করে এদেশের জনগণকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া ২০০৮ সাল থেকে ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীর হাতে দেড় লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি শহীদ বা আহত হয়েছে। গত বছর এই পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। কারণ ইসরাইলের একটি চরমপন্থী ও উগ্র বর্ণবাদী গোষ্ঠী সরকার চালাচ্ছে, যারা শুধু যে দখলিকৃত এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করছে তাই নয় পশ্চিম তীর ও গাজা থেকেও ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করার চেষ্টা করছে। একইসাথে মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল-আকসা মসজিদের ইসলামি পরিচিতিও মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্থেনিও গুতেরেস এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এটা বুঝতে হবে যে হামাস বিনা কারণে হামলা চালায়নি’। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা ৫৬ বছর ধরে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আসছে’।
দ্বিতীয়ত : ইসরাইলে হামাসের সামরিক অভিযানের দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, ফিলিস্তিনের প্রতি জাতিসংঘ ও বৃহৎশক্তিগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা। প্রকৃতপক্ষে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাসের হামলার বিষয়টি বিশ্ব পরিচালনা ব্যবস্থার গঠনকাঠামোর দুর্বলতার সাথে সম্পর্কিত। কেননা, জাতিসংঘ এবং এই সংস্থায় বহৎশক্তিগুলো ফিলিস্তিনের জন্য শান্তি ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তারা দখলদার ইসরাইলের পক্ষে কাজ করছে। মার্কিন নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রমূলক ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ পরিকল্পনা উত্থাপন এবং ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা আসলে ইসরাইলের প্রতি বহৎশক্তিগুলোর একতরফা সমর্থনেরই প্রমাণ। মার্কিন সরকার এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং এখনো ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষার জন্য গাজার বিরুদ্ধে ইসরাইলের নৃশংস গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে জাতিসংঘ ও বৃহৎশক্তিগুলো যারা কিনা ফিলিস্তিনে শান্তির কথা বলে তাদের এমন ন্যক্কারজনক ভূমিকায় ফিলিস্তিনিরা হতাশ এবং বাধ্য হয়েই তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘আল-আকসা তুফান’ অভিযান চালিয়েছে।
তৃতীয়ত : ইসরাইলে হামাসের সামরিক অভিযানের তৃতীয় কারণ হচ্ছে, দখলদার এ শক্তির সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও মধ্যস্থতায় কিছু আরব দেশ বায়তুল মোকাদ্দাস দখলদার ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে ঝুঁকেছে। এ ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান। এমনকি গত মাসে ইসরাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল, খোদ সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বিষয়টি শিকার করেছেন।
ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের অর্থ হচ্ছে, আরববিশ্বে ফিলিস্তিনিদেরকে বিসর্জন দেয়া। অথচ একসময় ফিলিস্তিনিদের প্রতিরক্ষা শক্তির প্রতি সমর্থন দেয়াকে আরব বিশ্বের শাসকদের বৈধতার অন্যতম উৎস হিসাবে ধরা হতো। কিন্তু এখন আরববিশ্বে ফিলিস্তিনের অবস্থান গুরুত্বহীন হয়ে পড়ায় এ সুযোগে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি নির্মূল করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ কারণে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘আল-আকসা তুফান’ অভিযান চালাতে বাধ্য হয়েছে।
চতুর্থত : ইসরাইলে হামাসের সামরিক অভিযানের চতুর্থ কারণ হচ্ছে, ন্যূনতম শান্তি অর্জনে হতাশা সৃষ্টি। ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকামী দলগুলো বিশ্বাস করে যে, শান্তির কোনো সম্ভাবনা তো নেই বরং কথিত শান্তি প্রচেষ্টার একমাত্র লক্ষ্য কেবল ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করা। ইসরাইল এটা বুঝতে পেরেছে যে, আরব দেশগুলো, বৃহৎশক্তিগুলো এবং জাতিসংঘ কেউই ইসরাইলি জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলবে না। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাবলি তেলহামি বলেছেন, ‘দিগন্তের ওপারে কোনো ধরনের আশার আলো দেখতে না পেয়ে হামাস বাধ্য হয়ে ইসরাইলে হামলা চালিয়েছে। আমার মতে, একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা এক দশক আগের তুলনায় এখন অনেক কম। সেখানে ব্যাপক হতাশা তৈরি হওয়ায় এবং শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানের আর কোনো পথ না থাকায় সশস্ত্র প্রতিরোধের পথ বেছে নিয়েছে ফিলিস্তিনিরা।’
এইসব কারণে হামাসের আল-কাসসাম ব্রিগেডের যোদ্ধারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, ‘আল-আকসা তুফান’ অভিযান চালিয়ে এবং ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক ও গোয়েন্দা পরাজয় ঘটিয়ে, অব্যাহত সহিংসতার পরিণতির ব্যাপারে ইসরাইলকে সতর্ক করে দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, আল-কাসসাম ব্রিগেড যোদ্ধারা প্রমাণ করেছেন যে, অতীতের মতো ক্ষমতার ভারসাম্য এখন আর ইসরাইলের পক্ষে নেই এবং ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলকে আঘাত হানতে সক্ষম। এমনকি আত্মরক্ষায় তারা পিছিয়ে নেই। অতএব, এটা বলা যায় যে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে হামাস যা করেছে তা একান্তই আত্মরক্ষামূলক।